Ameen Qudir

Published:
2019-05-11 19:22:53 BdST

২ বছরের ইন্টার্নশিপ ! তোঘলকি না কি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত ?


 



ডা. অসিত বর্দ্ধন
____________________________


অনলাইনে একটা খবর দেখেছি , ইন্টার্নশিপ না কি ২ বছরের হতে যাচ্ছে। এটা নিয়ে স্বাস্থ্যক্ষেত্রের নীতিনির্ধারকেরা বসেছেন, আরও বসবেন, এবং হয়ত খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত হবে।
যেহেতু দেশের বাইরে থাকি, তাই সব খবর পাই না। এটা জানিনা যে এ প্রসঙ্গে , ছাত্র, মেডিকেল শিক্ষক , অধ্যাপক বৃন্দ, স্বাস্থ্য প্রশাসক যারা নীতি নির্ধারনি পর্যায়ের সকলের সঙ্গে অনেক মতবিনিময় হয়েছে কি না।
আমরা অনেক সিদ্ধান্ত নেই বিদেশি অভিজ্ঞতার আলোকে। বিদেশি মানেই সব কিছু আমাদের প্রকৃতিতে সহজে মানিয়ে যাবে এমন নয়। যেমন বিদেশি পাম গাছ আমাদের প্রকৃতিতে খাপ খায় নি। একটা সময়ে দেশি গাছ বাদ দিয়ে কাঠের জন্য বিদেশি পাম গাছ লাগানোর ফ্যাশন উঠেছিল। যতটা কাঠের জোগান হয়েছে, তার চাইতে বেশি বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখে এক সময় এই ফ্যাশন ঝড়ে পড়েছে।
আরেকটি কাজ যা আমাদের প্রকৃতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে তা হচ্ছে ডীপ টিউবঅয়েল। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর হ্রাস পেয়ে এখন বিপদজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে ।এর সাথে মেডিকেল ছাত্রদের ইন্টার্নশিপের ২ বছর করার সম্পর্ক কি? সম্পর্ক সেই প্রকৃতিতে মানানসই কি না , তা নিয়ে।

আমরা যেবার ইন্টার্নশিপ শুরু করি ১৯৯০ সালে ঠিক সেবার থেকেই ইন্টার্নশিপের বিষয় পরিবর্তন হয়েছিল। এর আগে ছিল একজন সার্জারি, মেডিসিন ও গাইনিতে ৩ মাস করে কাজ করবেন। এর পরে বাকি ৩ মাস তিনি বিভিন্ন বিষয়ে ট্রেনিং নিতে পারবেন। আমাদের সময়ে ঠিক হল যে যেহেতু বিদেশে ট্রেনিং কাউন্ট করার সময় ৬ মাসের কম কোনও ট্রেনিং কাউন্ট হয় না, তাই ছয় মাস মেয়াদী যে কোনও দুটো সাবজেক্ট নিতে হবে। অর্থাৎ মেডিসিন , সার্জারি ও গাইনি থেকে যে কোনও দুটি সাবজেক্ট। আমাদের তো মাথায় বাজ! তাহলে আমরা শিশু বিভাগ , অরথপেডিক্স হাতে কলমে শিখব কিভাবে? তখন স্থানীয় ভাবে সিদ্ধান্ত হল যে, মেডিসিন নিলে ট্রেনিং লেখা হবে ৬ মাস মেডিসিন , কিন্তু বাস্তবে ট্রেনিং হবে ৫ মাস মেডিসিন ও এক মাস শিশুবিভাগ। একই ভাবে সার্জারি হবে ৬মাসের কিন্তু তার ১ মাস হবে অরথপেডিক রোটেশান। এই পরিবর্তনের পজিটিভ ও নেগেটিভ দুটো দিক ছিল। নেগেটিভ দিক হল যে আগে যেভাবে সব বিষয়ে হাতে কলমে কিছু কিছু জ্ঞান আহরণ করা যেত, তা সঙ্কুচিত হয়ে গেল। পজিটিভ দিক হোল, আমি যখন এনেস্থেসিয়াতে ডিপ্লোমাতে ভর্তি হতে গেলাম তখন প্রয়োজন ছিল ৬ মাস মেডিসিন বা সার্জারিতে প্রশিক্ষণ। আমার ইন্টার্নশিপের সময়ে করা ৬ মাসের সনদ কাজে লেগেছিল। সেই সময় সামাদ স্যার আমার এপ্লিকেশন নিয়েছিলেন। উদাহরণটা সবার ক্ষেত্রে সমভাবে খাটবে না, তবে এটুকু বোঝার জন্য যথেষ্ট যে ইন্টার্নশিপ কয় বছর হবে বা কিভাবে হবে সেই সিদ্ধান্ত একজন চিকিৎসকের ভবিষ্যত কর্মজিবনের উপর অমোচনীয় প্রভাব ফেলে।


এখন ইন্টার্নশিপ ২ বছর হলে কি কি লাভ? কেউ কেউ ভাবেন যে এর ফলে চিকিৎসকেরা গ্রাম বা থানা পর্যায়ে কাজের অভিজ্ঞতা পাবেন। আমাদের বেশিরভাগ জনগণের বাস গ্রামেই। তাদের আর্থসামাজিক পরিস্থিতি দেখে ডাক্তাররা সামাজিক পরিস্থিতিভেদে যে চিকিৎসার তারতম্য হয় সে ধারনা পাবেন, যা ভবিষ্যতে কাজে লাগবে। এই ডাক্তারেরা পর্যায়ক্রমে থানায় যাবেন, তাই সেখানে চিকিৎসক সঙ্কটের সুরাহা হবে। কারো কারো মনে হতে পারে যে, একজন বিসিএস ক্যাডারের চিকিৎসকের বেতনের চাইতে ইন্টার্নশিপ সময়ে যেহেতু অনেক কম ভাতা দেওয়া হয় , তাই সরকারের অনেক টাকা সাশ্রয় হবে।

২ বছরের ইন্টার্নশিপ এর ধারনাটা হয়ত বিদেশ নির্ভর। ঠিক কোত্থেকে এই ধারণটা এসেছে জানিনা। এবং এটা হবহু এসেছে কি না তাও অজানা। আয়ারল্যান্ডে ইন্টার্নদের জেলা বা কাউন্টি পর্যায়ের হাসপাতালে এটাচমেন্ট নিতে হয়। মনে রাখা দরকার এই সমস্ত হাসপাতালে চিকিৎসা সুবিধা আমাদের বিভাগীয় স্তরের মেডিকেল কলেজের প্রায় সমান। যন্ত্রপাতির সুবিধাও কেন্দ্রের যে কোনও আধুনিক হাসপাতালের সমান। এই পোস্টিং আগে থেকে নির্দিস্ট করা। তাদের আবাসন আগে থেকে ঠিক করা থাকে। ট্রেনিং বডি এই আবাসন ব্যবস্থা করে। কানাডায় মেডিসিন পড়ার সময়ে ফোর্থ ইয়ারে এরা সারা দেশে বিভিন্ন হাসপাতালে সংযুক্তি নেয়। এটা আবেদনের উপর নির্ভর করে। সাধারণত ভবিষ্যতে যে হাসপাতালে পোষ্ট গ্রাজুয়েশন করতে চায়, সেই হাসপাতালে ও সেই সমস্ত বিষয়ে এরা সংযুক্তি নেয়। এটি সম্পূর্ণ ঐচ্ছিক, কিন্তু যত বেশি হাসপাতাল এটাচমেন্ট, তত বেশি পরিচিতি। এই সময়টা আমাদের ইন্টার্নশিপের মতই , কিন্তু তখনো এরা পুর্ন চিকিৎসক নয়। এরা নিজেরা হিস্ট্রি লেখে , কন্সলাটেন্টকে জানায় কি করতে হবে, এবং অনুমোদন পেলে পুরো চিকিৎসা ডিক্টেশান দেয়, কিন্তু সেই চিকিৎসকের নামে। ভাল করে এটা বোঝাতে চাই যে এরা বিকল্প চিকিৎসক নয়, এরা চিকিৎসা শিখছে।

পোষ্টগ্রাজুয়েশনে রেসিডেন্সির সময়ে সার্জারির রেসিডেন্সকে জেলা পর্যায়ে ৬ মাস কাজ করতে হয়। এরা যখন আসে তখন কনসাল্টেন্টগন নিজে হাতে ধরে এদের কাজ শিখান। এরা প্রায় সব অপারেশন নিজে করে কনসাল্টেন্টের উপস্থিতিতে । এই ট্রেনিং এর উদ্দেশ্য হচ্ছে যখন এরা পাস করে কনসালটেন্ট হিসেবে (আমাদের) জেলা পর্যায়ের হাসপাতালে যাবে, তখন তারা যেন আত্মবিশ্বাসের সাথে সেখানে কাজ করতে পারে। যে কথাটা খুব, খুব, খুব গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে যন্ত্রপাতি ও লোকবল যা জেলা পর্যায়ে থাকে, তা কেন্দ্রের যে কোনও হাসপাতালের সমান।
উপরের দুটো উদাহরণ নিয়ে যদি বাংলাদেশে তাকাই তাহলে কয়েকটি দুঃখজনক বিষয় সবার আগে মাথায় আসে। প্রথম হল উপজেলা তো দূরের কথা আমাদের জেলা পর্যায়ে চিকিৎসার যথেষ্ট উপকরণ ও লোকবল নেই। ( যারা পড়ছেন, দয়া করে কিছু ওষুধ থাকাকে যথেষ্ট উপকরণ ভাববেন না। )। এখানে পদায়ন হলে একজন শিক্ষার্থীকে ঠিক কি শেখানো হবে? কিভাবে ৩ ঘণ্টায় ১৫০ রোগী দেখতে হয় ? নাকি একজন রোগীর আউটডোরে বা ইমারজেন্সি থেকে ইনডোর চিকিৎসা হয়ে ডিসচার্জ পর্জন্ত আধুনিক চিকিৎসা দেওয়া ? যে জেলায় এম্বুলেন্স বিকল থাকে, হাসপাতালে এক্সরে মেশিনে ফিল্ম থাকে না, রক্ত পরীক্ষার সুযোগ নেই, সেই হাসপাতালকে বিশ্বমানের বলে চাটুকারিতা করা শিখবে, নাকি রোগীকে সঠিক পরামর্শ দিয়ে সুবিধাসম্পন্ন হাসপাতালে পাঠানো শিখবে?

যে কোনও চিকিৎসায় সমাজকে বোঝা জরুরি। সব দেশে স্থানীয় প্রয়োজনের উপর মেডিকেল কারিকুলাম সাজানো হয়। এজন্য ডাক্তারেরা কমুনিটি মেডিসিন পড়ে।সাইকোলজি পড়ে। আমাদের অধ্যাপকেরা ছাত্রদের শেখান যে উপজেলাতে যেয়ে তারা কি ধরনের রোগী পাবে। আরও শেখানো হয়, কতক্ষণ সেই রোগী উপজেলাতে রাখা যাবে, কখন রেফার করতে হবে। ঠিক এটুকু শেখানোর জন্য কাউকে উপজেলাতে পাঠানোর মনে হয় কোনও দরকার নেই।

হাতের কাছে একটা ভয়ঙ্কর উদাহরণ আছে। সরকারী বেসরকারি মিলিয়ে মানহীন মেডিকেল কলেজের সংখ্যা অনেক। কোথাও ঠিকমত হাসপাতাল নেই, রোগী নেই, পড়ানোর জায়গা নেই, মান নিয়ন্ত্রণ নেই। বেসরকারি মেডিকেল কলেজ গুলোর অনুমোদনের ক্ষেত্রে কারো স্ত্রী বা ছেলে, কারো শ্যালিকা , কারও খাস কনট্রাক্টরের হাত দিয়ে অনুমোদনের নামে নয় ছয় হয়েছে। এখন কলেজগুলো থেকে যারা বের হচ্ছে বা হবে সবাই তাদের দিকে একটা অশুভ আঙ্গুল তুলছে। এই ছেলেমেয়ে গুলো তো কোনও দোষ করেনি! অথচ আজ এরাই ভুক্তভোগী। যাদের আমরা মেডিকেল কলেজ গুলোতেই শেখাতে পারছি না, তাদের আমরা কি করে ওই সমস্ত হাসপাতালে শেখাব, যেখানে নিরাপত্তা নেই, ঠিকমত লোকবল (ডাক্তার, নার্স, ও আনুসাঙ্গিক ) পদায়ন নেই , যন্ত্রপাতি নেই , এদের সার্বিক দায়িত্ব নেওয়ার ও কেউ নেই?

দেশবরেণ্য নেতারা নেন যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত , যেখানে ভবিষ্যৎ প্রাধান্য পায়! গিয়াসুদ্দিন তুঘলক সিদ্ধান্ত নিতেন ইচ্ছেমত। তিনি এক রাতের সিদ্ধান্তে রাজধানী সরিয়ে নিয়েছিলেন বলে জনশ্রুতি আছে। আবার সেই রাজধানী ফিরে এসেছিল আগের জায়গায়। ইন্টার্ন শিপ ২ বছর করার সিদ্ধান্ত নিতে হয়ত কয়েকটা মিটিং লাগবে, কিন্তু এর প্রভাব হবে সুদূর প্রসারী। যা প্রভাব ফেলবে আমাদের শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ জীবনে। যারা আজ সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তার অনেকেই কাল থাকবেন না। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত ভুল প্রমাণিত হলে কেউ কি ফিরিয়ে দিতে পারবেন আমাদের ছেলেদের হারানো বছর গুলো?

আমরা কেউ জানি না ভবিষ্যতের গর্ভে কি আছে। তবে যে অবকাঠামো এখনো বর্তমান , সেই অবকাঠামোতে এরকম সিদ্ধান্ত বুমেরাং হবে নিশ্চিত। কিন্তু যদি প্রয়োজনীয় সংস্কার করার পরে এরকম সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয়, তা হতে পারে গেম চেঞ্জার!
_________________________

ডা. অসিত বর্দ্ধন । পাঠক ধন্য সুলেখক। তার তৈরী করা অ্যাপস ডাক্তারদের কল্যাণে এখন জনপ্রিয়।
কানাডায় কর্মরত এনেস্থেসিওলজিস্ট, BDEMR নামের সফটওয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা।

আপনার মতামত দিন:


ক্যাম্পাস এর জনপ্রিয়