Ameen Qudir

Published:
2018-03-17 18:20:12 BdST

ডক্টরস লাইফ সাইকেল


 

ডা. মিথিলা ফেরদৌস
__________________________

মেডিকেলে এডমিশন টেস্টে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পর মেডিকেলে টিকে সবাই ভাবে হাফ ছেড়ে বাচা গেলো।ঘটনা ভিন্ন।শুরু হয় জীবনের সবচেয়ে কঠিন লড়াই,এরপর স্টেপ বাই স্টেপ কঠিন হতে থাকে।এ লড়াই চলেই মৃত্যুর আগ পর্যন্ত।

অসংখ্য আইটেম,কার্ড ফাইনাল,ইয়ার ফাইনাল,প্রফ নাকাল অবস্থা।এইসব স্টেপে কেউ কেউ আর মানসিক ভাবে নিজেকে স্থির রাখতে পারেনা।সম্প্রতি পর পর কয়েকটা সুইসাইডের ঘটনাও ঘটেছে।আমার পরিচিত এক মেয়ের বাবা নাই,ঢাকার নামকরা একটা সরকারি মেডিকেলেই পড়ে।প্রায়ই হতাশ হয়ে মাকে 'হুমকি দেয়,সে সুইসাইড করবে।মায়ের অবস্থাও পাগলের মত।
আসলে মেডিকেলে একটা স্টেজে এসে এইটা ছেড়ে দেয়ার উপায় থাকেনা,আবার টেনে নিয়ে যাওয়াও কঠিন হয়ে পরে।কমবেশি সবাই হতাশায় ভোগে তখন।

মেডিকেলে বেশির ভাগই মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসে।ফলে পাশ করার পর তার উপর একটা চাপ আপনাতেই চলে আসে।৫ বছর খরচ টেনেছে পরিবার।তারাও আশা করে,এবার সংসারের হাল ধরুক,তারা বোঝে না,এইটাই সবে শুরু।অবশ্য আর কত বুঝবে তারা?ইন্টার্নিতে কিছু ইনকাম,কিছু স্বস্তি হলেও ইন্টার্নের পরেই যুদ্ধের মুল অংশে চলে আসে।

একদিকে বিসিএস এর পড়া, অপরদিকে ডিগ্রির জন্যে পড়া,তারসাথে ক্লিনিকে ডিউটি(সবচেয়ে অসম্মানজনক ডিউটি),সংসার খরচ চালানো।কেউ এই পর্যায়ে বিয়ে করলে তো অথৈ সমুদ্রে পরে যায়।

ধরলাম বি সি এস টা হয়েই গেলো,কোন রিমোট অঞ্চলে গিয়ে থাকতে হবে পরিবার পরিজন ফেলে।মোকাবেলা করতে হবে এলাকার মাতব্বরদের।এরমধ্যেই পড়াশুনা,ডিগ্রিতে চান্স পাওয়া,ট্রেনিং পোস্টে এসে দিন রাত এক করে ডিউটি,পড়াশুনা,বেতনের সামান্য টাকায় সংসার চালানো,বাবা মা চালানো,নিজেকে চালানো।

ধরলাম বি সি এস হলোনা,আমাদের ভাষায় বলে খেপ মারা।সপ্তাহে দুইদিন ক্ষ্যাপ মারতে হয়,ক্লিনিক নামক কোন এক অন্ধকুপে।যেখানে ৪৮ ঘন্টা ঘুম নাই,তটস্থ থাকতে হয়,এই ওটি,এই ইমার্জেন্সি রুগীর ম্যানেজ,রুগীর ফলো আপ।এই দুইদিনের ইনকামে চলে সংসার,সবার মুখ বেজাড়।এই ছেলে বা মেয়েকে যেতে হয়,অনারারি নামক এক মধ্যযুগীয় বর্বরতার মধ্য দিয়ে।উলটা টাকা দিয়ে ট্রেনিং।হাসপাতালে সবার মতই ডিউটি করতে হয়।কিন্তু মাস শেষ কোন বেতন সে পায়না।তার কষ্ট কেউ বুঝবেনা।পৃথিবীর কোন দেশেই এই ফালতু প্রথা নাই।

এরপর আছে পড়াশুনা,ডিগ্রি কম্পলিটের ব্যাপার।পাশ করানো মালিকরা উপরের ওইসব কষ্টগুলো বুঝেও বুঝতে চাননা,যতটা সম্ভব কম পাশ করানো যায় তার প্রতিযোগিতা চলে।এর মধ্যেই যারা বেড়িয়ে যায়,তারা এইটুকু মানসিক শান্তি পায়, যারা ফেল করছে তাদের দেখে,তাদের দেখে একটা নাক ছিটকানো ভাব দেখায় যতটুকু শান্তি পায়,তা বাদে তাদের জীবনও সুখের নাই।প্রাক্টিস,প্রমোশন। প্রাক্টিস উপরের দিকে স্যারদের দখলে,নিচের দিকে কোয়াক ফার্মেসীআলাদের দখলে। এত কষ্ট করেও শান্তি নাই।আর প্রমোশন!!ডাক্তারদের প্রমোশন, সে তো আরেক প্রহসন।

যারা ডিগ্রি কম্পলিট করতে পারেন না,তাদের রাগ, দুখ,ক্ষোভ স্যারদের উপর ঝেড়ে স্বান্তনা নিয়ে বসে থাকা ছাড়া উপায় নাই।কারণ পেট চালানোর ধান্দায় পড়াশুনাটায় তেমন সুবিধা করা যায় না।সেই পড়া দিয়ে স্যারদের চালুনীতে উঠে আসা সম্ভব না।

হাতে গনা খুব কম ডাক্তারদের একসময় বিত্তশালী হতে পারেন,যখন টাকার এক অংশ খরচ হয়,নিজেরই রোগ বালাইয়ের পিছনে।সারাজীবন অতিরিক্ত টেনসানে যখন টাকাপয়সা দিয়ে জীবনটাকে উপভোগ করা যেতো তখন হার্ট দুর্বল,ডায়াবেটিস এ খাওয়ায় রেস্ট্রিকসান,আরথ্রাটিসে ঘোরার রেসট্রিকসান।এরপরে একদিন মৃত্যু এসে যায় তার স্বাভাবিক নিয়মে।

একটা ডাক্তার তার সারাজীবন তার ব্যাগে একটা বই নিয়েই ঘুরেন,পড়াশুনা নিয়েই জীবন পার করে দেন,পড়াশুনা করেন রুগীর সেবার জন্যে।তবুও যে কেন কেউ আপন করে নিতে পারেনা?

সম্প্রতি যে একজন ডাক্তার প্লেন দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে চোখ খুলেই তার বউয়ের কথা জানতে চায়(সে জানেনা তার প্রিয় বউ আর পৃথিবীতে নেই)এই কথা শুনে যেকোন পাষান্ডর চোখ ভিজে যাওয়ার কথা।তাকেও নিয়েও যখন বাজে কমেন্ট দেখি তখন মনে হয় আসলে কারা অমানুষ ডাক্তাররা নাকি তারা? তারা বা তাদের স্বজনরা কি কখনও কোন ও ডাক্তারের কাছে উপকার পান নাই ?ভাই জানোয়ারও আপনাদের দেখলে লজ্জা পাবে।নিজেকে এত নীচে নামানোর আগে উপরের ডাক্তারদের পুরা জীবনটা একবার পড়ে দেখুন।

ডা. মিথিলা ফেরদৌস । সুলেখক।

আপনার মতামত দিন:


মেডিক্যাল ক্যাম্প এর জনপ্রিয়