Ameen Qudir

Published:
2019-01-17 00:26:47 BdST

বারোয়ারিজনগণের টাকায় পড়ছে,মানুষ, কুকুর, বেড়াল বাঁচানো ডাক্তারদের কর্তব্য : শিক্ষিত প্রেসিডেন্সির ছাত্রী


প্রতিকী ছবি। মূল ছবি অনলাইন সংবিধির সম্মানে দেয়া হল না।

 

 

ইনটার্ন চিকিৎসক প্রীতম মন্ডল
____________________________

#ডাক্তাররা_তো_আসলে_কুকুর

" জনগণের ট্যাক্সের টাকায় ডাক্তারি পড়ছে, সুতরাং এটা তাদের দায় বর্তায় মানুষ, কুকুর, বেড়াল, ছাগল, সাপ, ইঁদুর, টিকটিকি, উচ্চিঙড়ে, ছারপোকা ইত্যাদি সমস্ত জীবের সেবা করা, তাদের বাঁচানো........।"
- শিক্ষিত প্রেসিডেন্সির ছাত্রী।

ডাক্তাররা আসলে কুকুর। হ্যাঁ কুকুর'ই বটে। তা নাহলে সবার লাথি ঝাঁটা, গালাগালি, মারধর খেয়ে চুপ করে থাকে! যাদের বিন্দুমাত্র চক্ষুলজ্জা আছে তারা চাকরি ছেড়ে দেয়, যারা পারে তারা দেশ ছেড়ে পালায়, নাহলে সুইসাইড করে কিংবা লোকে তাদের মেরে ফেলে । যারা মরে যায় তারা উপর ওয়ালার অসীম কৃপায় এ জীবনে বেঁচে যায়। কিন্তু যাদের পিছুটান আছে? সংসার আছে? তারা কি করবে ? সোজা হিসাব! সরকার তাদের গলায় দড়ি পরিয়ে ঘোরাবে , তারা মুখ বুজে সব সহ্য করবে, মার খাবে, গালাগালি খাবে, লোকে এসে তাদের মুখে পায়খানা মাখিয়ে দেবে, জামার কলার ধরে থাপ্পড় মারবে, সাড়ে পাঁচ বছরের হাড় ভাঙা খাটনির মুখে থুতু ফেলবে, গলায় স্টেথোস্কোপ আটকে সিলিং ফ্যান থেকে ঝুলিয়ে দেবে। ব্যাস! বাড়িতে দুবছরের মেয়ের মুখের হাসি ফুরোতে না ফুরোতে বাবার নিঃশ্বাস শেষ বারের মত আকাশ ছোঁবে। বাঃ! এই না হলে ডাক্তার! না এরা কুকুর'ই।
এবার আসি আসল কথায়। ষোল'টা কুকুর যারা মেরেছে তারা নির্দ্বিধায় অত্যন্ত খারাপ কাজ করেছে। আর যাই হোক, ষোলটা নিরীহ প্রাণকে এভাবে পিটিয়ে শেষ যারা করেছে তারা মানুষ হতে পারে না। তাদের যথাযোগ্য শাস্তি হওয়া উচিত। এবং হবে এই আসা রাখি। এর জন্য প্রতিবাদ হওয়া চাই এবং সম্পূর্ণ ভাবে সেটাকে সাপোর্ট করছি। কিন্তু যারা ডাক্তার মারে ? তাদের জন্য কি একটুও এই গলা ফাটা চিৎকার শুনতে পাব না ? তাদের জন্য একটু প্রতিবাদ মিছিল, হলুদ প্ল্যাকার্ডে লেখা পাব না ? তাদের জন্য একটু সহানুভূতি পাব না ? তারাও তো ওই কুকুর গুলোর মত মুখ বুজে সব সহ্য করে।
আসলে ডাক্তার মানেই বারোয়ারি সম্পত্তি। জনগণের টাকায় পড়েছে , সুতরাং জনগণের কেনা গোলাম। এ কি রে বাবা! তাহলে অন্য প্রফেসনের লোকেদের কি টাকার খনি আছে নাকি ? তারাও তো জনগণের টাকাতেই পড়ে! কে জানে কি হিসেব!
যারা কুকুর মারা যাওয়ার প্রতিবাদ করছে তাদের সাপোর্ট করি। দোষীদের যথাযোগ্য শাস্তির দাবি রাখছি। কিন্তু তাই বলে একটা গোটা হাসপাতাল বন্ধ করে দিতে হবে এই দাবি মানতে পারলাম না। জাস্ট এক ঘন্টা, এক ঘন্টা ওই হাসপাতালটা বন্ধ করে দিন। দেখবেন যে সংখ্যক মানুষ মারা যাবে তার সংখ্যাটা ষোল'র চেয়ে অনেক বেশি। তার দায় নেবেন তো ? নাকি সেটাও ডাক্তারদের দোষ বলে চালিয়ে দেবেন?
একটা ছোট্ট ঘটনা বলি। আজ থেকে দু মাস আগের কথা। আমি তখন বেলেঘাটা আই ডি হাসপাতালে ডিউটি করছি। বেলেঘাটা আই ডি হাসপাতাল হল শহরের একমাত্র হাসপাতাল যেখানে কুকুর, বিড়াল ইত্যাদি কামড়ানোর চিকিৎসা হয়। আইরোনিক্যালি, এই হাসপাতালেই কুকুর বিড়ালের সংখ্যা সব চেয়ে বেশি( দায়িত্ব নিয়ে বলছি)। ওয়ার্ডে ঢুকতে হয় ভয়ে ভয়ে। চারিদিকে বিড়াল আর বিড়াল। সারা দিন, সারা রাত জুড়ে কুকুর বিড়াল কামড়ানোর জন্য ইনজেকশন দিতে হয়। নন স্টপ। চব্বিশ ঘন্টা। বেলেঘাটায় জলাতঙ্ক পেশেন্টদের জন্য দুটো আলাদা ওয়ার্ড আছে। যেটা পশ্চিমবঙ্গের সম্ভবত আর কোন হাসপাতালে নেই। থাকলেও আমার জানা নেই। আমি বলছি মেল ওয়ার্ডের কথা। ওয়ার্ডটা পুরোটাই লোহার গ্রিল দিয়ে ঘেরা। জেলের সেল যেরকম হয় সেরকম। মোটা মোটা লোহার গরাদ ওয়ালা একটা বিশাল দরজা দিয়ে ঘরটার মধ্যে ঢুকতে হয়। দরজায় ইয়া বড় একখানা তালা ঝোলানো আছে। দরজা দিয়ে দেখলে পর পর তিনটে বেড দেখতে পাওয়া যায়। মাঝের বেডটাতে একজন কম বয়সী ছেলে শুয়ে আছে দেখতে পেলাম। বিছানার সাথে হাত পা বাঁধা আছে। দরজার কাছে গেলে মুখ থেকে হালকা গোঙানির শব্দ শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। আমি প্রথমে ব্যাপারটা বুঝতে পারিনি। কারণ কোনদিন কোন পেশেন্টকে তালা বন্ধ করে হাত পা বাঁধা অবস্থায় রাখতে দেখিনি। সিস্টার দিদিকে জিজ্ঞেস করতে বললেন, " ও তো র‍্যাবিস পেশেন্ট। ওই ঘরে যে ঢোকে সে আর কোনদিন বেরোয় না।"
হ্যাঁ। জলাতঙ্ক একবার হলে তাকে কোনদিন বাঁচানো যায় না। আমি পরের দিন সাহস করে ওই ঘরে ঢুকেছিলাম। কিন্তু বিছানার কাছে যাওয়ার সাহস হয়নি। কারণ জলাতঙ্কের রুগীরা ভীষণরকম অ্যগ্রেসিভ হয়। যদি কোনভাবে আঁচড়ে কামড়ে দেয় তাহলে ইনজেকশন নেওয়া ছাড়া উপায় নেই, আর সে যন্ত্রনা খুব একটা সুখের নয়। সেই কারণেই ওদের হাত পা বেঁধে রাখা হয়, বরং রাখতে হয়। দৃশ্যটা বড় ভয়ানক। একজন মানুষ বেঁচে আছে, অথচ তার চিকিৎসা করতে গিয়ে ডাক্তার নার্স সবাইকে ভয়ে ভয়ে থাকতে হচ্ছে। নার্স , ডাক্তার যখন কেউ ওই ঘরে ঢুকছে, সঙ্গে করে একজন অথবা দুজনকে নিয়ে ঢুকছে। কোন চিকিৎসা নেই, তাই কষ্ট কমানোর জন্য ঘুমের ওষুধ দিয়ে রাখা হচ্ছে রুগীকে। যাতে করে শেষ যাত্রায় একটু অন্তত কম কষ্ট হয়। কি অদ্ভুত না বিষয়টা? একজন মানুষ,যে নিশ্চিতভাবে মারা যাবে তাকে চোখের সামনে মরতে দেখেও কিছু করার নেই! অবাক হলেন? তাহলে বাকিটা শুনুন। ঠিক তার পরের দিন রাউন্ডে গেছি। সিস্টার দিদি আমাকে ওই পেশেন্টের টিকিট হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, " ডক্টর , আপনি ওনার বাড়ির লোকের কাছ থেকে কনসেন্ট নিয়ে নিন।"
আমি ভীষণ অবাক হয়েছিলাম। যে মারা যাবে তার আবার কনসেন্ট কিসের! সিস্টার দিদি বুঝিয়ে বলার পর পুরো বিষয়টা পরিষ্কার হয়েছিল। কিছুই যে আর করার নেই সে বিষয়টা বাড়ির লোকজনদেরকে বলা। ছেলেটির বাবা এসেছিলেন। আমি ওনাকে বলেছিলাম, " দেখুন, জলাতঙ্ক হলে তো রুগী বাঁচে না। আমরা শুধু ওর কষ্টটা কমাতে পারি মাত্র। রুগীর যা অবস্থা ও যেকোন মুহূর্তে মারা যেতে পারে। আপনি প্লিজ এখানে একটা সই করে দিন।"
কি নিষ্ঠুর কাজ। তাই না ? একজন বাবার কাছ থেকে তার ছেলের মৃত্যুর জন্য সই করিয়ে নিতে হচ্ছে। এ পাপ বোধ হয় হাজার বার গঙ্গা স্নান করলেও যাবেনা আমার। কিন্তু কি করব, কর্তব্য মানুষকে পায়ে শিকল পরিয়ে রাখে। অতএব মনে ছাই চাপা দিয়ে কাজ করে যেতে হবে। ভদ্রলোক কোন কথা বলেননি এর পর। লক্ষ্য করেছিলাম সই করার সময় হাত কাঁপছে ওনার। মুখের দিকে তাকাতেই দেখলাম গাল গড়িয়ে গঙ্গা নামছে। এক ফোঁটা ছেলের হাসপাতাল টিকিটের উপর পড়ল টুপ করে। একজন বাবা নিজের চোখের জলে ছেলের মৃত্যুর পথ মসৃন করছে। ভাবলেও গায়ে কাঁটা দেয়।
আমি সাহস করে ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করেছিলাম, " কিকরে হল এরকম ওর ?"
কাঁপা কাঁপা গলায় ভদ্রলোক বলেছিলেন, " স্যার ও স্ট্রিট ডগদের ট্রিটমেন্ট করত। ওদের খেতে দিত। তিন মাস আগে ওকে একটা কুকুর কামড়ে দিয়েছিল। আমরা বলেছিলাম ইনজেকশন নিতে, কিন্তু ও বলেছিল, ' ওরা আমাকে ভালোবাসে, আমার কিছু হবে না ', তখন যদি ইনজেকশন নিয়ে নিত তাহলে ওকে আজকে এরকম ভাবে মরতে হত না স্যার।" হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলেন ভদ্রলোক। যেন হৃৎপিন্ডটা কেউ এক টানে ছিঁড়ে নিয়েছে ওনার। আমি আর কোন কথা বলার সাহস পাইনি। কিছুক্ষন পরে দেখলাম লোহার দরজার কাছে গিয়ে ছেলের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। আর বলছেন, " বাবু, তুই ভয় পাস না বাবু। আমি আছি। তোর কিছু হবে না।"
আমি দৃশ্যটা দেখতে পারিনি আর। বেরিয়ে এসেছিলাম ওয়ার্ড থেকে। কি অদ্ভুত ব্যাপার! ছেলেটা রাস্তার কুকুরদের সেবা করত আর আজ ওরাই ওকে মারল। পরে জেনেছিলাম ছেলেটার বয়স ছিল মাত্র তেইশ বছর। ভাবা যায়!
মরাল অফ দ্যা স্টোরি, পশু প্রেম ভালো কিন্তু তার জন্য নিজের জীবন দেওয়াটা বোকামি।
এবার আমি আমার হাসপাতালের কথা বলি। এন আর এসের অনতিদূরেই চিত্তরঞ্জন হাসপাতাল। মেডিসিন ওয়ার্ডে যতগুলো পেশেন্ট থাকে তার সমান বিড়াল থাকে। বেডের তলায়, করিডোরে, সিঁড়িতে, বাথরুমে, সবজায়গাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এমনকি গাইনি ওয়ার্ডে যেখানে মায়ের সাথে বাচ্চা থাকে সেখানেও বেড়াল ঘুরে বেড়াচ্ছে। পেশেন্টের বেডের নীচে অজস্র পোকা মাকড় আরশোলা ভর্তি। যেখানে বসে ওয়ার্ডের কাজ করতে হয় সেখানকার টেবিলের ড্রয়ারে আরশোলা গিজ গিজ করছে। বেডের তলায় ইঁদুর। হাসপাতাল চত্বরে প্রায় কাছাকাছি একশটা কুকুর যারা রাত বাড়ার সাথে সাথেই একেকটা বাঘ হয়ে যায় সব। বাইরে বেরোতেই ভয় করে। কই এসব নিয়ে তো কোনদিন কাউকে কিছু বলতে দেখি না ? নাকি ডাক্তাররা এসব এনে ছেড়ে রেখেছে হাসপাতালে ? আমিও বোকা! বলবে কি করে? যারা বলবে তারা তো পয়সাওয়ালা। বাড়ির লোককে নার্সিংহোমে ভর্তি করে সরকারি হাসপাতালে থুতু ফেলতে আসে এরা সব। সরকারি হাসপাতালে দু চারটে মানুষ মরলে এদের কিস্যু এসে যায় না। আর কুকুরের কামড়ে যদি ডাক্তার মরে! তোবা তোবা! এর থেকে খুশির খবর আর হয় নাকি মশাই! এক কুকুর আরেক কুকুরকে মেরেছে। ডাক্তাররা আসলে কুকুর'ই বটে।
একটা ভিডিও দেখলাম একজন জনৈক প্রেসিডেন্সির ছাত্রী বিশাল বড় বড় বুলি আওড়াচ্ছেন কিছু না জেনেই। আমার অনেক বন্ধু প্রেসিডেন্সির স্টুডেন্ট এবং তারা যথেষ্ট শিক্ষিত। কিন্তু একে দেখে তো প্রেসিডেন্সির স্টুডেন্ট মনে হচ্ছে না একেবারেই। আর যদি তাই হয় তাহলে এটা প্রেসিডেন্সির লজ্জা। ওনাকে বলি আগে ভালো করে ডাক্তার, ডাক্তারি, এবং হসপিটালের নিয়ম, ডিউটি আওয়ার্স, সিস্টেম এসব সম্পর্কে জানুন তারপর নেত্রী হতে যাবেন। এরকম অশিক্ষিতের মত অর্ধেক নলেজ নিয়ে বক্তৃতা দিতে যাবেন না। হলুদ প্ল্যাকার্ডে কিছু লিখে নিয়ে এসে গলার জোরে দু চার কথা বললেই বিশাল কিছু হিরো হওয়া যায় না। পেটে বিদ্যে থাকতে হয়। কে ডাক্তার হবে কি না হবে সেটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। তারজন্য কারুর পারমিশন নেওয়ার দরকার নেই। ডাক্তাররা কারুর কেনা চাকর বা গোলাম নয়, চাকর হওয়ার জন্য সাড়ে পাঁচ বছর কেউ পেছন ফাটিয়ে পড়ে না!
যারা দোষী তারা শাস্তি পাবে। কিন্তু মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের জন্য একটা সিস্টেম এবং প্রফেসনকে কলুষিত করা বন্ধ হোক। বন্ধ হোক গালিগালাজের নোংরামি। বন্ধ হোক মেকি ফেসবুক পশুপ্রেম।
যে রাজ্যে, রাজ্যের একমাত্র সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে কাতারে কাতারে মানুষ ডায়ালাইসিসের জন্য লাইন দিয়ে থাকলেও সবার আগে কুকুরের ডায়ালাইসিস হয় সেখানে মানুষের চিকিৎসার জন্য তৈরি হাসপাতাল বন্ধ করে দেওয়াই উচিত। তাহলে অন্তত মুখ সেলাই করা ডাক্তারগুলো বেঁচে যাবে। আর কিছু না হোক স্টেথোস্কোপটা গলায় দিয়ে ঝুলে তো পড়তে পারবে রে বাবা! তখন এরকম প্রতিবাদের ঝড় দেখতে পাব তো ? ডাক্তাররা তো আসলে কুকুর'ই।

#শাস্তি_পাক_দোষীরা
#প্রাণটা_প্রাণ'ই
#সেটা_মানুষ_হোক_বা_কুকুর
_______________________________

 

প্রীতম মন্ডল। ইনটার্ন চিকিৎসক। কলকাতা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ, কলকাতা।

আপনার মতামত দিন:


মেডিক্যাল ক্যাম্প এর জনপ্রিয়