Ameen Qudir

Published:
2018-11-25 23:12:49 BdST

একপাশে ধ্বংসলীলার হিরোশিমা: অন্যপাশে স্মৃতিময় সুন্দর পরিপাটি হিরোশিমার ছবি


 

 




ডা. মোহাম্মদ জোবায়ের মিয়া
________________________________

৮/১০/১৮ তারিখ সকাল ৭.৩০ টায় হিরোসিমা শহরের টোকাইচিমাচি এলাকার "কাসুগা রয়োকান" হোটেল থেকে চেক আউট হয়ে গুগল ম্যাপ দেখে নিলাম। পিস মেমোরিয়াল মিউজিয়াম হেঁটে যেতে ৩০ মিনিট লাগবে দেখালো। আমরা হালকা শীতের সকালের মনোমুগ্ধকর হিরোশিমা শহর দেখতে দেখতে হাঁটা দিলাম। পরিস্কার ঝকঝকে প্রশারিত ৪ লেনের রাস্তা। দুইধারে সবুজ, হলুদ, সোনালী পাতায় আচ্ছাদিত বেশ উঁচু উঁচু নাম না জানা গাছপালা। গাড়ি ঘোড়ার ভীড় নেই। নেই মানুষের কোলাহল। হাঁটার জন্য প্রশ্বস্ত লেইন আছে দুইধারে। তখন প্রায় ৮ টা বেঁজে গেছে। কিছু কিছু মানুষজন চলাচল শুরু করেছে। গাড়ী ঘোড়ার আনাগুনাও বেড়ে গেছে। পথের পাশে একটি সেভেন ইলেভেন দোকানে ঢুকলাম কিছু খাওয়ার জন্য। ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের মতো। আমাদের কাছে তখন কয়েকশ ইয়েন আছে মাত্র। প্রথমে সেলস কাউন্টারের ভদ্র মহিলাকে জিজ্ঞেস করে নিলাম ইউ এস ডলারে কেনাকাটা করা যাবে কিনা? আমার কাছে ক্রেডিট কার্ডও রেখেছিলাম। যেটি দিয়ে বিমান বন্দরে ট্রাঞ্জিটের সময় খুধা নিবারন করেছি। যেকোন দেশেই ব্যবহার করা যায়। বেশ কাজে লেগেছিল। কিন্ত সেই দোকানে শুধু ইয়েনে কেনাকাটা করা যায়। দোকানী নিজেই লজ্জিত হয়ে বললো সরি ইয়েন প্লিজ! কি আর করা! দুইজনের পকেট, সাইড ব্যাগ হাতরে কয়েনসহ হাজার খানি ইয়েন পাওয়া গেল। খাবারের তাকে ঝুলন্ত কাঠি কাবাবের মতো তবে সাইজে অনেক বড় আলু মিক্সড চিকেন ফ্রাই নিলাম ২ টা। ওভেনে গরম করে দিলো। সাথে সাঈদ (Dr-Muhammad Sayed Inam Walid)ভাই এর পছন্দের জাপানি কোক দিয়েই সকালের নাস্তা সারলাম। খেতে বেশ! ওদের সব খাবারই যেন মুখে দিলে নরম মনে হয় তবে ক্রিসপি। এবার ডলার ভাংগানোর পালা। কিছু ইংরেজী কিছু ইশারায় একজন পথচারি কে মানি এক্সেঞ্জ/ ব্যাংক কোথায় বোঝানোর চেস্টা করলাম। আগেই বলেছি ওরা উপকার করার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে। যদি বিদেশী কেউ কিছু জানতে চায় তবে তাঁর সেই প্রশ্নের উত্তর সঠিক ভাবে না দেওয়া পর্যন্ত ওদের কাজে দেরী হলেও যায়না।

এক মাঝ বয়সী জাপানিজ ভদ্রমহিলাকে বিনয়ের সাথে সহজ ইংরেজীতে বললাম। এক্সকিউজমি, ইজ দেয়ার এনি ব্যাংক ওর মানি এক্সচেঞ্জ ফ্রম ডলার টু ইয়েন? দেখি মাথা ঝাকায়। বুঝেনা। তখন ডলার পকেট থেকে বের করে আরেক হাতে ইয়েন দেখিয়ে ইশারায় বুঝানোর চেস্টা করলাম। তখন সে চোখ বড় বড় করে হিরোসিমা ব্যাংক এর দিকে ইশারায় তাঁর পিছে পিছে হাটতে বললো। রাস্তা পারা পারের কায়দা কানুনও ওঁনার কাছে শিখছিলাম। কখনো আন্ডারগ্রাউন্ড দিয়ে রাস্তার ওইপারে যেতে হচ্ছে। এই ভাবে ১০ মিনিট পথ সে আমাদের সাথে আসলো হিরোশিমা ব্যাংকের সামনে। কিন্ত সেই দিন ভোগান্তি কপালে ছিল।

টোকিওতেই সব ডলার ভাংগালে ভালো হতো! ব্যাংক রিনোভেশন হচ্ছে তাই কায্য'ক্রম বন্ধ। আমাদের চেয়ে জাপানিজ আন্টি বেশী চিন্তায় পড়ে গেল। তখন সে আরেকটি সুন্দরী অফিসগামী স্মার্ট তরুণীকে জাপানিজ ভাষায় আমাদের সমস্যার কথা বললো। সে বেশ সপ্রতিভ মনে হলো। সে সুন্দর ইংরেজিতে আমাদের বললো সমস্যা নাই। মানি এক্সেঞ্জ কাছেই আছে ৫ মিনিটের পথ। আমি তোমাদের সাথে নিয়ে যাচ্ছি। আমরা ভদ্রতার খাতিরে তাকে বললাম তোমার অফিসে দেরী হয়ে যাবেনা তো? সে সুন্দর হাসি দিয়ে বললো তোমরা আমাদের মেহমান। সূদুর বাংলাদেশ থেকে এসেছো। আমরাও বললাম জাপান বাংলাদেশ কে অনেক ডোনেট করে। আমরা কৃতজ্ঞ তোমাদের কাছে। ৫ মিনিটেই বেশ সখ্যতা হয়ে গেল। উনি মানি এক্সেঞ্জে পৌছে দিয়ে বিদায় নিলো। মানি এক্সেঞ্জ খুলবে ১০ টায়। তখনো ১০ মিনিট বাকী। কিন্ত ৩ জন মহিলা অফিসার এসে গেছে। আমাদেরকে দেখে বললো। ১০ মিনিট অপেক্ষা করো। ওরা নিজেরাই টেবিল চেয়ার সাজিয়ে কাঁচের ঘরে ঢুকে গেল। নেই কোন দাড়োয়ান, ঝাড়ুদার। ইয়েন পেয়ে খুশীতে ক্যাশিয়ারকে বললাম। কাঁচের এইপার থেকে তোমার সাথে একটি সেলফি তুলতে চাই। সে আনন্দে রাজী হয়ে পোঁজ দিলো।
এবার চললাম হিরোশিমা পিস মেমোরিয়াল মিউজিয়াম দেখতে।প্রতি জনে ২৭০ ইয়েন এন্ট্রেন্স ফি দিয়ে ঢুকলাম সারিবদ্ধভাবে। সেখানে ঢুকেই শোকের আবহ টের পেলাম।

 



জাপানের হিরোশিমা শহরের একটি পরিপাটি আইস্ক্রিমের দোকান, পাশে ফলের দোকান।সামনেই রাখা আছে ভিতরে বড় রিসাইকেল যোগ্য পলিথিন মোড়ানো ডাস্টবিন! আহ! আমাদের দেশটা কবে যে এমন হবে!!

 

হিরোসিমা পিস মিউজিয়ামের নীচ তলায় দেখলাম সেই সময়কার স্টিল ছবি। কারো হাত নেই, পা নেই, চামড়া পুড়ে গেছে। পুরো শহর কালো ধোঁয়া এবং ছাই এর স্তুপ। ১৯৪৫ সালের শেষের দিকের ঘটনা। সেদিন এটম বোমার আঘাতে প্রায় ১৪০০০০ লোক মারা গিয়েছিল। সেখানে রাখা আছে এটম বোমার আঘাতের পর মৃত ব্যক্তিদের গাঁয়ের ক্ষত বিক্ষত জামা, কাপড়, আসবাব পত্র, বাচ্চাদের ব্যবহৃত ধবংস প্রাপ্ত বাই সাইকেল, খেলনা, ঘড়ি ঠিক সকাল ৮.১৫ মিনিটে বন্ধ হয়ে গেছে। বোমার আঘাতের পরবর্তী বিকিরণ জনিত কারনে অনেক লোকের কঠিন এবং দূবি'সহ চম' রোগ, চোখের রোগ দেখা দেয়। তাঁদের ছবিও রাখা আছে। পরবর্তীতে হিরোশিমায় অনেক বিকলাঙ্গ শিশুরও জন্ম হয়। মিউজিয়ামে দুইটি ছবি রাখা আছে পাশাপাশি। একটি বোমার আঘাতের আগের সুন্দর, পরিপাটি করে সাজানো লেকের পাশে গাছপালা সুশোভিত হিরোশিমা শহর, অন্যটি আঘাতের পর ভস্মিভূত ছাই এর শহর। হৃদয় কাড়া একটি কম্পিউটার এনিমেশন সব সময় চলতে থাকে ২য় তলায়। যেখানে দেখা যায় কিভাবে একটি শান্তির শহরে এটম বোমার আঘাতে সব পুড়ে ছাই হয়ে গেল। এই মিউজিয়ামে জাপানের বিভিন্ন শহরের মানুষ ছাড়াও অনেক ইউরোপিয়ান, আমেরিকান এবং আমাদেরমত অল্পসংখ্যক এশিয়ান দের পরিদর্শন করতে দেখলাম। অনেকের চোখেই পানি দেখেছি। আমাদের মন টাও সেই সকল মানুষদের জন্য দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। মিউজিয়ামের একপাশে দেখলাম। সেই সময়কার প্রত্যক্ষ দশী' কয়েকজনের রেকর্ডকৃত সাক্ষাৎকার। জাপানি ভাষায় বলছেন নীচে ইংরেজি ট্রান্সলেশন। এক মহিলার ২ সন্তান এবং স্বামী স্পটেই মারা যায়। সে চোখের পানি ফেলে বললো আমার সংসারটা তছনছ হয়ে গেছে। কেন যে বেঁচে গেলাম। একজন বললো অফিসে কাজ করছিলেন হঠাত প্রচন্ড শব্দ শুনলো। সারা আকাশ লাল হয়ে গেল তারপর সব কিছু কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল। জ্ঞান ফিরলো হাসপাতালে। তার শরীরের কিছু মাংস পুড়ে গেছে।
মন খারাপ লাগা ভাব নিয়ে পিস মেমোরিয়াল পার্কে আসলাম।
সেখানে এসে সুন্দর পরিস্কার মাঠ, সুন্দর গাছপালা বেস্টিত পার্কের বেঞ্চিতে বসে একটু জিরিয়ে নিলাম। সাঈদ ভাই পটা পট ছবি তুলতে লাগলো। আমি একটা ২ মিনিটের ভিডিও নিলাম। কেউ কেউ সাইকেলে, কেউ হেটে হেটে পায়চারি করছে। দূরে দেখলাম মনুমেন্ট এর সামনে একসাথে যারা ঘুরতে এসেছে তারা গ্রুপ ছবি তুলছে। কেউ হাত জোড় করে মাথা ঝুকিয়ে নিরবে দাড়িয়ে থেকে প্রার্থনা করছে। পার্কের এক কোনে দেখলাম শতাধিক হাই স্কুল লেভেলের ছাত্রছাত্রী দাঁড়িয়ে শপথ বাক্য পাঠ করছে। সামনে তাদের শিক্ষক -শিক্ষিকাগন দাঁড়িয়ে আছে। আমরা এগিয়ে গিয়ে তাদের জাতীয় সংগীত শুনলাম। এটাকে চিলড্রেন পিস মনুমেন্ট বলে। এর সামনে নাকি প্রতিদিন বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষার্থীরা এসে সেই সব মৃত শিশুদের স্মরণ করে এবং সততা, সাহসিকতার শপথ নেয়। আমি কয়েকজন শিশুর সাথে কথা বললাম। ওরা ইংরেজি বুঝে। বাংলাদেশী শুনে খুশী হয়ে সেল্ফি তুলতে রাজী হলো। আমাদের বিষাদিত মন মূহুর্তে ভালো হয়ে গেল। লেকের পাড়ে একটি সুউচ্চ ভবনের ভগ্নাংশ দেখলাম। সেটি এটম বোমের আঘাতে মারাত্বক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সেই বাড়িতে অবস্থানরত সমস্ত লোক নাকি মারা গিয়েছিল। সেই স্মৃতি রক্ষায় সেই ভাংগা অবস্থায় আজো বাড়িটি রাখা হয়েছে। এটি ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে । আমাদের প্রিয় সাইকিয়াট্রিস্ট ডাঃ আহমেদ হেলাল ভাইকে ( Helal Uddin Ahmed)আসার আগে বলেছিলাম জাপান যাচ্ছি।আপনিতো আগে গিয়েছিলেন, বিশেষ কি কি দেখার আছে? উনি বলেছিলেন হিরোসিমা এবং মিয়াজিমায় যাবেন অবশ্যই। ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ দেখে আসবেন। তাকে অনেক ধন্যবাদ। সে না বললে আমার হয়তো আসা হতোনা। এসব দেখতে দেখতে দুপুর একটা বেজে গেলো। মিয়াজিমায় যেতে হবে। ২ ঘন্টা লাগবে। সেই দিনই টোকিও ফেরার ইচ্ছা ছিল তাই হাটা দিলাম স্টেশনের দিকে। চলবে
____________________________

ডা. মোহাম্মদ জোবায়ের মিয়া
সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান
মনোরোগ বিভাগ
শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ, গাজীপুর।

 

আপনার মতামত দিন:


ভ্রমণ এর জনপ্রিয়