Ameen Qudir

Published:
2019-04-29 23:47:58 BdST

" আপনি কি এমন আহামরি ডাক্তার, আপনি আমারে ইমার্জেন্সী শিখান? "





ডা. সাঈদ এনাম___________________

 

এক.

ফজরের নামাজ আদায় করার জন্যে ওজু পড়তে যেয়ে আম্মা বাথরুমে পড়ে যান। মাথায় আঘাত পান এবং কপালের কিছু অংশ কেটে যায়। আম্মা সে জায়গাটা চেপে ধরে চুপচাপ শুয়ে ছিলেন। এতে রক্ত পড়া বন্ধ হয়ে যায়। কেবল সামান্য ওজিং হয়তো হচ্ছিলো।

আম্মা প্রাথমিক চিকিৎসা জানতেন। সেটা তাঁর প্রাথমিক স্কুল থেকেই শিখা। ১৯৪০ সালের কথা। প্রাথমিক স্কুলে আম্মা তাঁর ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল ছিলেন। আম্মার হাতের লেখা এমনই সুন্দর ছিলো যে, তাঁর শিক্ষক শিক্ষিকা মহোদয় গন অন্য সকল ছাত্রছাত্রী কে আম্মার হাতের লেখা ফলো করতে বলতেন। আমাদের হাতের লেখাও আম্মার কাছ থেকে শেখা।

ছেলেবেলা খেলতে যেয়ে হাত পা কটলে বা ছিলে গেলে আম্মা বলতেন,সেই কাটা অংশ পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে চেপে ধরতে। তাতে রক্ত পড়া বন্ধ হয়ে যাবে।

যাহোক সকালে বড় ভাই আম্মার কপাল লাল এবং কাটা অংশে ওজিং দেখে চমকে উঠেন। তিনি সব জানতে পেরে যারপরনাই ব্যতিব্যস্ত হন। কেনো ঘুম থেকে তাড়াতাড়ি ডেকে জাগালেন না সে জন্যে অভিমান করেন। আম্মা হেসে বললেন, বাবু তুই ঘুমাচ্ছিস, তোর ঘুমটা পূর্ন হোক। সারাদিন কত পরিশ্রম করিস। আর আমার কাটাটা'তো সামান্য। আসলে মা' তো মা ই। মায়ের তুলনা হয়না।

বড় ভাই তড়িৎ এম্বুলেন্স ডেকে আম্মাকে হাসপাতালে নিলেন। কিন্তু সেখানে চিকিৎসা 'তড়িৎ' শুরু হলোনা। আম্মাকে ইমার্জেন্সী ওয়েটিং রুমে চার ঘন্টা বসে থাকতে হলো। ওটাই নিয়ম। আগে ইমার্জেন্সী কেইস পরে কুল কেইস। সে সময় বড় ভাই বিরক্ত হয়ে আমাকে ফোন দিলেন। অনেকটা অভিযোগের ও সুর। কপাল কেটে রক্ত বেরুচ্ছে সেটা কি ইমার্জেন্সী না? যদিও আমি কস্ট হচ্ছিলো, তবুও ঠোট দাঁত চেপে বললাম, 'হ্যা বড় ভাই, ওটা ইমার্জেন্সী চিকিৎসার আওতায় পড়েনা, তুমি চিন্তা করোনা'।
"এ ডক্টর অপিনিওন ইজ ওলওয়েজ রাইট, নট এটেন্ডেন্ট"

দুই.
আমি আম্মার আঘাতের কথা শুনে হতচকিত হয়ে যাই। বড়ভাই কে জিগ্যেস করি তিনি কি অজ্ঞান হয়েছিলেন। বড়ভাই বললেন, 'না'। আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। কিন্ত মনটা কাঁদছিলো আম্মার কপালের আঘাতের জন্যে। মনে হলো নিজের কপাল টা কেটেছে। নিজেকে কিছুটা সামলে বললাম, 'ভাই ব্যস্ত হবার কিছু নেই। একটু অপেক্ষা করো। এটা ইমার্জেন্সী কেইসে পড়ে না'। বড়ভাই একটু বিরক্ত হয়ে বললেন, "তোরা ডাক্তাররা কি যে বলিস?"।

আমেরিকাতে আপনি যেই হোন, স্বয়ং প্রেসিডেন্ট হলেও আপনাকে হাসপাতালে, স্টোরে কিউ বা লাইন মেনে চলতে হবে। আপনি এলাকার বড় গুন্ডা, মেম্বার, চেয়ারম্যান, পলিটিশিয়ান কিংবা প্রশাসনের বিশাল বড়কর্তা ওসব পরিচয় দিয়ে লাইনে প্রথমে আসবেন, জোর দেখাবেন, হাসপাতালের ইমার্জেন্সীতে টাংকি মারতে যাবেন। ওসব হবেনা। তাতে আপনার কপালে চিকিৎসা নাও জুটতে পারে। বরং সোজা হাতকড়া পরিয়ে হাজতে নেবার ব্যবস্থা করা হবে। 'কি হনুরে' বলে পরিচয় দিয়ে হাসপাতাল টাংকি মারা যথাযথ স্থান না, এতে হিতে বিপরীত হয়।

তিন.

দীর্ঘ চার ঘন্টা অপেক্ষার পর আম্মার ডাক পড়ে। দুটো সেলাই দেওয়া হয়। যদিও হেড ইনজুরি নেই, তবুও এম. আর. আই. আর পড়ে যাওয়ার কারন খুঁজতে ব্লাডের সব পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়। আম্মাকে নিউইয়র্ক হাসপাতাল থেকে রিলিজ দিয়ে বিশ্রামের জন্যে বাসায় থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়। বলে রাখি আম্মার সার্বক্ষণিক দেখভালোর জন্যে আমেরিকা স্বাস্থ্য প্রশাসন আগে থেকেই সার্বক্ষণিক নার্স রেখেছে।

শেষ কথা, আসুন এবার আমাদের দেশের ইমার্জেন্সীর দিকে তাকাই। আমি নিজেও ডাক্তার। ইমার্জেন্সী চালিয়েছি প্রায় সারাজীবনই। কি যে অবস্থা...! একটা রোগীর সাথে দশটা আকাইম্যা অভিভাবক হেসে হুমড়ি খেয়ে পড়ে ডাক্তারের উপর। একটু দেরী হলে বা অপেক্ষা করতে বললে ডাক্তার কে তেড়ে আসে।

বেশ আগে একবার আমার এক আর এম ও কে ইমার্জেন্সী চিকিৎসা নিয়ে বাকবিতন্ডা করে কিছু এটেন্ডেন্ট তেড়ে আসে। রাজনৈতিক নেতা পাতিনেতার "ছানা-পোনা" বলে পরিচয় দেয়। আমি স্যাকমো কে বলি, "ওদের ভিডিও করো। আর পুলিশ ডেকে মামলা দেবার ব্যবস্থা করো"। ডাক্তার হত্যা প্রচেষ্টা মামলা, সিস্টার কে ইভ টিজিং এর মামলা(নারী নির্যাতন) , আর সরকারি কাজে বাঁধা প্রদান মামলা। পরে সবাই হাত পা ধরে ক্ষমা চায়।

এই হলো আমাদের ইমার্জেন্সী চিকিৎসা ব্যবস্থা। এদেশের হাসপাতালে, কোন নেতার মা', কোন হোমড়া চোমড়ার মা, কোন গুন্ডার' মা বা কোন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার মা'কে যদি কপাল কাটা নিয়ে ইমার্জেন্সীতে চার ঘন্টা বসে থাকতে হয়, তাহলে নিশ্চিত সেটা পরের দিন পত্রিকার শিরোনাম হবে। হাসপাতাল জ্বালিয়ে দেয়া হবে। ডাক্তার কে মারা হবে।

এম পি মন্ত্রী গিয়ে সবাই গিয়ে বলবেন,
"আরে মশাই, আপনি কি এমন আহামরি ডাক্তার? আপনি আমারে ইমার্জেন্সী শিখান? আপনি কি আমার লগে ফাইজলামি করেন? আমার কপাল কাটা মুমূর্ষু রোগীটারে চার ঘন্টা বসায়া রাখছেন?"
_______________________

ডা. সাঈদ এনাম
সাইকিয়াট্রিস্ট

মেম্বার, আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক এসোসিয়েশন
মেম্বার, ইউরোপিয়ান সাইকিয়াট্রিক এসোসিয়েশন।

আপনার মতামত দিন:


ক্যাম্পাস এর জনপ্রিয়