Ameen Qudir

Published:
2018-10-28 19:23:49 BdST

আরিগাতো গুজায়মাছ :জাপানিরা মানুষকে মানুষ মূল্যায়ন করা শেখে ছোটবেলা থেকেই


 

 

ডা. মো. সাঈদ এনাম
_________________________

লোকাল ট্রেনে নারিতা বিমানবন্দর স্টেশন থেকে ফুনাবাসী স্টেশনে নামলাম। উদ্দেশ্য সেখানে এক বাংলাদেশি ছেলে থাকে তার সঙ্গে দেখা করা ও আমাদের ঢাকা মেডিকেলের এক ব্যাচমেটের সঙ্গে দেখা করা।


মানসিক রোগ বিষয়ে কনফারেন্সে যোগ দিতে সুদূর বাংলাদেশ থেকে জাপান এসেছি, আর যদি নিজ দেশের পরিচিতজনদের সঙ্গে দেখা করে না যাই তাহলে কেমন হবে? তাই দুজনেই সিদ্ধান্ত নিলাম সেশন ও প্রেজেন্টেশন শেষে যত দ্রুত পারি বের হয়ে প্রথমে তাদের সঙ্গে দেখা করবো পরে টোকিও শহরটাকে এক নজর একটু দেখবো।

গত দুদিন জাপান ঘুরতে আমরা কোন গাইড নেইনি। আমি ও ডা. যুবায়ের ভাই একাই ঘুরছি। এখানে চলতে ফিরতে সবাই গুগল ম্যাপ বা যে শহরে ঘুরবেন তার একট ছাপানো ম্যাপ ব্যবহার করে।

কারো কাছে যদি মোবাইল থাকে তাহলে সে গুগল ম্যাপে দেখে নেবে নাহলে রাস্তার মোড়ে বাস স্ট্যান্ড, পুলিশ বা শপগুলোতে ছাপানো ম্যাপ থাকে। ওটা দেখেই আপনি চলতে পারবেন। ম্যাপে প্রতিটি স্থাপনা, অলিগলি নির্দেশিত এবং কোন পথে, কোন বাহনে যাবেন, যেতে কত সময় লাগবে তাও বলা আছে।

স্টেশনে নেমে রাস্তার পাশ দিয়ে হাঁটছি। দুজনের একটু পানির তৃষ্ণা পেলে একটা শপে ঢুকলাম। পানি আর কোক নিলাম, সঙ্গে নিলাম বাদাম ভাজা। ভদ্র মহিলা পানি, ড্রিংকস আর বাদাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন আপনারা কি এখানেই খাবেন, নাকি হাঁটতে হাঁটতে খাবেন?

আমি বললাম, ‘ইচ্ছে ছিল হাঁটতে হাঁটতে খাব, কিন্তু শহরের রাস্তাঘাট এতো পরিচ্ছন্ন, খাবার শেষে এই কোকের ক্যান আর বাদামের প্যাকেট কী করবো?’।

তিনি হেসে বিনীতভাবে বললেন, ‘অহ..! এই কথা? আমি আপনাকে ব্যাগ দিচ্ছি। খাবার শেষে ক্যান আর বাদাম প্যাকেট এই ব্যাগে রেখে দেবেন আর হাঁটতে গেলে কিছুক্ষণ পরপরই দেখবেন ডাস্টবিন রাখা, ওতে আলাদা আলাদা করে ফেলে দেবেন। কোথায় কোকের বোতল আর কোথায় বাদামের প্যাকেট ফেলবেন, সেটা লেখা আছে। যান যান মজা করে খান,..... আরিকাতো গুজাইমাছ‘।

আমিও বললাম, ‘আরিগাতো... আরিগাতো’। দু’দিনে বহুল ব্যবহৃত এ শব্দের সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়ে গিয়েছে।

জাপানে পরিচিত অপরিচিত প্রথম দর্শনে সবাই সবার মুখের দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে হালকা ঝুঁকে বাও করে। বাও করা মানে হলো সম্মান করা বা শান্তি কামনা করা। তারপর বলবে ‘আরিগাতো গুজায়মাছ‘ বা ‘আরিগাতো’।

মানে, ‘তোমাকে অশেষ অশেষ ধন্যবাদ‘।

জাপানেই দেখলাম স্টল বা রেস্টুরেন্টে পুরুষ কর্মীর চেয়ে নারী কর্মী বেশি। ৮০ ভাগই কর্মকর্তা কর্মচারী তরুণী। যেমন স্টলে তেমন রেস্ট্রুরেন্টে। অর্থাৎ এদের ৮০ ভাগ কলেজ ভার্সিটি স্টুডেন্ট। তাদের এটা পার্ট টাইম জব।

এখানে শিশু কিশোর ব্যতীত সবাই কাজ করে। যে ক'দিন ছিলাম কোন শিশু কিশোরকে কাজে পাইনি। একেবারে আশি বছরের বুড়োরাও কাজ করেন। কাজ আলাদা ভাগ করা। রেডিসন হোটেল থেকে প্রতিদিন বের হয়ে আমরা নারিতা এয়ারপোর্টে যেতাম সেটাতে শিফট ওয়াইজ যারা ডিউটি করতেন তারা বেশ বয়স্ক ছিলেন।

একটু শক্ত কাজ তরুণ-তরুণীরা করেন আর হালকা কাজ যেমন শপিংমল বা রাস্তাঘাট থেকে টুকটাক ময়লা কাগজ সংগ্রহ করে জায়গা মতো ডাস্টবিনে ফেলা, পরিচ্ছন্ন রাখা, ড্রাইভিং করা, এ কাজগুলো অপেক্ষাকৃত বয়স্করা করেন।

এক সন্ধ্যায় আমি আর যুবায়ের ভাই হোটেল লনে বসি কফি খাচ্ছিলাম তখন দেখলাম অতিশায় এক বৃদ্ধা মহিলা এসে আমাদের সামনে রাখা ফুলের টবটি একটু মুছে দিয়ে গেলেন, যদিও সেটা মুছা ছিল।

জাপানে ড্রাইভিং মানে কেবল সুইচ, বাটন টিপা টিপি। গাড়িগুলো সবই নতুন আর অটো। রাস্তা, লোকেশন, স্টপেজ গাড়ির সঙ্গে পোগ্রামিং করা।

কোথায় যাবেন, কোথায় থামবেন, কোন স্টপেজ সামনে এগুলো সব সেটিং করা থাকে। একটু পরপর মাইক্রোফোনে অটো বেজে উঠছে। ড্রাইভার সাহেবের কাজ কেবল খেয়াল রাখা আর সময় মতো বাটন চাপা। অনেক বয়স্কা মহিলারা ও ড্রাইভিং পেশায় আছেন। আর এখানের পাবলিক বাসগুলোতে প্রিপেইড কার্ড আছে অথবা বক্স আছে নামার সময় হয় কার্ড টাচ করাবেন বা বক্সে টাকা দিয়ে দিবেন। ভাংতি প্রয়োজন হলে বক্স থেকেই নেবেন, বা এটেন্ডেন্ট আছেন তাকে বললেই হবে। কিছুক্ষণ পরপর তিনি এ মাথা টু ও মাথা হেঁটে যান। তার কাছে ছোট মাইক্রোফোন আছে।

জাপানে কাজের ছোট বড় নেই। সবই সমান। তাছাড়া সবাই সবাইকে অতি সম্মানের চোখে দেখেন। প্রথম দর্শনেই বাও করেন। সেটা প্রধানমন্ত্রী হন বা সাধারন নাগরিক হন কিংবা হন না কেনো একজন পরিচ্ছন্নতা কর্মী। কে কাকে আগে সম্মান দেবে, শুভেচ্ছা জানাবে, এটাই তাদের কাছে মুখ্য, এটাই নিয়ম। এটাই তাদের ছোটবেলা থেকে শিখিয়ে দেয়া হয়।

জাপান বেড়াতে গেলে আপনি যে একজন মানুষ সেটা বোধহয় জীবনে প্রথম মনে হবে। আমাদের দেশে বা আশপাশের দেশগুলোতে কারো কাছে টাকা থাকলেই কেবল তাকে মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়; সে যাইহোক!

জাপানিজরা মানুষকে মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করা শেখে ছোটবেলা থেকেই। সবাই খুব পরোপকারী। মনে হয় একজনকে উপকার করতে পারলেই তার দিনটা সার্থক হলো। এটা যেমন জাপানের সাধারণ মানুষের বেলায় তেমনি জাপানের পুলিশের বেলায়।

ভিজিটর বা ফরেইনার সামনে পড়লে যেচে এসে বাও করবে জিজ্ঞেস করবে, ‘তোমাদের কোন কিছু লাগবে কি? ‘পথ দেখিয়ে দিবো?

অথবা ‘তোমার কোনো সমস্যা হচ্ছে গন্তব্য চিনতে?’।

বাস বা ট্রেনের লাইনে দাঁড়ালে আপনাকে সামনে জায়গা করে দেবে বা অফার করবে।

যে ক'দিন ঘুরেছি মসজিদ মন্দির প্যাগোডা কোথাও চোখে লাগেনি। মাঝেমধ্যে মনেহতো, এরা ধর্মকর্ম করে না তাহলে এতো মনুষ্যত্ব এতো মানবিকতা তারা শিখলো কোত্থেকে?

আমাদের দেশে গলিতে গলিতে, পাড়ায় পাড়ায় ধর্মীয় স্থাপনা, প্রতিষ্ঠান।
___________________________

লেখক: ডা. সাঈদ এনাম, সাইকিয়াট্রিস্ট, উপজেলা স্বাস্থ্য ও প প কর্মকর্তা, সিলেট। মেম্বার ইউরোপিয়ান সাইকিয়াট্রিক এসোসিয়েশন।

আপনার মতামত দিন:


ভ্রমণ এর জনপ্রিয়