Ameen Qudir

Published:
2018-12-15 00:10:39 BdST

অচিকিৎসক প্রশাসক সবকিছুর নির্ণায়ক হওয়ার সবচেয়ে বড় কুফল শিশু ও জনস্বাস্থ্যের সূচকে নিম্নগামীতা


 

 

ডা. রেজাউল করীম, কলকাতা।
______________________________

স্বাধীনতার এত বছর পর ও এদেশে স্বাস্থ্য মৌলিক অধিকারের শিরোপা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে। তথ্যের অধিকার আছে, কিন্তু সেই তথ্য সংগ্রহ করার জন্য যে বল ও বীর্যের প্রয়োজন তা অধিকারের সীমারেখার বাইরে। সবার জন্য স্বাস্থ্যের শ্লোগান দেওয়া হয়েছে কিন্তু তা বাস্তবায়ন করার জন্য যে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও কেন্দ্রীয় বাজেটে যে অর্থ সংস্থান রাখা প্রয়োজন তা রাখা হয় নি- সরকার এসেছে ও চলে গেছে, জামার রঙ পাল্টেছে কিন্তু মৌলিক পরিবর্তন হয়নি। তাই, গুণগত মান ও নাগালের মধ্যে পাওয়ার নিরিখে ১৯৫ টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১৪৫ নম্বরে। অনেক যুদ্ধ বিধ্বস্ত ও সামাজিক ভাবে অনুন্নত দেশ ও এ বিষয়ে আমাদের টেক্কা দিয়েছে।

অমর্ত্য সেন ও জাঁ দ্রেজ সম্প্রতি কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য নীতির কঠোর সমালোচনা করে বলেছেন-monumental blunder ও quantum jump in wrong direction. সরকারের যতটা আস্থা আয়ুষে, গোমুত্র ও গোময়ে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে তার ছিটেফোঁটা নেই। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বলেছেন, ক্য্যানসারের কারন পূর্ব জন্মের অভিশাপ। কেন্দ্রীয় বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় জিডিপির মাত্র ১শতাংশ। সরকারী High Level Expert Group ২০১১ সালে একটি অসাধারণ তথ্য সমৃদ্ধ রিপোর্ট তৈরী করে বলেন যে এই ব্যয় অন্ততঃ আড়াই শতাংশ হওয়া প্রয়োজন। আলমা আটা সম্মেলনে কেন্দ্রীয় সরকার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা পালন করার কোন উদ্যোগ দেখা যায় নি। স্বাস্থ্য সূচকে যে কেবলমাত্র আমরা পিছিয়ে আছি শুধু তাই নয়, Physical Quality of Life indexর সবকটি সূচকে আমরা পিছিয়ে আছি। আরেকটি খুব উদ্বেগজনক দিক হল public health expenditure যেখানে আমাদের ব্যয় "পিনাটস" বললে কম বলা হয়। উন্নত দেশে এই হার যেখানে 70%এদেশে এদেশে মাত্র ৩৫%। তাই দেশে অপুষ্টির হার শতকরা পঁয়ত্রিশ ভাগ, শৌচাগার, পানীয় জল, সার্বিক টিকাকরণ সর্বত্র আমাদের দৈন্যের ছাপ। শুধু জনস্বাস্থ্যের সমস্যা নয়, চিকিৎসা পরিষেবা দিতেও কেন্দ্রীয় সরকার পুরোপুরি ব্যর্থ। সারা দেশে প্রতি দশহাজারে মাত্র ৭টি শয্যা আছে, প্রতিবেশী শ্রীলঙ্কা ৩৬ ও উন্নত দেশে ৬০।তথাকথিত মোদিকেয়ারের কথা ভাবুন- মাথা পিছু বরাদ্দ মাত্র ৪০টাকা। এই টাকা দিয়ে পাঁচলাখী বীমা কি হতে পারে? কিন্তু হোয়াটসাপ বিশ্ববিদ্যালয় জুড়ে প্রচারের ঢক্কানিনাদে কে বলবে যে যা রটছে তা তা ঘটা সম্ভব নয়। জাঁ দ্রেজ An uncertain glory তে দেখিয়েছেন কিভাবে বেসরকারি বীমা র টাকা হাতবদল হয়ে সরকারের খাজাঞ্চি খানা থেকে বেসরকারি পুঁজির কাছে জমা হয়। কিভাবে অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারে অঙ্গহানি হয়।
"তার মানে,
স্বার্থ, অর্থ,
জমিদারী অনর্থ,
টাকা, টাকা আর টাকা,
সমস্ত দিনের হীন বাণিজ্যটাই ফাঁকা"।
কিন্তু শুধু নীতির প্রশ্ন নয় প্রয়োগের ক্ষেত্রে অনুদারতা স্পষ্ট হয়ে যায় যখন জবরদস্তি করে বেসরকারি পুঁজিকে সুবিধা দেওয়ার জন্য নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়। মেডিকেল শিক্ষায় তার জ্বাজ্বল্যমান প্রমান হল NMC বিল। এই বিলটি যদি সত্যি সত্যি আইনসভায় পাশ হয় তাহলে দেশে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের অপমৃত্যু ঘটবে। নিম্ন মেধার বিত্তবান চিকিৎসকে দেশ ভরে যাবে। গরিবের সন্তান আর ডাক্তার হতে পারবে না। স্বাস্থ্য নিয়ে UPA সরকার কিছু সদর্থক কাজ করার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু অপ্রতুল বাজেটের জন্য তা তেমন কার্যকরী হয় নি। যাইহোক, বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের জমানায় সবচেয়ে বেশি অবনমন হয়েছে মানসিক স্বাস্থ্যের। এত অনুশোচনাহীন খুন, সন্ত্রাসের পিছনে যুক্তি খাড়া করা ও lynch mobকে উৎসাহ দান করার আগ্রহ আর কখনো দেখা যায় নি। 35 র জার্মানি আর 2018র ভারতের সীমারেখা সেখানে অস্পষ্ট।
ঘৃণার রাজনীতি যে সমাজ ও ব্যক্তির স্বাস্থ্য হানি করে তা প্রমাণিত সত্য ও যুগ যুগ ধরে ভারতবর্ষে তা বহুল আলোচিত। ধম্মপদের একটি বাণী আছে-
"অকোচ্ছি মং, অবধি মং, অজিনীন মং অহাসি মে
যে চ তং উপনযহন্তি বেরং তেসং ন সম্মতি।"

মনের শান্তি বজায় রাখার জন্য সব পাপে পূর্বসূরিদের দায়ী করার সংস্কৃতি উদারনৈতিক চেতনার উপর আঘাত, যা মানসিক বৈকল্যের লক্ষণ।
স্বাস্থ্যের দাবী হল আদ্যন্ত রাজনৈতিক দাবী। মানুষের যেসব প্রয়োজনীয় নিত্যব্যবহার্য জিনিস প্রয়োজন সেগুলির চাহিদা পূর্ণ হলে স্বাস্থ্যের অপূর্ণ চাহিদা পূরণ হয়।চিকিৎসা তার একটি অঙ্গ, খুব সম্ভবত ক্ষুদ্রতম অঙ্গ যা শিক্ষা, সুপেয় পানীয় জল, বাসস্থান ও পুষ্টিকর খাবারের সংগে সংশ্লিষ্ট। স্বাস্থ্যের Physical Quality of life index তাই সাক্ষরতা, শিশুমৃত্যু ও জীবনকালের সম্ভাব্যতার সূচক। চিকিৎসা কোন মানদণ্ড নয়। কিন্তু, সবার জন্য উন্নতমানের চিকিৎসার বিষয়টি এখন স্বীকৃত মানবাধিকার ও কেন্দ্রীয় সরকারের উচিত সেই দাবী পূরণ করা। প্রতিবছর শিল্পপতিদের যে ভর্তুকি সরকার দিয়ে থাকেন শুধু সেই টাকাটি খরচা করলেই UHCর স্বপ্ন পূরণ সম্ভব। প্রয়োজন শুধু রাজনৈতিক সদিচ্ছার।
এই প্রসঙ্গ আর দীর্ঘায়িত না করে বরঃ রাজ্যের দিকে দৃষ্টিপাত করা যেতে পারে। সামাজিক ক্ষেত্রে এই রাজ্যে বিনিয়োগের একটি ঐতিহ্য আছে। বিগত কয়েক বছরে সেই ঐতিহ্যের পাশাপাশি নারী শিক্ষায় উল্লেখ যোগ্য অগ্রগতি হয়েছে।গত বছরের তুলনায় স্বাস্থ্য বাজেটের বৃদ্ধি হয়েছে প্রায় 120%। শয্যা বেড়েছে শতকরা 20%। মাথাপিছু শয্যার সংখ্যা সারা দেশের তুলনায় দ্বিগুণ, দিল্লির ঠিক পেছনেই বাংলা।বর্তমান সরকার curative treatment এ বেশ জোর দিয়েছেন ও নানা ধরনের পরীক্ষা নিরীক্ষা ও ওষুধপত্র বিনা পয়সায় দেওয়া হচ্ছে। এই রাজ্যের ব্যাপক অংশের মানুষের কাছে সরকারী ব্যবস্থাই একমাত্র গতি। তাই সরকারী স্বাস্থ্য পরিষেবা বৃদ্ধি পেলে তা রাজ্যের জন্য মঙ্গল।উন্নত সরকারী ব্যবস্থা জনগনের অধিকার ও সরকারী পরিষেবার বেসরকারিকরণ মানবাধিকার বিরোধী অবস্থান।তুলনামূলক ভাবে উন্নত হলেও পরিকাঠামো ক্ষেত্রে বেশকিছু সমস্যা আছে। যেমন এই রাজ্যের জনসংখ্যার তুলনায় শয্যা ও চিকিৎসকের অপ্রতুলতা। রাতারাতি এর পরিবর্তন করাও সম্ভব নয়, কারন পরিকাঠামো নির্মানের যে বিপুল খরচ তা রাজ্য সরকার মেটাতে পারবে না। এই ঘাটতি মেটানোর সম্ভাব্য দুটি রাস্তা আছে- PPP model বা কেন্দ্রীয় সাহায্য। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য নিয়ে যারা ধারাবাহিক কাজ করেন তারা মনে করেন যে Universal health coverage র দাবী যদি কেন্দ্রীয় সরকার মেনে নিয়ে জিডিপির আড়াই শতাংশ ব্যয় করেন তাহলে এই ঘাটতির অনেকটাই মেটানো সম্ভব।
পিপিপি মড়েলে উপযুক্ত প্রয়োগ নিয়ে আরো ভাবনা চিন্তার অবকাশ আছে। এই রাজ্যের মেডিকেল কলেজগুলিতে যে পিপিপি মড়েল চালু আছে তা বাম জমানার। সরকার নিজের পয়সা খরচ করে যন্ত্রপাতি কিনে অপারেশন ও মেইনটেনান্সের দায়িত্ব বেসরকারি হাতে দিচ্ছেন। ক্যাপিটাল ইনভেস্টমেন্টের অভাবের জন্যই পিপিপি দরকার, অথচ এই ক্ষেত্রে বেসরকারি পরিষেবা দানকারি কোন বিনিয়োগ করছেন না।এখানে সরকার বস্তুত নিজের অর্থ বিনিয়োগ করছেন আবার রোগী প্রতি একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা ভেণ্ডারকে দিচ্ছেন।এই ব্যবস্থা সরকারী ক্ষেত্রকে দুর্বল করবে বলে আমাদের বিশ্বাস ও তা পুনর্বিবেচনা করলে সরকার আখেরে লাভবান হবেন।
এভিডেন্স বেসড মেডিসিন যেমন আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রয়োজনীয় অঙ্গ তেমনি তা যথেষ্ট ব্যয়বহুল। এই ব্যয় যেমন সরকারের কাছে অত্যন্ত শ্লাঘার বিষয় তেমনি এর বিপুল ব্যয় বোঝা স্বরূপ। যতদিন পর্যন্ত কমপক্ষে জিডিপির আড়াই শতাংশ খরচ করা সম্ভব না হয় ততদিন সরকার এই ব্যয় কমানোর ও দক্ষতা বৃদ্ধির দিকে নজর দিতে পারেন। শয্যার অভাব বা দীর্ঘ্য প্রতীক্ষমান তালিকা মানুষের ক্ষোভের অন্যতম প্রধান কারন। সেই ক্ষোভ ও রোষের শিকার হচ্ছেন প্রতিষ্ঠান ও চিকিৎসা কর্মীরা। সরকারী হাসপাতালে একজন চিকিৎসক গড়ে যে পরিমান রোগী দেখেন তা উন্নত দেশের তুলনায় বহু গুণ বেশি। তাই গড়ে একজন রোগীর জন্য চিকিৎসক মাত্র এক মিনিট সময় ব্যয় করেন। আসলে এ রাজ্যে আরো 50000 হাজার চিকিৎসক দরকার।হয়ত সেই অভাব নিয়েই আমাদের হয়ত আরো বেশ কয়েক দশক কাটাতে হবে।তাই, মুমূর্ষু মানুষ যখন চিকিৎসকের কাছে যান যে প্রত্যাশা নিয়ে যান সে প্রত্যাশা পূরণ হয় না। তাদের ক্ষোভের আগুন তখন সন্ত্রাসের চেহারা নেই। এই পরিপ্রেক্ষিতে খুব প্রয়োজন হল চিকিৎসকদের আরো বেশি নির্ভরতা দেওয়া, নিরাপত্তার বন্দোবস্ত করা ও বৃহত্তর সমাজের কাছে মূল সমস্যাটি তুলে ধরা। বেশির ভাগ চিকিৎসক ভালো ও অন্যায় আচরণে লিপ্ত নন। আয়ের হিসাব করলেও দেখা যাবে বেশির ভাগ চিকিৎসকের মাসিক আয় কেন্দ্রীয় সরকারের উচ্চবর্গের করনিকের সমতুল্য বা তারচেয়ে কম।অনেককেই কায়ক্লেশে অন্ন খুঁটে খেতে হয়। তাই, তাদের অর্থগৃধ্নু বলে যখন চিহ্নিত করা হয়, অন্যায় আচরণে তাদের পীড়িত করা হয় বা তারা হামলার শিকার হন তখন তাঁদের অভিমানের আগুন ও ধিকিধিকি জ্বলতে থাকে। এই রাজ্যে গত পৌনে দুবছর ১৮০ চিকিৎসক শারীরিক ভাবে নিগ্রহের শিকার হয়েছেন, মানসিক নির্যাতনের কথা বাদই দিলাম। অন্যায় ও অমানবিক ভাবে তাদের নিগৃহীত করে সামাজিক সম্মান ধুলোয় লুটিয়ে দেওয়া হয়েছে। কর্মক্ষেত্রে দুশ্চিন্তা ও আক্রমনের ভয়ে চিকিৎসকরা নানারকম রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। বেশ কয়েকজন আত্মহত্যাও করেছেন। চিকিৎসকদের শতকরা 70ভাগ উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। তাদের সংখ্যা কম তাই ডিউটির ও বাঁধাধরা হিসেব নেই।অনেকে প্রয়োজনীয় বিশ্রাম পাননা। বেসরকারি ক্ষেত্রে চিকিৎসার লাগাম ছাড়া খরচের জন্য শতকরা সাতভাগ রোগী নতুন করে দরিদ্র হচ্ছেন অথচ দেখা যাচ্ছে হামলায় আক্রান্ত চিকিৎসকদের বেশির ভাগই কিন্তু সরকারী ক্ষেত্রে কাজ করেন।তাঁরা সরকারী হাসপাতালের চৌহদ্দীর মধ্যে আক্রান্ত হয়েছেন। হামলার ঘটনায় অনেক ক্ষেত্রে এফ আই আর ও হয় নি। প্রশাসন একজন সাধারন প্রশাসক মার খেলে যে উদ্যোগ নেন এক্ষেত্রে তার ছিঁটেফোটাও দেখা যায় নি। যারা আক্রমণকারী তাঁদের মধ্যে পদস্থ পুলিশ কর্তা, রাজনৈতিক নেতা উকিল শিক্ষকসহ প্রায় সর্বস্তরের মানুষ আছেন। কখনো কখনো ক্ষমা চাওয়ানো হয়েছে ও কেস ক্লোজ করে দেওয়া হয়েছে।প্রায় সব রাজনীতিরই কেউ না কেউ এসব হামলায় জড়িত।যথাযথ আইন থাকলেও কেউ গ্রেফতার হননি।অনেক ওসি তো জানেন ই না যে এরকম আইন আছে।আরো দুঃখের কথা, অনেক সময় মিটমাট করার জন্য চাপ তৈরী করা হয়,কখনো পুলিশ কখনো অন্য প্রভাবশালীরা এই চাপ তৈরির মুখ্য স্থপতি। হামলার অন্যতম প্রধান কারন রোগী-চিকিৎসক পারস্পরিক আস্থাহীনতা। এই ভুল বোঝাবুঝি ও আস্থাহীনতা তৈরী হয়েছে উর্ধ্বমুখী চিকিৎসা ব্যয় ও চিকিৎসা পাওয়ার অনিশ্চয়তার জন্য। এই অবস্থায় সামগ্রিক ভাবে রাষ্ট্রীয় অবহেলার কারনে। কোন একক ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা রাজনীতি এর জন্য দায়ী নয়। এ পুরো জাতির সামগ্রিক ব্যর্থতা । চিকিৎসকরা যে অন্যায় আচরণের শিকার, তাঁরা যে গনশত্রু হিসেবে চিহ্নিত তার জন্য তারা ক্ষুব্ধ, অসম্মানিত, অপমানিত। তাঁদের সেই অভিমান ও অপমানে ঘৃতাহুতি দিয়েছে WBCEA র কিছু ধারা ও CERCতে চিকিৎসকদের হেনস্থা। অনেক বেসরকারি ক্ষেত্রের প্রতিনিধি CERC তে আছেন যা স্বার্থের সংঘাত সৃষ্টি করতে পারে। CERC তে পুলিশ আধিকারিকের উপস্থিতিও খানিকটা বিস্ময়ের।

চিকিৎসা পরিষেবায় কিছু কিছু ত্রুটিও আছে। রেফারেল সিস্টেম ঠিকমত কাজ করে না, সমাজের দুর্বলতম অংশের মানুষ অনেক সময় অন্যায় ভাবে বঞ্চিত হন। স্বাস্থ্য প্রশাসনে গতির অভাব আছে। আরেকটি কারণ স্বাস্থ্য প্রশাসনে অ-ডাক্তারদের খবরদারি। স্বাস্থ্য প্রশাসকদের নিজের প্রতি আস্থার অভাব আছে, তাদের প্রশাসনিক ক্ষমতা ও কম। অচিকিৎসক আমলা নির্ভর প্রশাসন চিকিৎসা পরিষেবা নিয়ে specialist দের উপর খবরদারি করার জন্য তাদের মনোবল ও তলানিতে চলে যায়।
অচিকিৎসক প্রশাসক সবকিছুর নির্ণায়ক হওয়ার সবচেয়ে বড় কুফল হল জনস্বাস্থ্য ও শিশু স্বাস্থ্যের সূচকে নিম্নগামীতা। এই রাজ্যে চিকিৎসা পরিষেবার উপর জোর দিতে গিয়ে যে জনস্বাস্থ্যে ঢিলেমি হয়েছে তার নজির ছড়িয়ে আছে সরকারের সাম্প্রতিক প্রকাশিত health status indicator 2018 পুস্তিকাটিতে। এই পুস্তিকা বিশ্লেষণ করে আমাদের মনে হয়েছে বেশ কিছু সমস্যা আছে যা খুব সহজেই মিটিয়ে ফেলা যায়। অনেক ক্ষেত্রে আমাদের উল্খেযোগ্য অগ্রগতি হলেও বিশেষতঃ three antenatal check up, সবকটি immunization dosage নেওয়া, রক্তাল্পতা রোধ, communicable disease যেমন হাম, যক্ষা, ডেঙ্গু, এইসব রোগের প্রাদুর্ভাবে আমরা বেশ পিছিয়ে আছি। অথচ এমনটা হওয়ার কথা নয়। গত বছরে ম্যালেরিয়া, সাপের কামড়ে যত লোক মারা গেছেন তাদের তুলনামূলক ভাবে বেশি সংখ্যক এই রাজ্যের বাসিন্দা। ডায়েরিয়া তে গত বছর 315 জন মারা গেছেন যা মোটেই শ্লাঘার বিষয় নয়। একই কথা প্রযোজ্য শিশু অপুষ্টি ও রক্তাল্পতা ক্ষেত্রে। রাজ্য সরকারী হিসেবে দেখা যাচ্ছে অল্প বিস্তর অপুষ্টি আছে এমন শিশুর সংখ্যা প্রায় 30%। রক্তাল্পতা তিন শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৬২শতাংশ। গতবছর ARI আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা 35লক্ষ যা এমনকি উত্তরপ্রদেশের চেয়ে বেশি। একই অবস্থা হাম ও ডেঙ্গু র ক্ষেত্রে। এইসব লক্ষণ থেকে একথা সহজেই বোঝা যায় যে curative treatment যে লক্ষণীয় উন্নতি হয়েছে preventive ক্ষেত্রে তেমনটি হয় নি। নিছক সমালোচনা করার জন্য এইসব বিষয় উত্থাপন করছি না। এই রাজ্যের স্বাস্থ্য বাজেটের নজিরবিহীন বৃদ্ধির সাথে এই সব সমস্যা সাযুয্যপূর্ণ নয়। প্রশাসনিক ব্যর্থতা ও গয়ংগচ্ছ মনোভাবের জন্য এই অবস্থা তৈরী হয়েছে বলে আমাদের বিশ্বাস।
পরিশেষে বলতে চাই-
UHC র দাবী একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দাবী। এই দাবী পূরণ করার জন্য রাজনৈতিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য চাই শক্তিশালী জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ। আমরা বহুবার প্রকাশ্যে বলেছি এই আন্দোলন দেশের ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতির বিরুদ্ধে একটি আদর্শ শ্লোগান হতে পারে। আমরা চাই, আমাদের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী এই দাবিকে শক্তিশালী রাজনৈতিক অস্ত্রে পরিনতি করুন।
দ্বিতীয়তঃ চিকিৎসকরা কোন অর্থনৈতিক দাবী দাওয়া পেশ করেননি। কোন দল বা সরকারের বিরুদ্ধে ও তাঁরা নন। তাঁদের দাবী সুরক্ষার, মর্যাদার সাথে জীবিকা নির্বাহ করার। অন্যায় আক্রমন ও কলঙ্কের ভারে নুয়ে পড়া চিকিৎসকদের আশার আলো দিয়ে উজ্জীবিত করার প্রয়োজন আছে। যে অপমান ও গালি তাঁদের প্রতি বর্ষন হয়, তা কি তাদের প্রাপ্য? তাদের তলানিতে ঠেকা মনোবল ফেরানোর জন্য কিছু আশু কার্যকরী পদক্ষেপ জরুরী। হামলাকারীদের গ্রেপ্তার ও শাস্তি বিধান তার প্রাথমিক পদক্ষেপ হতে পারে
তৃতীয়তঃ সরকার চটকদারি প্রচারের কথা না ভেবে কম পয়সায় বেশি মানুষকে চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন। বেশি খরচ সর্বস্ব চিকিৎসার জন্য সরকার বিকল্প পথ সন্ধান করতে পারেন। এক্ষেত্রে CSR funds র ব্যবহারের জন্য বেসরকারি ক্ষেত্রকে ব্যবহার করা, বিদেশি প্রজেক্ট গ্রান্ট ইত্যাদি কথাও ভাবা যেতে পারে। আমাদের পরামর্শ হল সরকার নিজেই NHS trust ধাঁচের একটি প্রতিষ্ঠান তৈরী করে corporate donation আহ্বান করতে পারেন।
পরিশেষে আমাদের আবেদন, আমলাদের হাত থেকে স্বাস্থ্য প্রশাসন চিকিৎসকদের হাতে ফেরত দেবার কথা চিন্তা করা হোক। প্রশাসনিক দক্ষতা বাড়ানোর উদ্যোগের পাশাপাশি তাদের ক্ষমতায়ন করা হোক।
চিকিৎসক সমাজের ক্ষোভে ও অভিমান মিটে খেলে তারাই সরকারের সবচেয়ে বড় বন্ধুর ভূমিকা নিতে পারেন।
__________________________

ডা. রেজাউল করীম । পশ্চিম বাংলার প্রখ্যাত চিকিৎসক ; লেখক , কল্যাণ চিন্তক।

আপনার মতামত দিন:


মেডিক্যাল ক্যাম্প এর জনপ্রিয়