Ameen Qudir
Published:2018-03-27 15:20:42 BdST
" আপনে কেমুন ডাক্তার ! এত সমস্যা, আর ওষুধ দিলেন মাত্র ১ টা !"
ডা. জামান অ্যালেক্স
__________________________________
বিশ্বাসে_মিলায়_বস্তু....
১.
প্রতি শুক্রবার সপ্তাহে এক দিন মাত্র চেম্বার করি। চেম্বার সকাল ৯ টায় স্টার্ট হবার কথা থাকলেও ৮:৩০ টায় হাজির হই। এদিকটায় 'মালাই চা' নামে একধরণের চা পাওয়া যায়, সকাল ৮:৩০ টায় দিনটা শুরু করি মালাই চা'য়ের কাপে আয়েশ করে চুমুক দিয়ে।
এমন এক শুক্রবার সুরুৎ সুরুৎ করে চা খাচ্ছি। হঠাৎ করে শ্বাসকষ্টের এক রোগী রুমে ঢুকে গেলো। যদিও ৯ টা থেকে রোগী দেখি, তবে শ্বাসকষ্টের রোগীকে বসিয়ে রাখা ঠিক না, চায়ের কাপ থেকে রোগীর দিকে মনোযোগ দিলাম....
অ্যাজমার রোগী, দুটো ইনহেলার+ Rescue steroid সহ মোট ৫ ধরণের ওষুধ দিতে হল, প্রয়োজনে হাসপাতালেও ভর্তি হওয়া লাগতে পারে বলে কাউন্সেলিং করে বিদায় দিয়ে আবার চায়ের কাপে চুমুক দেয়া মাত্র বাইরের কিছু কথা কানে আসলো, শান্ত পরিবেশে বাইরের কথা ভালোই শোনা যায়।
বলে নেয়া ভালো- কথোপকথন হচ্ছিলো আমার ঐ অ্যাজমার রোগী আর এক কলা বেচনেওয়ালার মাঝে। এই কলা বেচনেওয়ালার একটু পরিচয় দিয়ে নেই। এই ব্যাটা প্রায়ই আমার চেম্বারের সামনে কলা বিক্রি করে, তবে কলা বিক্রি করার চেয়ে আমার চেম্বারে আগত রোগীকে বিভিন্ন পরামর্শ দেয়ার দিকেই তার মনোযোগ বেশী। কথোপকথন নিম্নরূপঃ
কলা বিক্রেতাঃ (অ্যাজমার রোগীকে)মুর্গীর মত চিঁ চিঁ করতেছেন কেন?...
রোগীঃ সাধে কি আর চিঁ চিঁ করি!আমার নাকি হাঁপানী হইছে, ডাক্তার ৫ টা ওষুধ ধরায় দিলো....
কলা বিক্রেতাঃ "ছুডু ডাক্তার", এরা কিছু বুঝে কন? হেই কারণেই ৫ ওষুধ, পাশের রমিজ ডাক্তারের ( স্যাকমো) কাছে যাইতেন, দেখতেন এক ওষুধে কাম শেষ...
Morning shows the day. মর্নিং শুরু হলো কলা বিক্রেতার "ছুডু ডাক্তার" জাজমেন্ট দিয়ে, সারাদিন আর কি কি শুনতে হয় কে জানে? এসব ছাইপাশ চিন্তা করছি, এমন সময় দ্বিতীয় রোগী রুমে প্রবেশ করলেন, চা তখনও অর্ধেক বাকী...
এ রোগীটা বেশ ইন্টারেস্টিং, তার সব সমস্যা তিনি কাঁপা কাঁপা হাতে কাগজে লিখে নিয়ে এসেছেন । হাত কাঁপা, শারীরিক দুর্বলতা, হাত-পা শক্ত হয়ে যাওয়া, অনিদ্রা, ক্ষুধামন্দাসহ সর্বসাকুল্যে ৮-১০ টা সমস্যা।রোগীর রোগটি Parkinson's disease। আপাতত একটি ওষুধ দিলেই চলবে, প্রেসক্রিপশনে সেটা লিখে রোগী বিদায় দিয়ে এবার সচেতন ভাবেই কান খাড়া করলাম। ওষুধ যেহেতু মোটে ১ টা-মনে মনে তাই একটু আনন্দিত, "ছুডু ডাক্তার" --তকমা এবার ঘুচল বলে। কথোপকথন শুরু হলো....
কলা বিক্রেতাঃ এইডা কেমুন ডাক্তার! এত সমস্যা, আর ওষুধ মাত্র ১ টা!
রোগীর ছেলেঃ আমিও তো তাই কই! গ্যাস্ট্রিক এর ওষুধও তো দেয় নাই।( ফার্মেসীওয়ালার দিকে তাকিয়ে) কি মিয়া! কেমন ডাক্তার রাখছো! যেকোন ওষুধ খাইলেই যে গ্যাস্ট্রিক এর ওষুধ লাগে সেইটাও দেখি জানেনা!
কলা বিক্রেতাঃ "ছুডু ডাক্তার" বুঝছেন, "ছুডু ডাক্তার", রোগ ই ধরতে পারে নাই, ওষুধ দিব কি কন....
মেজাজ খারাপ করে ঠান্ডা হয়ে যাওয়া চায়ের কাপের দিকে তাকিয়ে আছি। শরীরে জ্বলুনি হচ্ছে, বাকী চা টুকু কলা বেচনেওয়ালা ব্যাটার মাথায় ঢালতে পারলে একটা কাজের কাজ হত। মানুষ হিসেবে জন্মেছি, তাও আবার ডাক্তার--মনে মনে চাইলেই অনেক কিছু করা যায় না....
২....
আমি তখন নতুন নতুন চেম্বার করি। ২-৩ মাস যাওয়ার পর দেখি আস্তে আস্তে রোগী কমছে। পাশেই বড় ডাক্তার স্যাকমো রমিজের চেম্বারে ধনন্তরী চিকিৎসা চলে , রোগী সেখানে গিজগিজ করে, আমি আর আমার ফার্মেসীওয়ালা বেহুদা সময় কাটাই...
এভাবে তো স্যাকমো সাহেবের কাছে হার মানা চলে না, আমি আর আমার ফার্মেসীওয়ালা জরুরী মিটিং এ বসলাম, সমস্যা কোথায় তা খুঁজে বের করার জন্য। মিটিং নিম্নরূপঃ
--আশরাফ ভাই, সমস্যাটা কোথায় বলেনতো? রোগী কমছে কেন?
--স্যার, আপনে বেশী ইনভেস্টিগেশন দেন। রোগীরা মনে করে আপনে কমিশন খান...
--কি যন্ত্রণা! আপনি তো জানেন আমি কমিশন খাই না! আর বেশী ইনভেস্টিগেশন কই দিলাম! বইয়ে যা আছে-সেগুলোই তো দেই...
--স্যার, বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করেন। গত সপ্তাহে প্রেশারের ঐ নতুন রোগীটারে ৬ টা পরীক্ষা করতে দিলেন। পরদিন রোগীর ছেলে আইসা আমার সাথে যা তা গালাগালি....
--গালাগালি করার কি হলো! আমাদের যে বই ডেভিডসন-সেখানে তো ৬ টা পরীক্ষার কথাই বলা আছে!
--স্যার, এইসব বইটই ফালান।চিকিৎসা দেন আপনে আর পরের ধাক্কা সামলাইতে হয় আমারে।ঐদিন রোগীর ছেলে এখানে আইসা চিল্লায়ে চিল্লায়ে কইছে, "তোরে আর আর ডাক্তাররে আমি *****"....
--ছিঃ, ছিঃ, চিল্লায়ে চিল্লায় এইসব কথা বলছে!
--আরো খারাপ কথা বলছে স্যার, বলছে....
--থাক থাক, বাদ দেন....
এইসব কথাবার্তা চলছে, মাঝে এক স্মার্ট সুন্দরী তরুণী এলো। মাথায় নাকি ব্যাথা। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করলাম, রোগী কম-তাই Opthalmoscopy ও করলাম। আমার ডায়াগনোসিস ছিলো Tension Type Headache( TTH)।
আমি একগাল হেসে বললাম, 'টেনশন নিয়েন না, তেমন বড় কোন সমস্যা না, ওষুধগুলো খান আর ১ মাস পর দেখা করেন...।'
সুন্দরী তরুণী ভ্রু কুঁচকে সন্দিহান হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, 'কোন পরীক্ষা টরীক্ষা করতে হবে না?'
আমিঃ না, না, কোন পরীক্ষা লাগবে না( মিটিং এর ঠিক পরের রোগী, কাজেই ইনভেস্টিগেশন দেয়ার প্রশ্নই আসেনা, অবশ্য TTH এ কোন পরীক্ষা তেমন লাগেও না)....
তরুণীঃ কোন পরীক্ষা ছাড়াই বলে দিলেন যে বড় কোন সমস্যা নেই! CT scanও লাগবে না? আপনি নিশ্চিত যে এটা ব্রেইন টিউমার না?
আমিঃ(ঢোঁক গিলে)ইয়ে মানে, জ্বি, মোটামুটি নিশ্চিত...
তরুণীঃ আমি তো নেটে দেখলাম-আমার সিম্পটমগুলো সব ব্রেইন টিউমারের, আর আপনি একটা CT scan না করেই বলে দিলেন এটা টেনশন থেকে হচ্ছে! আপনি তো দেখি আইনস্টাইন হয়ে গেছেন...
আমিঃ( ইতঃস্তত করে) আইনস্টাইনের কথা আসছে কেন? উনি তো আর ডাক্তার ছিলেন না!...
তরুণীঃ ইউনিভার্সিটি অব জুরিখ থেকে উনার PhD করা! আর আপনি বলছেন উনি ডাক্তার ছিলেন না!.....
আমি অপ্রস্তুত বোধ করলাম এবং চুপ গেলাম। এই তরুণীর সাথে আরো কিছুক্ষণ কথা বললে সেটার পরিণাম শুভ হবার কথা না...
আপনাদের জানিয়ে রাখি আইনস্টাইনকে ডাক্তার বানানো ঐ তরুণীকে সেদিন CT scan দেইনি বলে উনি আমার অ্যাসিট্যান্ট এর কাছে প্রেসক্রিপশন জমা দিয়ে ভিজিট না দিয়ে চলে গিয়েছিলেন। স্মার্ট তরুণী, ততোধিক স্মার্ট তার কাজকারবার....
ইনভেস্টিগেশন দিলে আমি কমিশনখোর, আবার না দিলে আমি ডাক্তার আইনস্টাইন! এ কি মুছিবতরে বাবা!.....
৩.....
একই রকম সমস্যায় পড়তাম জ্বরের রোগীকে অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া, না দেয়াকে কেন্দ্র করে।১ দিনের জ্বর, ইন ব্রড সেন্স অ্যান্টিবায়োটিক দেয়ার কোন মানে নেই। কিন্তু শুধু প্যারাসিটামল দিয়ে চিকিৎসা দেয়াতে রোগী বলেছিলো, "শ'য়ে শ'য়ে টাকা দিয়া ডাক্তার দেখাইতে আইছি কি ** ****...."
আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন উনি কি ফালাতে চেয়েছিলেন। For God's sake, ভয়ংকর টাইপের এই কথাগুলো সরাসরি আমাকে শুনতে হয় নাই, ঝড় ঝাপটা সব আশরাফ ভাই তখন নিজেই সামলাতেন.....
বিপরীত চিত্রের পাল্লায়ও পড়েছি। এক নৌপরিবহন সংস্থার সাবেক পরিচালক কিংবা মহিপরিচালক পাঁচ দিনের জ্বর নিয়ে এলেন, অ্যান্টিবায়োটিক দেয়াতে নাকের লোম টানতে টানতে উনি প্যাঁচানো কথাবার্তা শুরু করলেন...
--ডাক্তার সাহেব, আপনারাই তো বলেন, ভাইরাল ফিভার অ্যান্টিবায়োটিক দিলে ৭ দিন আর না দিলে ১ সপ্তাহ থাকে। এটাতো ভাইরাল ফিভারও হতে পারে, তাই না?...
--জ্বি পারে, তবে চান্স কম, অন্যান্য সাইন সিম্পটম সুবিধার না। অ্যান্টিবায়োটিকটা শুরু করা উচিত.....
উনি হে হে করে মাথা দুলিয়ে রহস্যময় হাসি দিলেন, যে রহস্যময় হাসির অর্থ হতে পারে--" আমাগোরে এত ভুদাই ভাইবো না, অ্যান্টিবায়োটিকের নামে কোম্পানির সাথে তলে তলে তোমাগো কি চলে সেইটা আমি জানি...."
৪....
আরো অনেক বলা যায়, প্রয়োজন নেই, যারা বোঝার তারা অলরেডী বুঝে গেছেন আমি আসলে কি বলতে চাই।বাঙালি আসলে একটা অদ্ভুত জাতি। এদেশের মানুষের চিকিৎসা দিতে গিয়ে আমার অবজারভেশন নিম্নরূপঃ
--এরা নিজ কাজ বাদে অন্য কাজে মনোযোগ দেয় বেশী ( বেশীরভাগ)। অন্য কাজটা যদি হয় ডাক্তারীবিদ্যা, তবে তো কথাই নেই( উদাহরণঃ কলা বেচনেওয়ালা)...
--যে যে পেশায়ই থাকুক না কেন, চিকিৎসা বিদ্যায় প্রত্যেকের গভীরতা মারিয়ানা ট্রেঞ্চ সমপর্যায়ের (প্রায় শতভাগ)....
--এরা আসলে জানে না এরা কি চায়, ইনভেস্টিগেশনে এদের আপত্তি, না দিলেও এদের আপত্তি, ওষুধে আপত্তি, ওষুধ না দিলেও আপত্তি ( উল্লেখযোগ্য একটি অংশ)
-- এরা কনস্পিরেসী থিওরীতে বিশ্বাসী, বিশেষত ডাক্তারের বিরুদ্ধে। (উল্লেখযোগ্য একটি অংশ, তৃতীয় উদাহরণ দ্রষ্টব্য )...
৫....
আমি স্বীকার করি-এ পেশায় একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নীতিহীন চিকিৎসক রয়েছে, নিজের চোখেও এদের বেশ দেখা হয়েছে।পচন যখন সর্বগ্রাসী এবং সর্বসেক্টরব্যাপী, তখন তা এ পেশার কিছু লোককেও গ্রাস করবে এবং সেটাই স্বাভাবিক। এই জায়গাটায় আমাদের কাজ করে যেতে হবে। সমস্যা থাকবে, সেটাকে উস্কে না দিয়ে গঠনমূলক সমালোচনা করা শ্রেয়, অর্থবহ এবং মানসিক সুস্থতার পরিচায়ক।গঠনমূলক সমালোচনাকে পাশ কাটিয়ে চিকিৎসক সংক্রান্ত যে কোন নেগেটিভ নিউজকে আপনি যখন ধ্বংসাত্মক ভঙ্গিমায় প্রেজেন্ট করেন, তখন সেটি কিন্তু আসলে আপনার মনের কদর্য রূপকেই প্রকাশ করে....
চিকিৎসকরা এদেশেরই সন্তান, এদেশের আলো হাওয়ায় এরা বেড়ে উঠেন।মানবসেবার ব্রত নিয়ে যারা চিকিৎসক হন, তারা সবাই অযাচিতভাবে এদেশের মানুষকে হয়রানি করেন, অপ্রয়োজনীয় ওষুধ লেখেন, কমিশনের জন্য ইনভেস্টিগেশন লেখেন, প্রতিনিয়ত ভুল চিকিৎসা করেন--এমন ধারণা করাটা ঠিক না....
এদেশের আপামর জনতার সবধরণের মুক্তির বারতা বয়ে আনার যে এদিন যে রক্তগঙ্গার স্রোত বয়ে গিয়েছিলো, সেখানে অনেক চিকিৎসকের রক্তও কি শামিল হয়নি? সেই রক্তের উত্তরসূরী যারা- তাদের এত সহজে অবিশ্বাস করা চলে? সেই রক্তগঙ্গার মূল্য কিন্তু আপনাদের দিতে হবে।আমাদের উপর বিশ্বাস রাখুন, আমি নিশ্চিত, শারীরিক সুস্থতার বিজয়ের সূর্য একদিন আপনারা উদিত হতে দেখবেন....
______________________________
ডা. জামান অ্যালেক্স । লোকসেবী চিকিৎসক। সুলেখক।
আপনার মতামত দিন: