Ameen Qudir

Published:
2018-11-27 01:45:27 BdST

মিয়াজিমা দ্বীপ ও ক্যাপসুল হোটেল


 

 


ডা. মোহাম্মদ জোবায়ের মিয়া
________________________________


হিরোসিমার পিস মেমোরিয়ালের বেদনা বিধূর স্মৃতি নিয়ে দুপুর ১ টার দিকে আমরা স্ট্রিট কারে উঠে রওয়ানা দিলাম মিয়াজিমার উদ্দেশে। আগেই বলেছি স্ট্রিট কার হলো ট্রামের মতো। রেল লাইনে চলে। একজন ড্রাইভার এবং একজন এটেন্ডেন্স। বাংলাদেশের বিমান বাহিনীর সদস্যদের মতো ড্রেস এবং ক্যাপ পরা। অতিশয় ভদ্র ভাবে বলে যায় কারো চেঞ্জ লাগবে কিনা। স্থানীয়দের প্রায় সবারই কাড' থাকে। সেটি দরজার কাছে মেশিনে টাচ করলেই দরজা খুলে যায়। আমাদের সেই কার্ড' না থাকায় গন্তব্য অনুযায়ী ইয়েন দিলাম। প্রতিজনে প্রায় ৩০০ ইয়েন হিরোশিমা থেকে মিয়াজিমার ভাড়া। জাপানের সমস্ত বাস, কার, ট্রেন, স্টিট কার(ট্রাম) এসি করা। ভিতরের পরিবেশ ঝকঝকে তকতকে। লোকাল হউক আর দূর পাল্লারই হউক। মনে মনে ভাবলাম, আমাদের দেশটা যদি এমন হতো! রাস্তার দুই ধারে দেখলাম ৫ তলার উপর তেমন বাড়ি ঘর নেই। টোকিও এবং হিরোসিমার মেইন সিটিতে হাই রাইজ বিল্ডিং অনেক আছে। মিয়াজিমার পথে বেশ কিছু ফুলের বাগান এবং শষ্য ক্ষেত ও চোখে পড়লো। যায়গাটা একটু উচু নীচু। বাড়ীগুলির বৈশিষ্ট হলো ভূমি অনুযায়ী স্তরে স্তরে সাজানো। এগুলিই নাকি জাপানের গ্রাম। গ্রাম হলেও আধুনিক সব সুযোগ সুবিধা আছে। প্রায় প্রতি বাড়িতেই এসি, ফ্রিজ, গ্যাস, আধুনিক পয়নিস্কাশন ব্যবস্থা রয়েছে। ২.৩০ মিনিটে আমরা মিয়াজিমা স্টেশনে পৌছালাম। তারপর ৫ মিনিটের হাটা পথে সুন্দর এক নদীর ঘাটে আসলাম। সেখানে এসে বুঝলাম এটি টোরিস্ট স্পট। অনেক স্কুল কলেজের ছেলে মেয়েরা এসেছে ফেরী পার হয়ে আরেক ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ মিয়াজিমার Floating Shirin দেখতে যাবে। দুইজন জাপানিজ তরুনী ইউনিভার্সিটির ছাত্রী পরিচয় দিলো। তাঁরাও হিরোশিমা সিটি থেকে এসেছে মিয়াজিমা দ্বীপে ভ্রমণের জন্য। একই ফেরীতে যাবে। আমাদের পরিচয় পেয়ে খুশীতে সেলফি তুললো। আমরা আবারো বেশ কিছু ছবি তুলে নিলাম। তারপর একসাথে ফেরীতে উঠলাম।ফেরীঘাট এতো পরিচ্ছন্ন হতে পারে না দেখলে বিশ্বাস হবেনা। আমাদের JR Pass এখানেও কাজে লাগলো। সেটি দেখাতেই ফেরীতে উঠতে দিলো। সেখানে বেশ কিছু সাদা চামড়ার ছেলে মেয়ে দেখলাম। তাদের কয়েকজন এর সাথে কথা হলো। ওঁরা সামার ভেকেশনে দল বেঁধে বেড়াতে এসেছে। ১৫ মিনিট পর পর ফেরী ছাড়ে। ফেরী থেকে অপরুপ দৃশ্য দেখতে লাগলাম। আমি আর সাঈদ ভাই একে অপরের ছবি তুলছি। মাঝ নদীতে যখন আসলাম তখন আরো ভালো লাগলো। এই পারের শহরকে মনে হলো পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে সুন্দর সাজানো বাড়ি ঘর। ঔ পারে সবুজ, সোনালী পাতার গাছপালায় ঘেরা সুন্দর মিয়াজিমা দ্বীপ। পারের কাছা কাছি এসে দেখতে পেলাম সেই ফ্লোটিং সিরিন। পটা পট ছবি তুলে নিলাম। মিয়াজিমা নেমেই দেখতে পেলাম লোকালয়ে হরিণ ঘুরছে। অনেকটা অভয়ারণ্যের মতো। টোরিস্টগন ছবি তুলছে। আমরাও তুললাম। এবার বেলা ৩ টা বেঁজে গেছে খুধাও লেগে গেছে। দুইজনে নদীর ধার দিয়ে হাটতে হাটতে দেখলাম। অনেক সূভেনূর শপ। মাঝে মাঝে খাবার দোকান। এক দোকানে ঢুকে মেন্যু দেখলাম। রাইস উইথ ওয়েস্টার কারি (ঝিনুক)। সাথে সাঈদ ভাইয়ের প্রিয় জাপানিজ কোক। জীবনে প্রথম ঝিনুক খাওয়া! ৪ টার মধ্য ২ টার বেশী খেতে পারলাম না। কেমন জানি গলায় তিতা লাগে। ক্ষুধার জ্বালায় গিলে ফেললাম। আরো ঘন্টা খানি সেই দ্বীপে ঘুরে ফেরীতে উঠে পড়লাম। গন্তব্য হিরোসিমা রেল স্টেশন।

 

ক্যাপসুল হোটেল

ক্যাপসুল হোটেল


২.
মিয়াজিমা দ্বীপ থেকে ফিরতি পথে আবারো ফেরী পার হয়ে স্ট্রিট কারে হিরোশিমা রেল রেলস্টেশনে পৌছাতে আমাদের সন্ধ্যা সাতটা বেঁজে গেল। ইনফরমেশন এ খোঁজ নিয়ে দেখি JR Pass (Japan Rail Way Pass) দিয়ে যে বুলেট ট্রেনে টোকিও ফেরার কথা সেটি বিকাল ৫.৩০ টায় লাস্ট ট্র্বেন ছেড়ে গেছে। তার মানে আমরা ট্রেন মিস করেছি! এখন কি হবে! দুইজনে প্রথমে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলাম। সেদিন ছিল ১৮/১০/১৮ তারিখ। একটা লস হলো, হোটেল রেডিসন এ রুম নেওয়া আছে দুইজনের জন্য বেশ চড়া দামে। তারপরের দিন ১৯/১০/১৮ কনফারেন্সে প্রজেন্টেশন বিকাল ৪.৩০ মিনিটে। যে করেই হউক ৩ টার মধ্যে নারিতায় পৌছাতে হবে। একটু ধাতস্থ হয়ে স্টেশনে খোঁজ নিলাম আর কোন বুলেট ট্রেনে নারিতায় যাওয়া যায় কিনা? ভাড়া কত লাগবে? বললো প্রতিজনে ১৮০০০ ইয়েন লাগবে। রাত ১০.৩০ মিনিটে ট্রেন ছাড়বে। ঈনাম ভাই হিরোশিমায় প্রথমে আসতে চাননি। তিনি বললেন, আমি আগেই বলেছিলাম এতদূর আসলে একটা ঝাঁমেলা হতে পারে। দেখলেন তো! এই নিয়ে দুইজনের মধ্যে মৃদু বাক বিতন্ডা হলো। আমি বললাম ঘাবড়াবেন না। দুই জন মানুষ আছি কোন বিপদ এই জাপানে হবেনা ইনশাআল্লাহ। একটু এডভেঞ্চার না হলে ভ্রমণে আনন্দ কি? চিন্তার কারন ছিল হিরোসিমায় সেই রাতের হোটেল বুকিং ছিলোনা। আরেক টি কারন আমরা JR Pass কিনেছিলাম আন লিমিটেড ভ্রমণের জন্য। কিন্ত সেটার নিদি'ষ্ট ট্রেন যে বিকাল ৫.৩০ শেষ ট্রিপ এটা জানা ছিলোনা। এখন দুইজনে ৩৬০০০ ইয়েন বাড়তি ভাড়া দিয়ে টোকিও যেতে হবে ভোর রাতে। বিকল্প চিন্তা মাথায় এলো। আমরা যদি কম ভাড়ার হোটেলে আজকের রাতটা আবারো হিরোশিমায় থাকি তবে JR Pass দিয়ে ভোরের বুলেট ট্রেনে সহজেই আগামীকাল দুপুর ৩ টার আগেই নারিতায় কনফারেন্স এ এটেন্ড করতে পারবো। এতে ট্রেনের বাড়তি ভাড়াও গুনতে হবেনা। একটা রাত হিরোশিমায় বেশী কাটানো যাবে। স্টেশনের পাশের মেইন রোডে একটি হোটেল দেখতে পেয়ে রিসিপশনে গেলাম। কামরা খালি আছে কিনা জিজ্ঞেস করলাম। জাপানী রিসেপসনিস্ট লোক টি মাথা দুই পাশে দুলিয়ে বললো সরি অল বুকড।এবার নেটে সার্চ দিলাম হোটেল নিয়ার হিরোশিমা স্টেশন। ৪ কিলো দূরে একটি হোটেলের কামরা খালি পাওয়া গেলো। আগের রাত যেই হোটেলে ছিলাম সেই টোকাইচিমাচি এলাকাতেই হোটেলের নাম" কাওয়াটিয়া "। আবারো স্ট্রিট কারে গুগল ম্যাপ দেখে স্থানীদের সাহায্য নিয়ে রাত ৯ টায় পৌছে গেলাম হোটেল কাওয়াটিয়ায়। এটা আগের হোটেল থেকে ভিন্ন ধরনের গেটেই লাল গেঞ্জি পরিহিত দুইজন স্টাফ আমাদের আভ্যথ'না জানালো। তাঁরা জানতো আমরা রাত ৯ টা নাগাদ আসবো। সেটি অন লাইন বুকিং করার সময় উল্লেখ করতে হয়েছিল। পাচ তলা হোটেলের নীচে দেখলাম কাঠের কারুকাজ করা চেয়ার টেবিল পাতা আছে। সেখানে বসে লোকজন ডিনার করছে। এটি হোটেলেরই রেস্টুরেন্ট। মৃদু মিউজিক বাঁজছে। পাশের করিডোর দিয়ে হোটেলে উঠার সিড়ির কাছে রিসেপসশনে নিয়ে গেল। ম্যানেজার বললো আর ইউ মিয়া? আমি বললাম ইয়েস। সে বললো তোমরা যে রুম বুকিং দিয়েছো সেটি আসলে ফ্যামিলি রুম। পাশেই কয়েকজন ফিমেল গেস্ট থাকবে। সমস্যা হলো শেয়ার বাথরুম ইউজ করতে হবে। সে বললো ইট ইজ আ বিগ প্রব্লেম। লেটস সি হুটাট ক্যান উই ডু ফর ইউ। সে ইংরেজীতে বেশ চালু। আসলে তাড়াহুড়ো এবং টেনশনে নেটে বুকিং দেওয়ার সময় আমরা খেয়াল করিনি যে সেটাতে ফিমেল সাইট খালি আছে কথাটি লিখা ছিল। আমরা দুইজনে লজ্জাই পেয়ে গেলাম। ম্যানেজার অতিশয় ভদ্রতায় বললো তোমরা দুইজনে ডরমিটরি তে থাকতে পারবে ভাড়া এই বুকিং দেওয়া রুমের ৫০% কমে পাবে। ৩০০০ ইয়েন প্রতিজনে। আমরা রাজী হয়ে গেলাম। যাক বাবা, ফিমেল সাইটে থাকতে হলোনা। লাগাজসহ আমাদেরকে ৪ তলায় নিয়ে গেল। সেখানে দেখলাম আরেক বিস্ময় অপেক্ষা করছে। এক ইউরোপীয় আংকেল সিড়ি বেঁয়ে কাঠের ছোট কুঠুরির মতো রুম থেকে নীচে নামছে। সে বেশ রসিক, নেমেই আমাদের সাথে হাত মিলিয়ে বললো ইয়াং ম্যান, উই উইল এনজয় টু নাইট ইন দিস ক্যাপ্সুল রুম। আমরা না হেঁসে আর পারলাম না! একটি রুমে উপর নীচে দুইটি করে কাঠের বাক্সের নাম ক্যাপসুল। বসা যাবে কিন্ত দাঁড়ানো যাবেনা। সিড়ি দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে উপরেরটায় উঠতে হবে। এরকম একটি রুমে ৮ টি ক্যাপসুল আছে। তারমানে আটজন থাকতে পারবে। ক্যাপসুলের আয়তন লম্বায় ৮ ফুটের মতো। উচ্চতায় ৪ ফুটের মতো। সেখানে ধবধবে গদির বিছানা, চাদর, বালিশ সাজানো আছে। সামনের অংশে ট্রেনের সাটারের মত পর্দা'র ব্যবস্থা আছে। মোবাইল চার্জ' দেওয়ার ব্যবস্থাও আছে। ডিম লাইট আছে। হাতের কাছে সুইচ ও আছে। আমার এবং সাঈদ ভাইয়ের ক্যাপসুল পাশাপাশি দুইতলায় ছিলো। প্রথমে ক্যাপসুলের ছবি তুলে নিলাম। তারপর নীচে রেস্টুরেন্ট এ খেতে নামলাম। ক্যাপসুলের সামনের ফ্লোরে লাগেজ এবং কাপড় ঝুলানোর ব্যবস্থা আছে। পাশেই অত্যাধুনিক টয়লেট। নীচে সাওয়ার রুম এবং সারিবদ্ধ আধুনিক বেসিন, টয়লেট্রিজ রাখা আছে। হোটেলের খাবারটা বেশ মজার ছিল। নারিকেল দিয়ে রাইস এবং কিউব করে কাটা কাবাবের মতো মুরগীর মাংস। খেতে মিস্টি মিস্টি লাগছিল। সাথে জাপানিজ মিক্সড ফ্রটের পানীয়। মিনারেল ওয়াটারের দাম ৫০০ মিলি ৩০০ ইয়েন। ফ্রুট ড্রিংকস ৪০০ ইয়েন। তাই পানির বদলে বেশির ভাগ সময় ফ্রুট ড্রিংকস ই পান করেছি। ওঁদের খাবারে ভেজাল নাই এটা ১০০ ভাগ নিশ্চিত।খাবার খেয়ে কোন সমস্যাও হয়নি। খেয়ে দেয়ে ফ্রেস হয়ে ক্যাপসুলে উঠে পড়লাম। পদা' লাগানোর পর কবরের মতো অনূভূতি এলো। যদিও এসি চলছে নিশ্বাসের সমস্যা নাই। সিকিউরিটির সমস্যা নাই। তবুও একটু দম বন্ধ ভাব লাগলো। সেটা কাটানোর জন্য পাশের কাঠের পারটিশনে সাঈদ ভাই এর ক্যাপসুলে মৃদু নক করলাম। বললাম ভাই ঘুমিয়েছেন নাকি?বললো নাহ! সারাদিনের তোলা ছবি দেখছি। আমি বললাম খারাপ লাগছে নাতো? সে বললো প্রথমে একটু কেমন জানি লাগলো। এখন ঠিক আছি। আপনার কি অবস্থা? আমি বললাম আপনার মতোই। সকাল ৬ টার এলার্ম দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে উঠে আরেক অভিজ্ঞতা হলো। যেহেতু কম খরচের হোটেল। তাই শাওয়ার নিতে মেশিনে ১০০ ইয়েন এর কয়েন দিলে ১৫ মিনিট গরম/ ঠান্ডা পানি, শ্যাম্পু, শাওয়ার জেল, কন্ডিশনার পাওয়া যাবে। ১৫ মিনিট শেষ হলে পানি বন্ধ হয়ে যাবে। ৩০ সেকেন্ড আগে লাল বাতি জ্বলবে। তাই দুইজনে ঝাঁমেলা এড়াতে একজন ভিতরে ঢুকলে যাতে পানি শেষ হওয়ার আগে প্রয়োজনে আরেকটি কয়েন দেওয়া যায়। তাই বাইরে একজন পাহারায় থাকলাম। তারপর তাড়াতাড়ি বের হয়ে সকাল ৭ টায় হিরোশিমা রেলস্টেশনে বুলেট ট্রেন ধরার জন্য পৌছে গেলাম। স্টেশনেই দুই জনে চিকেন স্যান্ডুইচ এবং কোক দিয়ে নাস্তা সারলাম। জাপানি কোক খেয়ে কোন অস্বস্তি হয়নি। তারপর ৭.৩০ এর বুলেট ট্রেনে চেপে বসলাম টোকিওর উদেশ্যে।৪ ঘন্টা লাগলো টোকিওতে আসতে। সেখান থেকে নারিতা স্টেশন হয়ে হোটেল রেডিসনে। আল্লাহ্ তায়ালাকে শুকরিয়া জানালাম এই জন্য যে দুপুর ২ টায় কনফারেন্স লাঞ্চে যথা সময়ে অংশ নিতে পারলাম।
......চলবে

_____________________________

ডা. মোহাম্মদ জোবায়ের মিয়া
সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান
মনোরোগ বিভাগ
শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ, গাজীপুর।

আপনার মতামত দিন:


ভ্রমণ এর জনপ্রিয়