Ameen Qudir

Published:
2017-04-06 21:27:25 BdST

চিরদিনের নায়িকা


 

ডা. মোরশেদ হাসান
______________________


এই দ্বীপদেশে সিনেমা দেখার বাসনা জেগে উঠল। আজ আবার কিংবদন্তি অভিনেত্রী সুচিত্রা সেনের জন্মদিন। নেটে সার্চ দিয়ে উত্তম সুচিত্রার “হারানো সুর” দেখতে বসে গেলাম।


“হারানো সুর”। হারানো সুর অনেক কিছুই হতে পারে। যে সুর কেটে গেছে বা যে মধুক্ষরা সুর বারবার তন্ময়গ্রস্ত করে, বারে বারে নিয়ে যায় হৃদয়কে ফেলে আসা দিনগুলোর বেলাভূমিতে। কিন্তু উদ্ধৃতি চিহ্নের ভেতরে দেখলেই সিনেমাপ্রেমীরা নিমিষে চিনে নেন এ একটি জনপ্রিয় সিনেমার নাম। “হারানো সুর” নিয়ে লেখার ইচ্ছা আমার ছিল না। এ সিনেমা দেখেননি এমন মানুষ মনে হয় কমই আছেন। এটি নিয়ে অজস্র আলোচনা হয়েছে। তারপরও গতরাতে সিনেমাটি আবার দেখে চর্বিত চর্বণ করার বাসনায় কি-বোর্ডে আঙুল বোলানো।
“হারানো সুর” উত্তম-সুচিত্রা জুটির সুপারহিট ছবি। এ ছবির প্রযোজক উত্তম কুমার নিজেই। হারানো সুর সিনেমার কাহিনি নেন তিনি ১৯৪১ সালে লেখা James Hilton-এর ইংরেজি নভেল “Random Harvest”থেকে। এই বইটি থেকে হলিউডে নির্মিত হয় ১৯৪২ সালে সাড়া জাগানো মুভি “Random Harvest” যাতে অভিনয় করেন নায়ক রোনাল্ড কোম্যান এবং নায়িকা গ্রিয়ার গার্সন। নায়ক প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ট্রেঞ্চে শেলের আঘাতে স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলেন।


যাই হোক উত্তম-সুচিত্রা অভিনীত "হারানো সুর" মুক্তি পায় আজ থেকে প্রায় ৫৯ বছর আগে ১৯৫৭ সালে। ট্রেন এক্সিডেন্টে পাটনাগামী যুবক অলক মুখার্জী স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলে দেওদা মানসিক চিকিৎসালয়ে ভর্তি হলে আমরা কিছুক্ষণের জন্য ক্ষেপাটে চিকিৎসকের ভূমিকায় শক্তিশালী অভিনেতা উৎপল দত্তকে পাই।


না, রেন্ডম হারভেস্ট সিনেমার সঙ্গে আর কোনো কিছুতে তেমন মিল নেই। থাকার দরকারও হয় না। যে ছবির পরিচালক অজয় কর, সংগীত পরিচালক হেমন্ত চট্টোপাধ্যায়, গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, গানে হেমন্ত-গীতা দত্ত, পাহাড়ি সান্ন্যালের মতো অভিনেতা আর সবার ওপরে নাম ভূমিকায় উত্তম-সুচিত্রা থাকে সেটি বাংলা সিনেমার ইতিহাসে একটি মাইলস্টোন হিসাবেই পরিগণিত হবে। বাংলা সিনেমার সবচেয়ে জনপ্রিয় জুটি উত্তম-সুচিত্রার রসায়ন দর্শককে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে গেছে গত ষাট বছর ধরে এবং করে যাবে আরও অনাদিকাল। উল্লেখ্য এই জুটির প্রথম ছবি “সাড়ে চুয়াত্তর” মুক্তি পায় ১৯৫৪ সালে। অভিনয়, ব্যক্তিত্ব, সৌন্দর্যের এমন অপূর্ব মিশেল পর্দায় হয়তো কখনোই আর দেখা যাবে না।


ক্যারিশম্যাটিক ক্ষমতা বলে একটি কথা আছে। উত্তমের হাসিটি ছিল অসাধারণ; ভুবনভোলানো যাকে বলে। পুরো মুখমণ্ডল জুড়ে ছড়িয়ে পড়া এমন অনাবিল হাসি বাঙালি তরুণীদের মন হরণ করে নিয়েছে যুগে যুগে।


আর সুচিত্রা? আশি বছরের বুড়ো থেকে সদ্য শ্মশ্রু গজানো তরুণটিকেও করেছে সুচিত্রাকে স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা ভাবতে। সুচিত্রার অপরূপ রূপের ছটায় প্রকাশ পায় একধরনের আত্ম-অহংকার, প্রখর ব্যক্তিত্ব এবং স্বাভিমান। স্নিগ্ধতা আর দৃঢ়তা—দুইয়ের মিশেলে তাঁর অপরূপ সৌন্দর্য বারবার আছড়ে পড়েছে হৃদয়ের বেলাভূমিতে। সুচিত্রার বড় বড় চোখ দুটি বড্ড সুন্দর আর আবেদনময়, চাহনিতে স্বচ্ছ গভীরতা, মিষ্টি হাসিতে সারা মুখখানা যেন উচ্ছলতায় ভরে ওঠে। পঞ্চাশের দশকে একের পর এক ছবিতে সুচিত্রা বাঙালি রমণীদের কাছে নিজেকে করে তুলেছিলেন ম্যাটিনি আইডল। "পথে হলো দেরি" ছবিতে বেণি করে ফিতায় জড়ানো খোঁপার সাজ, রং মেলানো ছাপা শাড়ি-ব্লাউজের স্টাইল, ছোট্ট দুলের সঙ্গে বড় লকেটযুক্ত গলার চেন
তাঁকে করে তুলেছে প্রখর ব্যক্তিত্বময়ী এবং ফ্যাশনেবল। থ্রি-কোয়ার্টার হাতার কাজ করা ব্লাউজ, শাড়িতে লেস এমনকি শুধু পনিটেইল করে চুলকে সামনে নিয়ে আসার স্টাইল শুধু পঞ্চাশ ষাট দশকেই নয়; তাঁকে করে তুলেছে চিরকালের আধুনিক রমণীদের আইকন। চিরন্তন বাঙালি নারীর বিপরীতে "সপ্তপদী" সিনেমায় অ্যাংলো ইন্ডিয়ান রিনা ব্রাউনের ভূমিকায় তিনি হয়ে উঠেছিলেন ফ্যাশনের প্রতিমূর্তি। আঁকাবাঁকা পথ ধরে চলন্ত হোন্ডার পেছনে বসে ‘এই পথ যদি না শেষ হয়...’ গানের সাথে রিনা ব্রাউনের উড়তে থাকা ছোট চুল, বড় সানগ্লাস আর স্কার্ফ জন্ম দিয়েছিল নতুন ট্রেন্ডের। হারানো সুর ছবিতে ডা. রমার ভূমিকায় তাঁর একরঙা শাড়ি, হালকা মেকআপ আর টাইট করে বাঁধা চুল যেন এক অপরূপ স্নিগ্ধতার প্রতীক, যে তার স্বামীর স্মৃতি শক্তি ফিরিয়ে আনতে আপ্রাণ চেষ্টা করে যায়।
আপনি কে? এর উত্তরে তার প্রখর ব্যক্তিত্বের গভীর থেকে আত্মপরিচয় বেরিয়ে আসে আমি…আমি…আমি…মালার গভর্নেস।
অলকের হবু বধুর প্রশ্নের জবাবে রমা বলে,
--প্রশ্নটা শক্ত হলে উত্তর দেওয়া যায় কিন্তু অন্যায় প্রশ্ন হলে উত্তর দেওয়া যায় না। এই সুচিত্রা যেন অনবদ্য! একপেশে কুঁচি ও শাড়ির আঁচলটিকে সামনে টেনে এনে কোমরে গুঁজে দিয়ে গ্রীবা বাঁকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা রমার কাছে তখন যে কেউ খড় কুটোর মতো ভেসে যেতে বাধ্য। তখনকার ছবিগুলো ছিল সাদা কালো। আইশ্যাডোর বৈচিত্র্য সেভাবে ফুটে উঠে নি। নইলে হাতে আঁকা ভ্রু আর ঘন করে দেওয়া কাজলেও যেন মায়াময়তার থেকে রহস্যময়তাই বেশি ফুটে ওঠে; কোথাও তার রং হালকা, কোথাও গাঢ়।
ক্যাজুয়াল পান্ট ও টুইলস শার্ট পরিহিত কখনো হাতা গুটিয়ে দুই একটি বোতাম খোলা রেখে ব্যাকব্রাশ করা চুল আর ঠোঁটের কোণে পাইপ গুঁজ়ে রাখা উত্তম,
---দেখুন আমি কতগুলো প্রিন্সিপাল মেনে চলি। তার মধ্যে একটা হল-- কৌতুহল থাকা ভালো, তার একটা সীমারেখা থাকা দরকার।
...আপনি আমাকে কতটা বিপন্ন করেছেন আপনি নিজেও জানেন না।
উত্তমের হবু বধুর সঙ্গে রমার সংলাপ--
-- প্রশ্নটা খুব শক্ত করেছিলাম কি?
--প্রশ্নটা শক্ত হলে উত্তর দেওয়া যায়,অন্যায় হলে দেওয়া যায় না। আমার সম্পর্কে আপনার যদি কিছু জানবার থাকে মি. মুখার্জীকে জিজ্ঞেস করে নেবেন।
ভিলেন মিহির ভট্টাচার্য আরেক কাঠি সরেস। তাঁর অপূর্ব সংলাপগুলো দেওয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না।
-- শুনলাম অলকের সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছিলেন।
রমা--- বেড়াতে নয় কয়েকটা জিনিস কিনতে গিয়েছিলাম, মালার জন্মদিনে মালার বন্ধুদের নিয়ে ছোটখাটো একটা উৎসব হবে।
--- চমৎকার চমৎকার, ওয়ান্ডারফুল। তবে আসছে মাসে আরেকটা উৎসব আসছে। লতার বিয়ে মানে অলকের বিয়ে । তাতেও আপনাকে একটা বড় রকমের উৎসবের আয়োজন করতে হবে।
-- আপনি ভুল করছেন উৎসবের আয়োজন করা আমার কাজ নয়।
--- গভর্নেস হয়ে শরবত তৈরি করাও তো আপনার কাজ নয়; তবুও তো আপনি তা করছেন। দেখুন রমা দেবী, আমাকে আপনি ভুল বুঝবেন না। শরবত আপনি তৈরি করুন তবে মাঝে মধ্যে এক আধ গ্লাস আমাদেরও খাওয়াবেন…হু হা হা হা।
হারানো সুর…পলাশপুর…পলাশপুরের পাহাড়ী রাস্তার ওধারে রমার বাসা। আর কালজয়ী সেসব গান কিন্নরকণ্ঠী গীতা দত্তের গলায় ---
তুমি যে আমার ওগো তুমি যে আমার। কানে কানে শুধু একবার বলো তুমি যে আমার।
তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে এ ছবির সংগীত পরিচালক হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ঠিক করেছিলেন নায়কের স্মৃতিলোপ ও বিরহ উপলক্ষে একটি বিখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত
ব্যবহার করবেন সিনেমাটিতে –
“আমার এ পথ
তোমার পথের থেকে অনেক দূরে
গেছে বেঁকে গেছে বেঁকে
আমার ফুলে আর কি কবে
তোমার মালা গাঁথা হবে
তোমার বাঁশি দূরের হাওয়ায়
কেঁদে বাজে কারে ডেকে।”
সিনেমার গানে রবীন্দ্রসংগীত ব্যবহারের জন্য বিশেষ নিয়ম-কানুনের ব্যাপার আছে। সে অনুমতি পেতে সম্ভবত বিপত্তি হচ্ছিল, কিন্তু সিনেমার অই সিকোয়েন্সে ওরকম একটি গানও যে ভীষণ দরকার! গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন ও সুরকার হেমন্তের মিলিত ফসলে দাঁড়ালো সেই অবিস্মরণীয় গান--
"আজ দুজনার দুটি পথ ওগো
দুটি দিকে গেছে বেঁকে
তোমার ও পথ আলোয় ভরানো জানি
আমার এ পথ আঁধারে আছে যে ঢেকে
সেই শপথের মালা খুলে
আমারে গেছ যে ভুলে।
তোমারেই তবু দেখি বারে বারে
আজ শুধু দূরে থেকে
আমার এ পথ আঁধারে আছে যে ঢেকে।"

______________________________

লেখক ডা. মোরশেদ হাসান ।
Works at Medical College, Assistant Professor.
Past: Works at Ministry of Health, Maldives and ICDDR,B

আপনার মতামত দিন:


প্রিয় মুখ এর জনপ্রিয়