Ameen Qudir

Published:
2016-12-03 15:37:23 BdST

মোহিনী মালদ্বীপ : প্রথম পর্ব


 

 

ডা. মোরশেদ হাসান

_____________________________________

 

 

মালে এয়ারপোর্টের নাম হচ্ছে ইব্রাহিম নাসির ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট। প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম নাসিরের (১৯৬৮ - ১৯৭৮; দশ বছর প্রেসিডেন্ট ছিলেন) নামানুসারে এই এয়ারপোর্টের নামকরণ করা হয়। এয়ারপোর্ট এবং এর সংলগ্ন ভবনগুলো তাঁর সময়ই গড়ে ওঠে। শুধু তা-ই নয় মালদ্বীপের টেলিভিশন, রেডিও ভবন, স্কুল শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি ভাষা করা, ট্যুরিস্ট ইন্ড্রাস্টির নবযাত্রা ইব্রাহিম নাসিরের বিশেষ অবদান। সে সময় মামুন আবদুল গাইউম ছিলেন ট্রান্সপোর্ট মিনিস্টার ও যুক্তরাষ্ট্রে মালদ্বীপের বিশেষ দূত। পরবর্তীতে মামুন আবদুল গাইউমের কাছে তাঁকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছিল এবং দেশ থেকেই নির্বাসিত হয়েছিলেন।
ইব্রাহিম নাসির ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট মূলত একটি দ্বীপ। দ্বীপটির নাম হুলহুলে। ১৯৬০ সালে এয়ারপোর্টটি যাত্রা শুরু করে। এটিকে তখন হুলহুলে এয়ারপোর্ট বলা হত। পরে এর নাম হয় মালে এয়ারপোর্ট ও এখন ইব্রাহিম নাসির ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট। এখান থেকে রাজধানী মালে যেতে হলে সাগর পাড়ি দিতে হবে ধোনি বা ফেরিতে করে। এখানে ফেরি, লঞ্চ বা নৌকাকে দিবেহি ভাষায় 'ধোনি' বলে।
এয়ারপোর্টে চেক ইনের সময় ট্যুরিস্টদের বেশি সময় না লাগলেও বাংলাদেশি শ্রমিকদের প্রচুর সময় লাগে। বাংলাদেশি শ্রমিকদের লাইন বেশ লম্বা। এর মধ্যে পাসপোর্ট, ওয়ার্ক পারমিট ভিসা কার্ড উল্টেপাল্টে দেখা ও আঙুলের ছাপ নেওয়ায় বেশ কিছুটা সময় চলে যায়।
মালে এয়ারপোর্ট বেশ ছোট কিন্তু ছিমছাম। চেক আউট করে লাগেজ নিয়ে বেরিয়ে এসে একটু হাঁটলেই ফেরি ঘাট। এখানে ফেরি বা ধোনি দাঁড়িয়ে থাকে। প্রতি সাত/আট মিনিট পরপরই একটি করে ফেরি ছাড়ে। লাগেজ তুলে দেয় ধোনির লোকজন এবং লাগেজ আপনার পাশে থাকবে না; সেটি ফেরির সামনের দিকে একটি অংশে থাকে। সেই লাগেজের দিকে চোখ রেখে সময় নষ্ট করবেন না; বরং নীল সাগরের দিকে তাকিয়ে নতুন দেশটির সঙ্গে পরিচিত হতে শুরু করুন। এখানে সাধারণত কেউ কারও জিনিসে হাত দেয় না। ফেরিতে আপনার সঙ্গে প্রচুর বিদেশি ট্যুরিস্ট দেখতে পাবেন। ইউরোপীয়ান নারী-পুরুষদের গড়ন বেশ শক্তপোক্ত। ধোনিতে সিট না থাকলে অনেকে দাঁড়িয়ে যায়। সিটে বসা নিয়ে কোনো হুলুস্থূল নেই। একবার একটি সাদা চামড়ার মেয়েকে দেখলাম খুব সহজভাবে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। লোকাল একজন সিট ছেড়ে দিলেও তিনি ভদ্রভাবে প্রত্যাখান করলেন। সহজ কোনো সুবিধা নিতে চান না। শরীরীভঙ্গিতে একটা অনায়াসভাব খেয়াল করে ভালো লাগল। বাইরে মালে রাজধানীর ল্যাম্পপোস্টের আলো দেখা যায়; সাগরের পানিতে ঝিকিমিকি ঢেউ ওঠে। ধোনি দুলে দুলে এগোয়। খুবই স্বল্প যাত্রা। বড়জোর মিনিট দশ হবে।

 


 

 

এয়ারপোর্ট জেটি থেকে ধোনি গিয়ে ভেড়ে রাজধানী মালেতে। ধোনির থেকে আপনার লাগেজ ধোনির স্টাফরাই নামিয়ে দেবে। মালে শহরে নেমেই আপনার প্রথম কাজ হবে ট্যাক্সি ক্যাব পাওয়া। খালি ট্যাক্সি ক্যাবগুলোর ছাদে সবুজবাতি জ্বালানো থাকে। আপনি হাত তুললেই থামবে। মালে শহরের যেখানেই যান ভাড়া ২৫ রুফিয়া। তবে ট্যাক্সিক্যাবে সিট খালি থাকলে আপনার অনুমতি নিয়ে বা অনুমতি না নিয়েও অন্য যাত্রী তুলে নেয়। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এখানে প্রতিদিন শত শত ট্যুরিস্ট আসে অতএব এদের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি খুবই ভালো। জনগণ আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আপনার কাজ হল একটি পছন্দের হোটেলে ওঠা। এ ব্যাপারে আগে থেকে বুকিং দিলে ভালো অথবা জানাশোনা থাকা ভালো।
মালদ্বীপের রাজধানী মালে শহরের এরিয়া হচ্ছে মাত্র ৫.৮ বর্গ কিমি (২.২ বর্গ মাইল)।
এই শহরে মানুষ বসবাস করে ১৩৩,৪১২। মালদ্বীপের মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ বসবাস করেন রাজধানী মালেতে। কারণ দ্বীপগুলোতে উচ্চ শিক্ষার অপ্রতুলতা এবং সরকারি চাকরির সংখ্যা খুবই কম। আর আছে প্রচুর বাংলাদেশি শ্রমিক। প্রায় একলক্ষ বাংলাদেশি শ্রমিক মালদ্বীপে কাজ করেন। এর মধ্যে ত্রিশ হাজার বাঙালি আছেন মালেতেই। রাজধানী মালের যে কোনো রাস্তায় হাঁটলে ডানে-বামে বাংলায় কথা বলা বাংলাদেশি শ্রমিকের দেখা আপনি পাবেনই।

মালদ্বীপে বাসযোগ্য প্রতিটি দ্বীপেই বাংলাদেশি শ্রমিকরা কাজ করছেন। বাংলাদেশিরা মাছ ধরা, কৃষি কাজ ও ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট মেরামতসহ অবকাঠামোগত উন্নয়ন, অফিস-আদালত, দোকান, বাসা-বাড়িতে কাজ, গাড়ি ও ধোনি (নৌকা) চালনা ছাড়াও হোটেল, রেস্তোরাঁ ও রিসোর্টে কাজ করেন। সাধে তো আর কেউ প্রচুর বিদেশি নিজের দেশে রাখে না। বাংলাদেশিরা এদের অর্থনীতিকে মজবুত করে দিচ্ছে রক্ত পানি করা পরিশ্রমে আর বছরের পর বছর স্বজনদের চেহারা না দেখে।
মালদ্বীপের অনেক দ্বীপে কোনো মানুষ বসবাস করে না। এমন অনেক দ্বীপে বালির ওপরে কৃষিকাজ করা হচ্ছে। বাংলাদেশি শ্রমিকেরাই মূলত মালদ্বীপের দ্বীপগুলোতে প্রথম কৃষি কাজ শুরু করেন। সেখানে বাঁধাকপি, কুমড়া, বেগুন, মরিচসহ অন্যান্য শবজি ফলাচ্ছে বাংলাদেশিরা। সূর্যের প্রচণ্ড উত্তাপ থেকে রক্ষা করতে ক্ষেতগুলো কালো রঙের জাল দিয়ে ঘেরাও থাকে। আর আছে প্রচুর ভীমা ভীমা মশা। এসবের মধ্যেই বাংলাদেশি শ্রমিকেরা মাসিক গড়ে পনেরো হাজার টাকায় কাজ করেন।
মালে শহর থেকে ট্যুরিস্টরা মূলত তাঁদের পছন্দনীয় দ্বীপের রিসোর্টে চলে যান। আর মালে শহর যদি কেউ ঘুরতে চান তবে আগেই বলেছি এটি খুব ছোট শহর।

 

 

রাজধানী মালেতে হুকুরু মসজিদটি খুব বিখ্যাত ও প্রাচীন মসজিদ। এটির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে মরক্কো থেকে আগত ইউসুফ আল বারবারির নাম যিনি মালদ্বীপের মানুষকে ১১৫৩ সালে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেন। এর সামনেই রয়েছে মালদ্বীপের জাতীয় মসজিদ তথা ইসলামিক সেন্টার। এদের সবচেয়ে ব্যস্ত সড়কটির নাম মাজিদি মাগু (রাস্তা)। দিবেহি ভাষায় ‘মাগু’ মানে রোড। এই মাজিদি মাগু এদের ব্যবসা বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র। এখানেই আছে এদের ন্যাশনাল স্টেডিয়াম। মালদ্বীপে ছেলেদের একটি খেলাই খেলতে দেখি। সেটি হচ্ছে ফুটবল। ফুটবল এখানের যুবকদের প্রাণভোমরা। প্রতিটি দ্বীপেও এস্টোটার্ফের ওপরে ফ্লাড লাইট জ্বালিয়ে রাতেও এরা ফুটবল খেলে। ফলাফল সার্ক কান্ট্রিতে ফুটবলে তারা অনেক এগিয়ে আছে।
মাজিদি মাগু রোডের কাছেই রয়েছে এদের ন্যাশনাল মিউজিয়াম। একশ রুফিয়া টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকতে হয়। এদের প্রাচীন প্রত্নতত্ত্ব সেখানে রাখা আছে।
রিপাবলিক স্কয়ারে আছে কবুতর পার্ক। সেখানে শতশত কবুতর ঘুরে বেড়ায়। এছাড়া রয়েছে কৃত্রিম বিচ, সুনামি টাওয়ার, জুমহুরি পার্ক, চিলড্রেনস পার্ক, ‘মুলি আগে’ বা প্রেসিডেন্ট ভবন। এসজেহি আর্ট গ্যালারি – এটি উনবিংশ শতাব্দীর একটি পুরাতন সুদৃশ্য ভবন এখন আর্ট গ্যালারি হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
বুরুজু মাগু বা আমিনি মাগু ধরে পশ্চিম দিকে গেলে মালের পশ্চিমাংশে ভিলিগিলি ও থিলফুসিতে অবস্থিত এদের সবচেয়ে বড় হাসপাতাল ইন্দিরা গান্ধী মেমোরিয়াল হসপিটাল।
মালে শহরের উত্তরাংশে সাগরের কাছে হচ্ছে ব্যবসা বাণিজ্য বিশেষ করে মাছের আখড়া। মালদ্বীপের প্রধান আয় ছিল একসময় মৎস্য শিল্প। এদের টুনা মাছের খ্যাতি পৃথিবীজোড়া। দুজাতের টুনা মাছ আছে। ইয়েলো ফিন টুনা ও হোয়াইট ফিন টুনা। এর মধ্যে ইয়েলো ফিন টুনা মাছের স্বাদই সবচেয়ে চমৎকার। তবে বাঙালি হলে বাঙালিমতে রান্না করা চাই। দিবেহি রান্না আপনি খেতে পারবেন না। এরা একসময় কাঁচা মাছই খেতো মনে হয়। মাছের মধ্যে এদের প্রধান খাদ্যের নাম “গারুদিয়া”।
বাঙালিরা এ খাবার দেখলেও চমকে উঠবেন। কাঁচা মাছ মসলাবিহীন ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুধু লবণ দিয়ে জ্বাল করে এরা চুলা থেকে নামায়। ওপরে মাছের পানি ও নিচে থকথকে সাদা রঙের মাছের টুকরো পড়ে থাকে। এটাই ওদের অভিজাত খাবার। আপনি এ খাবার দেখলে নিশ্চিত পালাবেন।

বাংলাদেশে পরিবারের যে সমস্ত সদস্যরা তরকারিতে রং ঠিকমতো হয়নি বলে হম্বিতম্বি করেন তাঁদেরকে মালদ্বীপ ভ্রমণে পাঠিয়ে দিতে পারেন। তাঁদের জন্য সপ্তাহ ব্যাপী এখানে "গারুদিয়া উৎসব" হবে। এরপরে দেখবেন তরকারির রং তো দূর কী বাত, জিন্দেগির রং নিয়েই তাঁদের আর কোনো অভিযোগ থাকবে না।
আবার এরা প্রতিটি খাবারে একটি পাতা ব্যবহার করে আমরা যেমন বিশেষ খাবারে তেজপাতা ব্যবহার করি। এদের পাতাটির নাম হচ্ছে ‘হিকান্দিফাই’ পাতা। এ পাতার একটি ঝাঁঝালো উৎকট গন্ধ আছে। বাঙালিরা এ গন্ধ পেলে আর সে খাবার খেতে চায় না। এরা এদের সব খাবারই মোটামুটি এই হিকান্দিফাই পাতা দিয়ে রান্না করে। আমার বাসায় এ গাছ একটি আছে। শুনেছি মালে শহরে নাকি এ পাতার খুব চড়া দাম। হায় খোদা! এক এক দেশের একেক বিচিত্র সংস্কৃতি।
আরেক যন্ত্রণা হচ্ছে মাঝে মাঝে কোনো বাসার সামনে কথা বলার সময়ে আতিথেয়তা হিসাবে রোদে শুকানো খটখটে মাছ এনে হাত ধরিয়ে দিয়ে বলে, চাবাও।
তারা নিজেরা আগ্রহের সঙ্গে চাবায় আর আমি হাতের ভাঁজে শুটকি মাছ নিয়ে বসে ঘামাতে থাকি।
________________________________

 

লেখক ডা. মোরশেদ হাসান ।
Works at Medical College, Assistant Professor.
Past: Works at Ministry of Health, Maldives and ICDDR,B

আপনার মতামত দিন:


ভ্রমণ এর জনপ্রিয়