Ameen Qudir

Published:
2018-03-06 16:52:41 BdST

"চল সেই বাড়ীটা খুঁজি, যেখানে ছিলাম দিন তিনেক "



ডা. তারিক রেজা আলী
___________________________

এখানে দিনের বেলা আকাশ পরিষ্কার থাকলে রোদ থাকে যথেষ্ট আর রোদ যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ এক আরামদায়ক উষ্ণতায় ভরে থাকে সারা শরীর। যেই সূর্য চলে যায় মেঘের আড়ালে, কত দ্রুত যে শীত নেমে আসে প্রান্তর জুড়ে, নিজে উপস্থিত থেকে অনুভব না করলে বুঝানো কষ্ট। সারাক্ষণ চলতে থাকে মেঘ আর রবিকরের এ খেলা। একবার এ জিতে যায় তো পরেরবার আরেকজন। বিকেলের এরকম এক নরম রোদে গা এলিয়ে বসে আছি। আরামে চোখ বুঁজে আসছে। মনে পড়ছে সেই সব দিনের কথা যখন এই রোদে সারা দিন ধরে ক্রিকেট খেলতাম, খেলা দেখতাম। পিঠ গরম হয়ে যাচ্ছে, পরণের জ্যাকেটটা খুলে ফেলবো কি না চিন্তা করতে করতেই হঠাৎ ঠান্ডা বাতাস বয়ে গেলো, শরীর-মন জুড়িয়ে গেলো ঠিকই কিন্তু একটু পরেই কাঁপুনি লাগলো সারা অঙ্গে। অদ্ভুত মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন শরীর-মন। কোন ব্যস্ততা নেই, চারদিক আক্ষরিক অর্থেই নিস্তব্ধ। মাঝে মাঝে শোনা যায় বুলবুলির তীক্ষ্ণ শিষ অথবা ঘুঘুর ক্লান্ত ডাক। যে হোটেলের বারান্দায় বসে আছি তার চারদিকে পাহাড়ি এলাকা, সবদিকেই উঁচু উঁচু ইউক্যালিপটাস গাছ। আরো আছে আম, কাঁঠাল, নিম।

আছে অসংখ্য ধরণের উজ্জ্বল বর্ণের ফুল। ঝুম বৃষ্টিতে আচ্ছন্ন হয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন 'সমাজ সংসার মিছে সব, মিছে এ জীবনের কলরব'। সেরকমই আচ্ছন্ন হয়ে মন বলছে থেকে যাও এখানে, কি দরকার আবার সেই ইঁদুর দৌড়ের জীবনে ফেরত যাবার। দেখতে থাকি রোদের খেলা, দূরের পাইন বন, আরো দূরে পাহাড়ের উপর ঘর-বাড়ী, কোথাও ধোঁয়া উঠে জানান দিচ্ছে জীবনের উপস্থিতি, মহামতি বুদ্ধের মূর্তি বসে আছে ঠায় একমনে, চরাচর চুপ হয়ে আছে যেন তাঁর ধ্যান না ভাঙে।

সঙ্গিনীর ডাকে আমার ধ্যান ভাঙলো। বললো, "চল সেই বাড়ীটা খুঁজি, যেখানে ছিলাম দিন তিনেক।" সেতো বহু আগের কথা। ১৩ বছর আগে আরেকবার এসেছিলাম বটে কোডাইকানাল, তারপর কত দিন পেরিয়ে গেছে, সে কি আর খুঁজে পাওয়া যাবে? যেদিন গেছে সেদিন কি আর ফিরিয়ে আনা যায়? তিনি নাছোড়বান্দা। অগত্যা কি করা। নিমগ্ন পরাজাগতিক স্বপ্নাবস্থা থেকে ফের লোকালয়ে যাত্রা করতে হলো।

"জায়গাটা ছিল কোডাইকানাল ইংলিশ ক্লাবের কাছে। একেবারে আলাদা আলাদা কয়েকটা কটেজ ছিল। একতলা বাড়ী, প্রতি কটেজে দুটো করে রুম ছিল। এক টা ঘরে ছিল ফায়ারপ্লেস। আমরা আগুন জ্বালিয়ে পাশে বসে অনেক গল্প করেছিলাম। টেলিভিশন ছিল না, তাই পাঁচ বছর বয়সী আমাদের ছেলে কিছুটা বিরক্ত ছিল।" স্মৃতি হাতড়াচ্ছিলেন তিনি। "প্রতিটা বাড়ী ছিল বেশ দূরে দূরে। চারদিকে ছিল শুধু ইউক্যালিপটাস গাছের ঘন বন। বনের ভিতর দিয়ে হাঁটার সময় শুকনো পাতা মাড়ানোর শব্দে চমকে উঠতাম আমরা নিজেরাই," যোগ করলাম আমি। চলে গেলাম কোডাইকানাল ক্লাবের কাছে। একে ওকে কতজনকে শুধালাম, জানেন আপনারা এরকম কটেজ কোথায় থাকতে পারে? সবাই মাথা নাড়ে। এক ছেলে রসিকতা করে বলে তখন তো আমি দশ বছরের বালক ছিলাম, কি ভাবে বলি! বললাম, ডেকে আনো তোমার পিতৃদেব কে। এলেন তিনি। কিছুই বলতে পারলেন না। ধারণা দিলেন, এখান থেকে কিছুটা উপরে উঠে কোডাইকানাল স্কুলের পাশে কিছু বাংলো আছে। খুঁজে দেখুন সেখানে। গেলাম আমরা। বেশ খানিকটা নীচুতে নেমে আবার উঠে এক বাংলোর দেখা পেলাম ঠিকই। কাজ হচ্ছে সে বাড়ী গুলোতে। তবে নিশ্চিত বলতে পারি, এটা সেই কটেজ নয়। মাটি থেকে দুই হাজার মিটার উপরে এটুকু হাঁটতেই হাঁপিয়ে গেছি দুজনেই। শেষে রণে ভঙ্গ দিতে হলো। সঙ্গিনীর ছলছল চোখের দিকে তাকিয়ে শান্তনা দেওয়ার প্রয়াস পেলাম। "মনে আছে সে অনেক দিন আগে আমরা কেরালার কোচিনে গিয়েছিলাম? ভাস্কো দ্য গামার সমাধির পাশে রাস্তায় বিক্রি করছিলো এক বৃদ্ধ কাঠের তৈরি বিভিন্ন উপকরণ। একটা মূর্তি আমার খুব পছন্দ হয়েছিল, চারকোণা সে বস্তুর চারদিকেই আঁকা ছিল একই মূর্তির মুখ। আমি কিনতে চাইলাম, তুমি বললে এখান থেকে নয়, রাস্তার ওপারের ঐ দোকান থেকে কিনে নিবো।" তিনি মাথা নাড়লেন, বললেন, "মনে পড়েছে। ওটা আমরা আর কোথাও খুঁজে পাই নি।

কোচিনের বড় বড় এন্টিক জিনিষের দোকানেও নয়।" সত্যি আমি সে বস্তুটা এখনো খুঁজি। চেন্নাই, দিল্লী, কোলকাতা কোথাও পাই না। আমি জানি এটা প্রকৃতির খেয়াল। প্রকৃতি কখনো পূর্ণতা পছন্দ করে না। অপূর্ণতা থাকবেই। এটাই জীবন। যা একবার হারিয়ে যায় তা খোঁজা বৃথা। শুকনোপাতা মাড়িয়ে আবার উঠতে লাগলাম আমরা। দূরে আমাদের ড্রাইভার অপেক্ষা করছে। সাদা গাড়ীর পাশে সাদা শার্ট পরণে কালো মানুষটাকে লাগছে প্রকৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গের মতো।
___________________________

ডা. তারিক রেজা আলী । সহকারী অধ্যাপক , রেটিনা। বিএসএমএমইউ।

আপনার মতামত দিন:


ভ্রমণ এর জনপ্রিয়