Ameen Qudir

Published:
2018-04-07 16:44:53 BdST

শোক এপিটাফবার বার ফেল করা ছেলেটা ঘুরে দাড়াতে পারেনি: কারণ কেউ তার দিকে ঘুরে তাকায়নি


এ ছবি কেবলি স্মৃতিময়। কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের মেধাবী শিক্ষার্থী মেহদী হাসান ফারুক। পরীক্ষার বৈতরণী সঙ্কটে যিনি সরে গেছেন জীবন থেকে। ফাইল ছবি।

ডা.গুলজার হোসেন উজ্জ্বল
______________________________

একটা মাঝারি মানের মেধা নিয়ে কাটিয়ে দিলাম জীবনের অনেকখানি। ক্লাস ফোর পর্যন্ত ফার্স্টবয় ছিলাম। ওখানেই শেষ।

ফোর পর্যন্ত পড়েছিলাম একটা খুব অনগ্রসর গ্রামের স্কুলে। ঐ স্কুলে আমার সাথে যারা পড়েছে তারা কেউ স্কুলের গন্ডিই পেরোয়নি। হাইস্কুলেই ড্রপ আউট। সেখানে ফার্স্ট হওয়া খুব আহামরি কোন সাফল্য না।

হাইস্কুলে থাকতে থার্ড, ফোর্থ হতাম। অনেকে অনেক কথা বলত। মুরুব্বিরা নাম ধাম জিজ্ঞেস করেই বলত ক্লাসে রোল কত? বলতাম চার। অনেকেই বলত "এহহে! ফার্স্ট হওয়া লাগবে তো। " 'এহহে' টা এমন ভাবে বলত যেন আমি কাদায় পড়েছি। এইসব মুরুব্বিদের কথায় তেমন পাত্তা দিতাম না।
আরেক শ্রেনীর মুরুব্বি ছিল যারা বলত " তুমি এক্সট্রা অর্ডিনারি"। আমি এদেরকেও পাত্তা দিতামনা।

আমি যে আসলেই খুব ভাল ছাত্র ছিলামনা তার অনেক নজির ছিল আমার কাছে। আমি কোনদিন ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পাইনি, জেনারেল গ্রেডে পেতাম। ক্লাস নাইনে থাকতে আমি প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় উচ্চতর গণিতে ১৪ পেয়েছিলাম। এরকম ইতিহাস আরো আছে। তবে ফাইনাল পরীক্ষার আগে আগে টানা কিছুদিন পড়ে মোটামুটি একটা সম্মানজনক ফলাফল করতাম। অনেকটা বছর কয়েক আগের বাংলাদেশ দলের ব্যাটিং এর মত। টপ অর্ডার ধ্বসে যাওয়ার পর টেইল এন্ডাররা যেমন শেষ কয়েক ওভার মেরে টেরে কোন রকম একটা মান সম্মান বাঁচানোর মত স্কোর করতো- সেরকম আর কি।

এতকিছুর পরও কোন এক বিচিত্র কারণে কেউ কেউ আমাকে 'অনন্য' বলেছে, 'তুমিই সেরা' বলেছে। আমি এককান দিয়ে শুনেছি আরেক কান দিয়ে বের করেছি।

ইন্টারমিডিয়েটে থাকতে একবার ভাবলাম এবার খুব একটা ভাল রেজাল্ট করা দরকার। সকল প্রকার সামাজিক যোগাযোগ ছেড়ে পড়ালেখা করলাম। লাভ হলোনা তেমন। আমি বুঝে গেলাম আমার একটা লিমিটেশন আছে এটা মেনে নিয়েই আগাতে হবে।

মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষা দিলাম তেমন কিছু না ভেবেই। অনেক মানুষ দেখতে পাব, অনেক জীবনের সাথে সংযোগ ঘটবে বলে এই পেশা ভাল লাগতো। চান্স পেলাম একটা নিম্ন -মাঝারি মানের কলেজে।

মেডিকেলে গিয়ে দেখলাম দুই একজন ছাড়া সবাই অনেক বেশি মেধাবী। এদের সাথে পাল্লা দিয়ে টিকে থাকতে হবে। পঁচিশ বছর পর্যন্ত রেজিস্ট্রেশন থাকে শুনে খুব খুশি হয়েছিলাম। টারগেট ছিল অন্তত দশ বছরেও যদি পাশ করি তাতেই চলবে।

শেষ মেষ দেখলাম অত বেশি লাগেনি। এনাটমির এক লেকচারার বলেছিলেন তোমার সাত বারেও এনাটমি পাশ হবেনা। আমি উনার কথায় দমে যেতে পারতাম, যাইনি।

আমি আমার মত করেই জীবনটাকে উপভোগ করতে চেয়েছি। কারণ আমার কাছে মনে হয়েছে এই মানব জীবনটাই সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। বেঁচে থাকাটাই আসল। বাকি গুলো ফোর্থ সাব্জেক্ট।

####
কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের একটা ছেলে আত্মহত্যা করেছে। অনেকবার ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে সে মেডিসিনে পাশ করতে পারেনি। ফার্স্ট প্রফ সেকেন্ড প্রফ মোটামুটি ঠিকঠাক সময়ে পাশ করেও ফাইনালে এসে আটকে গেছে । একটা সাব্জেক্টেই।

অবশেষে সে বেঁচে থাকাটাই অর্থহীন মনে করল। অথচ এই জীবনটাই ছিল তার জন্য মহার্ঘ্য। জীবনকে সুন্দর করবার জন্যই সে ডাক্তারি পড়তে এসেছিল। ডাক্তার না হয়েও সে বেচে থাকতে পারত। অনেকেই পারে। কিন্তু সমাজের কাছে সে দায়বদ্ধ। এই সমাজের সবাই তাকে অনন্য বলেছে। সে অনন্য বলেই মেডিকেলে চান্স পেয়েছে। এখন পাশ না করলে তার মান সম্মান যাবে। কেউ তাকে শেখালোনা এই জীবনটাই আসল সম্মানের ধন।

######
কোন শিক্ষক কি জানতে চেয়েছিলেন, কেন তার এমন হচ্ছে? যে ছেলেটা এত কিছু পার হয়ে আসল কেন সে মেডিসিনেই খারাপ করছে? নাকি একবার ব্যর্থ হলে তাকে আর কারো কিছু বলবার থাকেনা। "তুমি ব্যর্থ তুমি মরগে। "

বার বার ফেল করা ছেলেটা ঘুরে দাড়াতে পারেনি। কারণ কেউ তার দিকে ঘুরে তাকায়নি। আমরা সব সময় বলি "তুমি সুপার হও, এক্সট্রা অর্ডিনারি হও। নয়তো মর গিয়ে। তোমার বেঁচে থেকে লাভ নেই।"

কথাটা হয়ত এভাবে বলিনা। কিন্তু আসলে এটাই বলি।

####
আমরা জীবনের অর্থ খুঁজি সাফল্যের ভেতর দিয়ে। সব সাফল্যের মানদন্ড আবার একই। প্রতিষ্ঠা, প্রতিপত্তি, অর্থবিত্ত। একজন ডাক্তারকে সফল বলে ধরে নেই যদি সে অনেক বড় প্র‍্যাক্টিশনার হয়, বাড়ি গাড়ি, সম্পদ হয় তবেই। একজন শিক্ষককেও একই ভাবে সফল বলি। একজন ব্যাবসায়ীকেও। অথচ এদের সবার কাজ আলাদা।

যে ছেলেটি সুইসাইড করল তার শিক্ষকরাও নিজেদের সফল ভাবেন। কারণ তারা সমাজে প্রতিষ্ঠিত। অর্থে বিত্তে, মানে, ধনে। শিক্ষক হিসেবে তাঁরা তাঁদের ব্যর্থতার জায়গাটা কোনদিন খুঁজে পাবেননা।
_______________________________

ডা.গুলজার হোসেন উজ্জ্বল । লোকসেবী চিকিৎসক। সুর সাধক ও নিবেদিত প্রাণ শিল্পী । লেখক।

আপনার মতামত দিন:


মেডিক্যাল ক্যাম্প এর জনপ্রিয়