Ameen Qudir

Published:
2020-03-17 01:44:34 BdST

কেমন থাকেন একাকী মায়েরা


 

লেখকের ছবি

অধ্যাপক ডা. ঝুনু শামসুন নাহার
বাংলাদেশের প্রথিতযশ
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ
প্রাক্তন চেয়ারপারসন , মনোরোগ বিদ্যা বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা
__________________________

পরপর বেশ কজন একাকী মা (single mother) এলো আমার কাছে তাদের সমস্যা নিয়ে।
রুমকি (ছদ্মনাম)। বয়স তেত্রিশ। ঝকঝকে স্মার্ট ইয়াং লেডি। অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়ে। এক শনিবারের বিকেলে আমার চেম্বারে এলো। রুমকি একাকী মা।ছেলের বয়স চার বছর। পারিবারিক ভাবেই বিয়ে হয় তার।বিয়ের পর থেকেই স্বামী এবং স্বামীর পরিবারের বহুরকম অন্যায্য চাহিদার মুখোমুখি হতে হয় রুমকিকে।স্বামী সংসারের কোন খরচ দিত না, শারীরীকভাবে অসুস্থ থাকতো প্রায়ই। এক পর্যায়ে পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমেই বিচ্ছেদ হয়ে যায়। বিবাহবিচ্ছেদের পর থেকে রুমকিকে তার আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে অনেক রকম বিরুপ মন্তব্যের মুখোমুখী হতে হয়। এমনকি তার বাবাও বলেন যে রুমকিকে নিয়ে তিনি লজ্জিত এবং আত্মীয়স্বজনের মুখোমুখী হতে পারেন না। নামকরা ইংরেজী মাধ্যমের স্কুলগুলো রুমকির ছেলেকে ভর্তির ব্যাপারে আপত্তি জানায়। বিভিন্ন রকম সামাজিক হয়রানির শিকার হতে হয় রুমকিকে।
রুমকির জীবনের গল্প শুনে একটা কবিতার পংতি মনে পড়লো- “I talk to God but the sky is empty”। কবি সিলভিয়া প্লাথের এই বানীটির মধ্যকার গভীর একাকীত্বের মতোই কি একাকী মায়েদের জীবন? সব ক্ষেত্রেই কি শূন্যতা সঙ্গী হয় তাদের?
কারা একাকী মা? বিধবা, বিবাহবিচ্ছেদ হওয়া এবং অবিবাহিত মায়েরা হচ্ছেন একাকী মা।
একলা মায়েরা প্রায়শ:ই নিঃসঙ্গ,বিষন্ন,চাপগ্রস্ত থাকেন। বাধ্য হয়েই তাদের অতিরিক্ত কাজের চাপ নিতে হয়। সেই সাথে আরো বিভিন্ন রকম সমস্যা আছে তাদের জীবনে।নিজেদের আবেগ অনুভুতিকে যেমন তাদের নিজেদেরই সামলাতে হয় তেমন একই সাথে যত্ন নিতে হয় সন্তান এবং আত্মীয়স্বজনের আবেগ অনুভুতির।আর্থিক সমস্যা,সন্তানের আচরনগত সমস্যা, এবং সমাজের বিভিন্নরকম অবজ্ঞা,অবহেলা,হয়রানি এসবও তাদেরকে মোকাবেলা করতে হয়।
সাম্প্রতিক গবেষনা এবং গনমাধ্যমের রিপোর্ট অনুযায়ী দেখা গেছে ঢাকা শহরে একাকী মায়ের সংখ্যা দিনে দিনে বেড়ে চলেছে। ঢাকার দুই অংশের সিটি কর্পোরেশন তালিকা অনুসারে দেখা যায় নারীদের বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে।গনমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে বিবাহবিচ্ছেদের হার আশংকাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।স্ত্রীরা বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন করছেন স্বামীর শারীরীক এবং মানসিক নির্যাতনের অভিযোগে এবং স্বামীরা অভিযোগ করছেন স্ত্রীর ‘অবাধ্যতা এবং উচ্ছৃংখল জীবনযাপনের’। সিটি কর্পোরেশনের তথ্য অনুসারে ২০১১ সালে মোট বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন ৫,৩৮২টি এবং তার মধ্যে স্ত্রীর আবেদন ৩,৪৪৪টি এবং ২০১৩ সালে বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৬,৮৮০টি।
সারা বিশ্বেই বিবাহবিচ্ছেদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।পাশ্চাত্য সমাজে বিবাহবিচ্ছেদ এবং পুনর্বিবাহ জীবনের স্বাভাবিক অংশ হিসেবে দেখা হলেও এশিয়ার বেশির ভাগ দেশেই বিবাহবিচ্ছেদ অথবা স্বামী-স্ত্রী আলাদা থাকা অত্যন্ত নেতিবাচক কাজ হিসেবেই গন্য করা হয়।
নারীরা এখন শিক্ষায় এগিয়ে যাচ্ছেন। কর্মক্ষেত্রেও তারা অত্যন্ত দক্ষ।ভালো অংকের পারিশ্রমিকও পাচ্ছেন। এ সবের পরিপ্রেক্ষিতে নির্যাতিত স্ত্রীদের অনেকেই মনে করেন না যে তাদের চেয়ে ‘শক্তিশালী’ কাউকে তাদের দেখাশোনা করতে হবে- ফলে স্বামীর থেকে আলাদা হওয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন।
এবারে জানা যাক বিবাহ বিচ্ছেদের কারন কি? কারন হিসেবে পাওয়া যায়ঃ শারীরীক, যৌন এবং মানসিক নির্যাতন, স্বামীর মাদকাসক্তি, ব্যক্তিত্বের ভিন্নতা, শ্বশুর বাড়ীতে শত্রুভাবাপন্ন অবস্থা, আর্থিক সমস্যা, যৌন জীবনে অসঙ্গতি, ভালোবাসাহীনতা, সাংস্কৃতিক এবং জীবনযাপনের ধারায় ভিন্নতা, মানসিক টানাপোড়েন অথবা মানসিক রোগ,বিয়ে সম্পর্কটির প্রতি অঙ্গীকার বা দায়িত্বশীলতার অভাব,সন্তান ধারন এবং লালনপালনে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গী, পিতামাতা অথবা পরিবারের অন্যদের হস্তক্ষেপ, প্রথাগত দৃষ্টিভঙ্গীতে আটকে থাকা এবং নারীদের কোন ব্যক্তিগত মতামতের উপস্থিতিকে উপেক্ষা করা ইত্যাদি।
একক অভিভাবকত্ব (single parenting) একটা বড় চ্যালেন্জ। সব ধরনের সুযোগসুবিধার উপস্থিতি থাকা সত্ত্বেও প্যারেন্টিং একটি কঠিন বিষয়। সেই জায়গায় একা সন্তান লালন পালন করতে গেলে প্রতিকূলতা কয়েকগুন বৃদ্ধি পায়।তাই একক অভিভাবকত্বের দ্বায়িত্ব নিয়ে মায়েদের অপরিমেয় প্রতিকূলতার মুখোমুখী হতে হয়।অতিরিক্ত কাজের চাপ, গৃহস্থালীর কাজ, আবেগগত চাপ, আর্থিক সমস্যা একজন একলা মাকে নিজেই সামলাতে হয়।
একাকী মায়ের উপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে সেটা বলাই বাহুল্য।
সন্তান লালন পালনে বাবা মা দুইজনকেই অনেক ধরনের আবেগগত সংকটের মোকাবেলা করতে হয় এবং সন্তানের আবেগগত চাহিদার প্রতি সচেতন থাকতে হয়।একজন একাকী মাকে তার নিজের এবং সন্তানের আবেগগত চাহিদা পূরনে সবসময় প্রস্তুত থাকতে হয়। বিভিন্ন প্রতিকূলতার সাথে একা একা যুদ্ধ করে একাকী মা হয়ে পড়ে নিঃসঙ্গ, বিষন্ন, এবং উদ্বিগ্ন। একক মায়েদের মধ্যে প্রায়ই নানারকম অসুস্হতাও দেখা যায়।একক অভিভাবকত্বের চাপ এবং তার ফলশ্রুতিতে শারীরীক,মানসিক নেতিবাচক প্রভাবের ফলাফলস্বরূপ তাদের মৃত্যু ঝুঁকিও বেড়ে যায়।
সন্তানদের উপরও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।একাকী মায়েদের বিভিন্ন সমস্যা তাদের সন্তানদের মধ্যেও সমস্যা তৈরী করে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়-সমাজ বিরোধী কার্যকলাপ, আগ্রাসী আচরন, উদ্বিগ্নতা, বিষন্নতা, স্কুলে সমস্যা, স্কুলে অনুপস্থিতি, স্কুল থেকে ঝরে পড়া (এই ক্ষেত্রে মেয়েদের তুলনায় ছেলে সন্তানদের বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে দেখা যায়), উচ্চশিক্ষা গ্রহন না করতে পারা, আর্থিক এবং মানসিক অসুবিধা, অপরাধ মূলক কার্যক্রম, মাদকাসক্তিতে জড়িয়ে পড়া, স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিভিন্ন অসুবিধা ইত্যাদি।
Weitzman ১৯৮৫ সালের গবেষনায় দেখান এমনকি পাশ্চাত্যেও দেখা যায় বিবাহবিচ্ছেদ হওয়া মায়েদের সন্তানদের স্বাস্থ্যবীমাসহ জীবনের গুনগত মানের অবনতি হয়। এই অবস্হাকে তিনি বলেছেন "feminization of poverty“ (Weitzman IJ 1985)।

এ বিষয়ে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গী কি?
তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে একলা মায়েরা সামাজিক ভাবে কোনঠাসা হয়ে পড়েন।একলা মায়েদের সমাজে নিচু ভাবে দেখা হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে বিধবা নারীদেরকে সম্পত্তির উত্তরাধিকার দেয়া হয়না। অন্যান্য সাহায্য থেকেও প্রায়শই তাদের বন্চিত করা হয়।
বিচ্ছেদ হওয়া পরিবারকে ("broken families” - বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে যেই শব্দটা প্রায়ই ব্যবহার হয়) সামাজিক নিয়মের প্রতি হুমকি হিসেবে দেখা হয়। বিভিন্নরকম সামাজিক অমর্যাদারও শিকার হন তারা।আগে পরিবারের সদস্য হিসেবে একা একজন নারী (সন্তানসহ অথবা সন্তান ছাড়া) পরিবারের যত্ন পেতেন, নগরায়নের ফলে পারিবারিক কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়ায় সেটাও এখন কমে এসেছে।পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীরা পারিবারিক সীমিত সম্পদ ব্যবহার করার ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হন।আর্থিকভাবে অসচ্ছল পরিবারে পুরুষ সদস্যদের তুলনায় এ কারনে নারীরা আরো বঞ্চনার শিকার হন।
ঢাকা শহরের একাকী মায়েদের বিষন্নতা, উদ্বিগ্নতা এবং মানসিক চাপের উপস্থিতি এবং তীব্রতা সংক্রান্ত সাম্প্রতিক সময়ে চলাকালীন একটি গবেষনার উপাত্ত পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে গবেষনায় অংশগ্রহনকারীদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় ৩১ থেকে ৪০ বছরের বয়সে একাকী মায়েদের সংখ্যা সর্বোচ্চ(৫৮%), চাকুরীজীবী আছেন ৬৯% ,যা পেশাগত বিবেচনায় সর্বোচ্চ। গৃহকর্মী এবং গৃহিনী ২৭% এবং বেকার আছেন ১৩%। স্বামী থেকে পৃথক আছেন ৩৩%, বিবাহ বিচ্ছেদ হয়েছে শতকরা ৫৪ জনের এবং বিধবা আছেন ৬৯%। অংশগ্রহনকারীদের মধ্যে বিষন্নতাজনিত রোগ ২৭%, উদ্বিগ্নতাজনিত রোগ ৩৩%, বিষন্নতা এবং উদ্বিগ্নতা এক সাথে আছে শতকরা ২৪ ভাগের। মানসিক চাপের তীব্রতা মৃদু, মাঝারী এবং তীব্র আছে যথাক্রমে ২২%, ১৬% এবং ৬% এর। যেসব অসুবিধার মুখোমুখী হতে হয় তার উত্তরে পাওয়া গেছে ক্রমানুসারে অতিরিক্ত কাজের চাপ, আর্থিক সংকট এবং সামাজিক হয়রানী। সন্তান লালনপালন,আবেগগত সহায়তা এবং আর্থিক সহযোগীতা প্রতিটি ক্ষেত্রে নিজের পরিবার অন্তত তিনগুন বেশী সহায়তা দিয়ে থাকে স্বামীর পরিবারের চেয়ে। যদিয়ো বেশীর ক্ষেত্রেই এই সহায়তা মোটেও সন্তোষজনক নয়।সন্তানদের মধ্যে সমস্যা পাওয়া গেছে বিষন্নতা, উদ্বিগ্নতা, আত্মবিশ্বাসের অভাব,পড়ালেখার মানে অবনতি,স্কুলে বিদ্রুপের শিকার হওয়া, আচরনগত সমস্যা।
প্রয়োজন হলো একলা মায়েদের সন্তান লালন পালনে, আবেগগত , আর্থিক, পারিবারিক-সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে সহযোগীতা, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন, স্বাস্থ্যসংক্রান্ত সমস্যার চিকিৎসা/ব্যবস্থাপনা, শারীরীক এবং মানসিক স্বাস্থ্য সেবা -মা এবং সন্তান উভয়েরই।
একলা মা হিসেবে জীবনের সংকট যেমন গভীর, সামাজিক প্রতিকূলতাও অনেক। এই অবস্থার অস্থায়ী এবং দীর্ঘমেয়াদী/সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়ে মা ও সন্তানের মানসিক এবং শারীরীক স্বাস্থ্যের উপর। যথাযথ সহযোগীতা পেলে এবং সময় মতো চিহ্নিত করে চিকিৎসার আওতায় আসলে একজন একলা মা তার এই সমস্যাগুলোকে মোকাবেলা করে নেতিবাচক প্রভাব থেকে বের হয়ে আসতে পারেন এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য বোঝা না হয়ে বরং তার নির্দিষ্ট ভূমিকা পালন করে দেশ ও সমাজকে যথাযথ অবদান রাখতে পারবেন।

#

আপনার মতামত দিন:


বিএসএমএমইউ এর জনপ্রিয়