ডা শাহাদাত হোসেন

Published:
2023-01-08 05:56:09 BdST

স্পাইনাল কর্ড ইনজুরি চিকিৎসায় নিঃস্ব হচ্ছে মানুষ, প্রতিরোধে সচেতনতা জরুরি: বিএসএমএমইউ উপাচার্য




ডেস্ক
_______________
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে স্পাইনাল কর্ড আঘাতপ্রাপ্ত রোগীদের উপর গবেষণার প্রাথমিক ফলাফল নিয়ে “পিপল উইথ স্পাইনাল কর্ড ইনজুরি ইন বাংলাদেশ” শীর্ষক ডিসিমিনেশন অনুষ্ঠিত হয়েছে। আজ শনিবার বেলা সাড়ে ১১টায় (৭ জানুৃয়ারি ২০২৩ খিস্টাব্দ) বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ ডা. মিল্টন হলে এর আয়োজন করে ফিজিক্যাল মেডিসিন এন্ড রিহ্যাবিলিটেশন বিভাগ। গবেষণার ফলাফলকে সামনে রেখে জানুয়ারী ২০২৩ থেকে গবেষণার দ্বিতীয় পর্বের জন্য কমিউনিটি পর্যায়ে গবেষণা শুরু হবে। সেখান থেকে আক্রান্ত ব্যক্তিদের স্বাস্থ্য, দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড, ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও আর্থসামাজিক জীবন বৃত্তান্ত আমাদের এই গবেষণার মাধ্যমে তুলে আনা হবে। এই ধরণের গবেষণা বাংলাদেশে এই প্রথম পরিচালনা করা হচ্ছে। এই পর্বে আমরা ইন্টারন্যাশনাল স্পাইনাল কর্ড ইনজুরি ((InSCI) সার্ভের অংশ হিসেবে ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার সাথে যৌথভাবে গবেষণা করছে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মোঃ শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, মানুষের স্পাইনাল কর্ড ইনজুরিতে দেশের অর্থনীতি তো ক্ষতি হচ্ছে। পাশাপাশি স্পাইনাল কর্ড ইনজুরি আক্রান্ত পরিবারের তার চিকিৎসা করতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ দরকার। তার জন্য গবেষণা ও সচেতনা দরকার। সচেতনতার জন্য গণমাধ্যম সবচেয়ে বেশী ভূমিকা রাখতে পারে।
অধ্যাপক ডা. মোঃ শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, ফেইল সুইসাইডের কারণে মানুষ স্পাইনাল কর্ড ইনজুরি বেশী হচ্ছে। স্পাইনাল কর্ড ইনজুরি রোধে আত্মহত্যা প্রতিরোধ করতে হবে। এছাড়াও গ্রামাঞ্চলে গাছ থেকে পড়ে অনেকেই স্পাইনাল কর্ড ইনজুরিতে পড়ছেন। এজন্য গ্রামে গাছে উঠার জন্য প্রশিক্ষণ দরকার। এজন্য একটি ব্যবস্থা করা যায় কি সে বিষয়ে নীতি নির্ধারকরা মনোবিশেষ করতে পারে। পুরুষরা নারীদের তুলনায় বেশী স্পাইনাল কর্ডে আক্রান্ত হচ্ছে। এজন্য বলা যাবে না যে মেয়েরা কম আক্রান্ত হচ্ছে। নারীদের স্পাইনাল কর্ড ইনজুরি আক্রান্ত প্রতিরোধে ওড়না পরে রাস্তা পারাপার, মোটর বাইক ও রিক্সায় চলাচল করার সময় অধিক সচেতনা প্রয়োজন। কারণ অনেক নারী রাস্তায় চলাচল করার সময় রিক্সা ও মোটর বাইকে ওড়না পেচিয়ে স্পাইনাল কর্ড ইনজুরিতে পড়েন।
উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মোঃ শারফুদ্দিন আহমেদ আরো বলেন, স্পাইনাল কর্ড ইনজুরিতে পড়া রোগীদের চিকিৎসায় বিভাগীয় পর্যায়ে আলাদা চিকিৎসা কেন্দ্রের ব্যবস্থা করতে হবে । চিকিৎসকরা যাতে এসব হাসপাতালে ঠিকমত কর্তব্য পালন করতে এজন্য তাদের আবাস স্থান সুনিশ্চিত করতে হবে। এতে করে রোগীর পাশাপাশি তার পরিবারকে অর্থনৈতিক ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করা যাবে ।
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, ২০১৮ থেকে ২০২২ পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশে ১৮টি ইনস্টিটিউট এবং প্রাইভেট চেম্বার থেকে মোট ২৪৬৯ জন আঘাতজনিত এবং রোগ সম্পর্কিত স্পাইনাল কর্ড ইনজুরি ( এসসিআই) রোগীকে গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। এর মধ্যে ১৬৯৮(৬৮.৮%) পুরুষ এবং ৭৭১ (৩১.২%) মহিলা। বেশিরভাগ রোগী, ৮৬৪ (৩৫%), ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সী গ্রুপের অন্তর্গত। তাদের মধ্যে ১৪০৯ জন (৫৭.১%) আঘাতজনিত স্পাইনাল কর্ড ইনজুরি রোগী, ১০১৪ (৪১.১%) রোগ সম্পর্কিত, আর ৪৬জন (১.৯%) কড়া ইকুইনা সিন্ড্রোমে আক্রান্ত। ভর্তির সময় ১৫১৬(৬১.৪%) জন ঝঈও আক্রান্ত ব্যক্তিকে টেট্রাপ্লেজিক এবং ৯৫৩ (৩৮.৬%) জনকে প্যারাপ্লেজিক হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়েছিল। রোগ-সম্পর্কিত SCI এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিল অবক্ষয় (৪২.৫%), তারপরে টিউমার (৪০.৩%) এবং পরে যক্ষ্মা (১১.৮%) আক্রান্ত রোগী। সাথে ছিল মাথার আঘাত এবং হাত পা হাড়ের ফ্র্যাকচার। সবচেয়ে বেশি জটিলতা ছিল অস্ত্রের মূত্রাশয় (৭.৩%) এবং চাপের আঘাতজনিত জটিলতা (১.৭%)। আঘাতজনিত SCI -এর রোগীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রোগী ছিল উপর থেকে পড়ে যাওয়া (৪৫.৪৩%), এরপরে সড়ক দুর্ঘটনায় আঘাতপ্রাপ্ত (২৯.৩৮%)। বেশিরভাগ আঘাতমূলক স্পাইনাল কর্ড ইনজুরির সাথে ছিল মাথার আঘাত এবং হাত পা হাড়ের ফ্রাকচার । সবচেয়ে বেশী জটিলতা অন্ত্রের- মূত্রাশয় ( ৭.৩%) এবং চাপের আঘাতজনিত জটিলতা (১.৭%) ছিল।
সেমিনারে জানানো হয়, স্পাইনাল কর্ড ইনজুরি একটি বড় ধরণের জনস্বাস্থ্য বিষয়ক সমস্যা। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায় যে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে জীবনের খুবই মূল্যবান কর্মক্ষম সময়ে এই রোগ হয় এবং ভুক্তভোগী ব্যক্তির পারিবারিক ও সামাজিক জীবন অর্থহীন হয়ে পড়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে ২৫০,০০০ থেকে ৫০০,০০০ লোক মেরুদণ্ডের আঘাত বা রোগজনিত সমস্যায় (SCItrauma or disease) ভোগেন। ইতিপূর্বে আমাদের দেশে এই রোগ নিয়ে তেমন কোন বড় মাপের ভালো গবেষণা হয়নি এবং আমাদের দেশে এই রোগীদের কোন রেজিস্ট্রি ও সংরক্ষণ করা হয় না। এমন কি তাঁদের জরুরী ও পুনর্বাসন চিকিৎসা ব্যবস্থা অপ্রতুল ও অবৈজ্ঞানিকভাবে পরিচালিত হয়ে আসছে। স্পাইনাল কর্ড ইনজুরি রোগীদের জন্য হাসপাতালের বহির্বিভাগে আলাদা লাইন ও হুইল চেয়ারে চলাচল করার জন্য হাসপাতালে পাবলিক স্থানে স্পেস প্রয়োজন এবং এঁদের সমাজে অন্তর্ভুক্তি বেগবান করা দরকার। বাংলাদেশ স্পাইনাল কর্ড ইনজুরি (BanSCI) সার্ভে, ইন্টারন্যাশনাল স্পাইনাল কর্ড ইনজুরি (InSCI) কমিউনিটি গবেষণার একটি অংশ। এটি মেরুদণ্ডের মেরুমজ্জায় আঘাত নিয়ে বসবাসকারী ব্যক্তিদের বাস্তব জীবনযাত্রার মান ও সমস্যা চিহ্নিত করা সংক্রান্ত গবেষণার প্রাথমিক পদক্ষেপ। দেশকে একটি উন্নত দেশে রূপান্তরিত করার জন্য বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতকে অবশ্যই স্পাইনাল কর্ড ইনজুরিতে আক্রান্ত মানুষদের সমস্যা নিরসনে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এই গবেষণালব্ধ ফলাফল সমগ্র বাংলাদেশের মেরুদণ্ডের আঘাতজনিত বা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি সম্পর্কে একটি প্রাথমিক ধারণা দিয়েছে যা নীতিনির্ধারক ও গবেষকদের স্পাইনাল কর্ড ইনজুরিতে আক্রান্ত রোগীদের নিয়ে গবেষণা করার একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
এই গবেষণা একটি মাল্টি-ন্যাশনাল সমীক্ষা যেখানে ৪০টির ও বেশী দেশ জড়িত এবং সারা বিশ্বের ৬টি বিশ্বস্বাস্থ্য অঞ্চলে একযোগে স্পাইনাল কর্ড ইনজুরির উপর পরিচালিত প্রথম সমীক্ষা। শুরুতে ইন্টারন্যাশনাল স্পাইনাল কর্ড ইনজুরির পরামর্শ এবং সংশ্লিষ্ট গবেষকদের নিয়ে গবেষক দল কয়েকটি মিটিং শেষে একটি স্টাডি দল গঠন করে এবং প্রটকল মত সকল অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানের নৈতিক ছাড়পত্র গ্রহণ করা হয়। এই সমীক্ষাটিতে মেরুদণ্ডের আঘাতজনিত বা রোগ দ্বারা সৃষ্ট বাংলাদেশের সকল জনগোষ্ঠী অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। প্রথম ধাপে গবেষক দল বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান যেমন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারী-বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মিলিটারি হাসপাতাল, কর্রোপরেট হাসপাতাল, এনজিও হাসপাতাল এবং সেই সকল ব্যক্তিবর্গ যারা স্পাইনাল কর্ড ইনজুরি সম্পর্কিত রোগিদের নিয়ে বিভিন্নভাবে কাজ করে থাকেন, তাদের নিকট থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। পরবর্তীতে এই রোগিদের তথ্য যাচাই বাচাই, ডুপ্লিকেশন চেক এবং তাদের টেলিফোন করে প্রাপ্ত তথ্যাদি ক্রস চেক করে ফলাফল বের করা হয়েছে।
মুখ্য আলোচক হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জারি অনুষদের ডিন স্পাইন নিউরো সার্জন অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ হোসেন বলেন, স্পাইনাল কর্ড ইনজুরির প্রধান কারণ সড়ক দূর্ঘটনা । সড়ক দূর্ঘটনা যাতে না হয় সেদিকে নজর দিতে হবে। স্পাইনাল কর্ড ইনজুরির দ্বিতীয় প্রধান কারণ হল উচ্চতা গাছ ও বাড়ির ছাদ থেকে পরে যাওয়া। এসব প্রতিরোধের জন্য সচেতনা যেমন ট্রাফিক আইন মেনে চলা, ড্রাইভারকে সচেতন করা আবশ্যক। স্কুল বাচ্চাদের ভাড়ি ব্যাগ বহন না করা । স্পাইনাল কর্ড ইনজুরিতে পড়া রোগীদের দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।
প্রধান গবেষক হিসেবে ফিজিক্যাল মেডিসিন এন্ড রিহ্যাবিলিটেশন বিভাগের অধ্যাপক ডা. মোঃ তসলিম উদ্দিন এই গবেষণার সূচনা বক্তব্য উপস্থাপনা করে একজন স্পাইনাল কর্ড ইনজুরিতে আক্রান্ত এক রোগীর চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা গল্পের আকারে তুলে ধরেন।
এ অনুষ্ঠানে সভাপত্বি করেন ফিজিক্যাল মেডিসিন এন্ড রিহ্যাবিলিটেশন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. এমএ সালেক। মডারেটর ছিলেন সহযোগী অধ্যাপক ডা. মসিউর রহমান খসরু।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে উপ-উপাচার্য (গবেষণা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. মোঃ মনিরুজ্জামান খান, ডিজিএইচএস এর পরিচালক (এমআইএস) অধ্যাপক ডা. মোঃ শাহাদাৎ হোসেন বক্তব্য রাখেন। এছাড়া এই গবেষণার কো-অর্ডিনেটর ও কো ইনভেস্টিগেটর ফিজিক্যাল মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মোঃ তরিকুল ইসলাম গবেষণালব্ধ ফলাফল উপস্থাপনা করেন। বানস্কি স্টাডি গ্রুপের রিসার্চ এসিট্যান্ট ডা. আনিকা তাসনিম গবেষণার তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতি তুলে ধরেন।
সেমিনারে বলা হয়, ইন্টারন্যাশনাল স্পাইনাল কর্ড ইনজুরি সমীক্ষার মূল উদ্দেশ্য হল স্পাইনাল কর্ড ইনজুরি নিয়ে বসবাসকারী ব্যক্তিদের কার্যকারিতা, স্বাস্থ্য এবং সুস্থতার সাথে। সম্পর্কিত তথ্যগুলি বর্ণনা ও রোগিদের এই অবস্থা নিয়ে বেঁচে থাকার অর্থ কী তার মূল্যায়ন। সেইসাথে প্রাসঙ্গিক স্বাস্থ্য এবং পুনর্বাসন ব্যবস্থা, মেরুদণ্ডের আঘাতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জীবনকে উন্নত করতে সমাজ কী করতে পারে সে সম্পর্কে এই গবেষণার মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করা হবে। এই গবেষণার ফলাফলগুলি নীতি নির্ধারকদের স্পাইনাল কর্ড ইনজুরিতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের স্বাস্থ্য রক্ষণাবেক্ষণ এবং সুস্থতার জন্য নীতি সংস্কার সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করা হবে।
প্রেস রিলিজ বিএসএমএমইউ

আপনার মতামত দিন:


বিএসএমএমইউ এর জনপ্রিয়