ডা শাহাদাত হোসেন

Published:
2023-01-10 21:32:11 BdST

এক মহান বিশ্বনেতার স্বদেশে প্রত্যাবর্তন


অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান : কোষাধ্যক্ষ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও চেয়ারম্যান, বক্ষব্যাধি বিভাগ


অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান
_______________________________

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাঙালির শ্রেষ্ঠ সন্তান। বঙ্গবন্ধু তার সারাজীবন দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য কাজ করে গেছেন। একটি স্বাধীন দেশের নাম, একটি পতাকার নাম, একটি স্বাধীনতার নাম, বাংলার ইতিহাসের নাম, চিরসংগ্রামী এক মহামানবের নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাঙালির অনুভূতি ও অন্তর আত্মায় মিশে থাকা এক মহান নাম। বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মানেই বাংলার মুক্ত আকাশ। শেখ মুজিব মানেই বাঙালির অবিরাম মুক্তির সংগ্রাম। শেখ মুজিব মানেই বাঙালি জাতির অস্তিত্ব। শেখ মুজিব মানেই বাঙালির ঠিকানা। শেখ মুজিব মানেই বাঙালি জাতির আশ্রয়-ভরসা। শেখ মুজিব মানেই বাঙালির আদর্শ। শেখ মুজিব মানেই ঝড়-ঝঞ্ঝার মধ্যে মাথা উঁচু করে বাঙালির সঠিক পথে চলা। শেখ মুজিব মানেই বাঙালির মৃত্যুঞ্জয়ী চেতনা। শেখ মুজিব মানেই সাম্য-অধিকার-গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। শেখ মুজিব মানেই দেশের জনগণের প্রতি, মানুষের প্রতি ভালোবাসা। শেখ মুজিব মানেই নিজ নিজ ধর্ম পালনের স্বাধীনতা। শেখ মুজিব মানেই বাঙালির দিশা, আলোর দিশারি। শেখ মুজিব মানেই তো বাংলাদেশ, স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পর ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি বাহিনী বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানের কারাগারের যে সেলে রেখেছিল, তার পাশের সেলেই একটি কবর খুঁড়ে রাখা হয়েছিল- যেটিকে দেখিয়ে বঙ্গবন্ধুকে বলা হতো যে কোনো সময় তাকে জীবিত কবর দেওয়া হবে। কিন্তু হিমালয় পর্বত সমতুল্য মানুষ বঙ্গবন্ধু অসম্ভব সাহস আর দেশপ্রেমের অসীম টানে তাদের বলেছিলেন- ‘তোমরা যদি আমাকে মেরে ফেলো, তা হলে আমার লাশটি বাংলার মাটিতে পাঠিয়ে দিও।’ বাংলার মাটি, বাংলার জনগণের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসা ছিল এতটাই প্রখর। আজ ১০ জানুয়ারি এক মহান বিশ্বনেতার স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের দিবস। ২৯০ দিন পাকিস্তানের কারাগারে প্রতিমুহূর্তে মৃত্যুর প্রহর গুনতে গুনতে লন্ডন-দিল্লি হয়ে মুক্ত স্বাধীন স্বদেশের মাটিতে ফিরে আসেন বাঙালির ইতিহাসের বরপুত্র শেখ মুজিবুর রহমান।

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা ও স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি পাকিস্তানের কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠ থেকে মুক্তি লাভ করে তার স্বপ্নের স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে ফিরে আসেন। বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জন করে। মহান মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসার মাধ্যমে ওই বিজয় পূর্ণতা লাভ করে। এদিন স্বাধীন বাংলার নতুন সূর্যালোকে সূর্যের মতো চিরভাস্বর, উজ্জ্বল, মহান নেতা ও ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ফিরে আসেন তার প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে। স্বদেশের মাটি ছুঁয়ে জননন্দিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দাঁড়িয়ে তার ঐতিহাসিক ধ্রুপদী বক্তব্যে বলেন- ‘যে মাটিকে আমি এত ভালোবাসি, যে মানুষকে আমি এত ভালোবাসি, যে জাতিকে আমি এত ভালোবাসি; আমি জানতাম না সে বাংলায় আমি যেতে পারব কিনা। আজ আমি বাংলায় ফিরে এসেছি বাংলার ভাইয়েদের কাছে, মায়েদের কাছে, বোনদের কাছে। বাংলা আমার স্বাধীন, বাংলাদেশ আজ স্বাধীন।’ যুদ্ধবিধ্বস্ত ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন সদ্য স্বাধীন বাঙালি জাতির কাছে ছিল একটি বড় প্রেরণা। দীর্ঘ সংগ্রাম, ত্যাগ-তিতিক্ষা, আন্দোলন ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার প্রশ্নে বাঙালি জাতি যখন কঠিন এক বাস্তবতার মুখোমুখি- তখন পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। প্রতিবছর নানা আয়োজনে পালন করা হয় বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকেও যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি পালন করা হবে।



ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের বিষয়ে একটু বিস্তারিত উল্লেখ করছি। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে বঙ্গবন্ধু সর্বস্তরের জনগণকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান। স্বাধীনতা ঘোষণার অব্যবহিত পর পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে তাকে গ্রেপ্তার করে তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে নিয়ে আটক রাখা হয়। জাতির পিতা পাকিস্তান থেকে ছাড়া পান ১৯৭২ সালের ৭ জানুয়ারি ভোররাতে অর্থাৎ ৮ জানুয়ারি। এদিন বঙ্গবন্ধুকে বিমানে তুলে দেওয়া হয়। সকাল সাড়ে ৬টায় তিনি পৌঁছান লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে। সকাল ১০টার পর থেকে বঙ্গবন্ধু কথা বলেন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ, তাজউদ্দীন আহমদ ও ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীসহ অনেকের সঙ্গে। পরে ব্রিটেনের বিমানবাহিনীর একটি বিমানে করে পরের দিন ৯ জানুয়ারি দেশের পথে যাত্রা করেন। ১০ জানুয়ারি সকালে তিনি দিল্লিতে নামেন। সেখানে ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, মন্ত্রিসভা, প্রধান নেতৃবৃন্দ, তিন বাহিনীর প্রধান এবং অন্যান্য অতিথি ও সে দেশের জনগণের কাছ থেকে উষ্ণ সংবর্ধনা পান শেখ মুজিব। এ সময় তিনি ভারতের নেতৃবৃন্দ ও জনগণের কাছে তাদের অকৃপণ সাহায্যের জন্য আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানান। তার এই স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে তিনি আখ্যায়িত করেছিলেন ‘অন্ধকার থেকে আলোর পথে যাত্রা’ হিসেবে। ১০ জানুয়ারি দিল্লি থেকে দুপুর ১টা ৪১ মিনিটে ঢাকার মাটিতে পা রাখেন বঙ্গবন্ধু। আনন্দে আত্মহারা লাখো বাঙালি ঢাকা বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দান (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পর্যন্ত তাকে স্বতঃস্ফূর্ত সংবর্ধনা জানান। বিকাল ৫টায় রেসকোর্স ময়দানে প্রায় ১০ লাখ লোকের উপস্থিতিতে তিনি ভাষণ দেন। পরের দিন বিভিন্ন পত্রিকায় বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন নিয়ে এভাবেই লেখা হয়- ‘স্বদেশের মাটি ছুঁয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসের নির্মাতা শিশুর মতো আবেগে আকুল হলেন। আনন্দ-বেদনার অশ্রুধারা নামল তার দুচোখ বেয়ে। প্রিয় নেতাকে ফিরে পেয়ে সেদিন সাড়ে সাত কোটি বাঙালি আনন্দাশ্রুতে সিক্ত হয়ে জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু ধ্বনিতে প্রকম্পিত করে তোলে বাংলার আকাশ-বাতাস।



বঙ্গবন্ধুকন্যা, প্রধানমন্ত্রী ও জননেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে বিশ্বদরবারে উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত করেছেন। দেশবাসীকে জননেত্রী শেখ হাসিনার হাত আরও শক্তিশালী করে দেশের অগ্রগতি সমুন্নত রাখার মাধ্যমে ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস ২০২৩ সফল করে তুলতে হবে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ৩০ লাখ শহীদের জীবন ও রক্ত এবং দুই লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে বাংলাদেশ বিজয় লাভ করলেও ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে সেই বিজয়ের পূর্ণতা পায়। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে পুরো বাঙালি জাতি সেদিন আনন্দের জোয়ারে ভাসছিল। ঢাকার রাজপথ লোকে লোকারণ্য হয়ে গিয়েছিল। আজকের এই ঐতিহাসিক দিনে আমাদের শপথ নিতে হবে- বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলতে বঙ্গবন্ধুকন্যা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত শক্তিশালী করতে হবে, নিজ নিজ কর্মস্থলে যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে হবে। আমাদের স্মরণে রাখতে হবে, বর্তমানেও বাংলার মাটিতে থাকা পাকিস্তানের দালালরা সক্রিয়। দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে দেশের ভেতরে। কেউ কেউ বিদেশে অবস্থান করেও ষড়যন্ত্র করে চলছে। তারা বাংলাদেশকে আবারও পেছনের দিকে নিয়ে যেতে চায়, বাংলাদেশকে পাকিস্তানের ধ্যান-ধারণায় পরিচালিত করতে চায়। তাদের বিরুদ্ধে আমাদের সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। বঙ্গবন্ধুকন্যা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশি-বিদেশি সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে তার প্রজ্ঞা এবং দূরদৃষ্টি দিয়ে দেশকে উন্নয়ন ও সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। তাই আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলতে জননেত্রী শেখ হাসিনার হাত শক্তিশালী করার বিকল্প নেই।

_______

অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান : কোষাধ্যক্ষ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও চেয়ারম্যান, বক্ষব্যাধি বিভাগ

আপনার মতামত দিন:


বিএসএমএমইউ এর জনপ্রিয়