Ameen Qudir

Published:
2017-07-19 17:32:45 BdST

‘আমার মেয়ে বড় বিপদে আছে ’


 

 

 

ডা. রাজীব হোসাইন সরকার
________________________


আমার সামনে যে ভদ্রলোক মেয়ের বিপদ নিয়ে অস্থির, তার নাম- নাজমুস সাবের। নাজমুস সাবেরের বয়স আনুমানিক চল্লিশ। মাথার চুল পেকে ধবধবে সাদা। চুল পাকাপাকির ব্যাপারটি মাথাতেই সীমাবদ্ধ। গোফ স্পর্শ করেনি। গোফের রঙ মিশমিশে কালো।
সাবের সাহেব বেশ রুচিবান লোক। প্রচন্ড শীতেও শুধু সিল্ক রোডের কোর্ট পরে আছেন। গলায় সাদাকালো টাই। মুরগীর ব্যাপারীদের মতো কানে মাফলার বা কানটুপি পেঁচানো নেই। আমি ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করলাম,
‘আপনার মেয়ের বড় বিপদের নাম কি?
‘ও খুব কালো।’
‘নিজের মেয়েকে কালো বলতে খারাপ লাগছে না?’
‘জ্বি লাগছে। কেউ আপন মেয়েকে কালো বলে না। শ্যামলা বলে কোনমতে চালিয়ে নেয়। আমি পারি না। ও সত্যিই কালো।’
‘ও ও করছেন কেন? আপনার মেয়ের নাম নেই?’
‘আছে।’
‘নাম বলুন।’
‘ওর নাম তুতু।’
‘ভালো নাম নেই?’
‘না নেই। আমার মা নাতনীর জন্মের আগে ঠিক করেছিলেন, নাতনীর নাম রাখবেন তিতলি। নাতনী হলো কালো। তিনি মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে নাম রাখলেন-তুতু।’
‘মানুষ কুকুরের ছানাকে তুতু বলে ডাকাডাকি করে। বেশ বিব্রতকর নাম। তুতু নামের শানে নুযুল আপনার মেয়ে জানে?’
‘জ্বি জানে। আমার মা এখনো বড় আনন্দ নিয়ে এই গল্প সবার সাথে করে। তুতু ডাকার জন্য সে তার দাদির সাথে পাঁচ বছর হল কথা বলে না। আমি নামটাকে কিছুটা মানানসই করেছি। তুতুন বলে ডাকি।’
‘তুতুনের সমস্যা কি?’
‘সমস্যা বেশ বড়। তুতুন এ-লেভেলে পড়ে। বাংলা ঠিকঠাক বলতে পারে না।’
‘বাংলা পারে না----এই সমস্যার সমাধান করবে প্রাইভেট টিউটর। আমার কাছে কেন এসেছেন?’
‘তুতুনের সমস্যা আরো বড়।’
‘সমস্যা বলুন। মরা ডালপালা দেখালে লাভ হবে? গাছের গোড়া দেখান। পানি সেখানেই ঢালতে হবে।’

নাজমুস সাবের লজ্জা পেলেন।
ভদ্রলোক বেশ বুদ্ধিমান। লজ্জা চেহারায় ফুটে উঠতে দিলেন না। কায়দা করে লুকিয়ে ফেললেন। যেটা লুকাতে পারলেন না সেটাও শক্ত অনুভূতি। সেই অনুভূতির নাম অসহায়ত্ব।

‘আমার একটাই মেয়ে। ও কিছুদিন ধরে দরজা বন্ধ করে থাকে। গত সপ্তাহে আমার কাজের মেয়েটা ঘর ঝাড়ু দিতে গিয়ে দুই পাতা ক্লোনাজিপাম ট্যাবলেট আবিষ্কার করে। তুতুনের লেপের তলায় ছিল। আমার ধারণা----সে এটা খেয়ে সুইসাইড করবে।’
‘ক্লোনাজিপাম দুই পাতা খেয়ে কেউ মরে না। ভয় পাবেন না। বাসায় চলে যান।’
‘আরো কিছু ব্যাপার আছে।’
‘বলুন, কি কি ব্যাপার আছে? আলিফ লায়লার মত আগের পর্ব, পরের পর্ব করবেন না। বিরক্ত লাগছে।’

প্রচণ্ড শীতেও নাজমুস সাবের ঘামছেন। ঘামের উপস্থিতি নির্দেশ করছে- ভদ্রলোক বেশ বড় ঝামেলায় আছেন। দুই পাতা ক্লোনাজিপাম কোন বিষয় নয়। বিষয় অন্য কিছু। সেই অন্য কিছুটা কি?
নাজমুস সাবের গলার টাই এর নট ধরে টানাটানি করে ঢিলা করতে চেষ্টা করলেন। টাই ঢিলা হল না। আরো চেপে বসল।
‘তুতুন কিছুদিন আগে আমাকে এসে বলল----আর ক্লাশে যাবে না।’
‘কেন?’
‘কারণ তার ক্লাসমেটরা তাকে নিয়ে হাসাহাসি করছে। তাকে নিয়ে একটা ছন্দ বানিয়েছে।’
‘কি ছন্দ?’
‘Diamonds are carbon, coals are carbon…Tutun is a coal, valuable carbon. আমি কি বঙ্গানুবাদ করব?’
‘না করতে হবে না। তার বন্ধুরা তাকে মহামূল্য কয়লা বলে মজা নিচ্ছে।’
‘জ্বি। ঠিক। এর পর থেকে সে ক্লাশে যাচ্ছে না। সারাদিন বাসায় বসে থাকে। কান্নাকাটি করে।’
‘কালো অনেকেই হয়। এটা নিয়ে কান্নাকাটির কারণ কি?’
‘আমি বুঝতে পারছি না, কেন কান্নাকাটি করে। আমার ধারণা, সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, সুইসাইড করবে।’
‘মেয়ের সিদ্ধান্তের কথা কিভাবে আগে জেনে গেলেন?’
‘আমি জানি না।’
‘না জানলে হবে না। কিভাবে জেনে গেলেন বলুন।’
‘আমি জানি না।’
‘আপনি তাহলে কি জানেন?’
ভদ্রলোক জবাব দিতে পারলেন না। কিছুক্ষন বিড়বিড় করে কিছু শব্দ করলেন। অনুরোধের মত করে বললেন,
‘আপনি কি আমার মেয়েটাকে একটু গিয়ে দেখবেন?’
‘আমি দেখে কি হবে? আপনি সাইকিয়াট্রিস্ট দেখান।’
‘সাইকিয়াট্রিস্ট দেখিয়েছি। একজন প্রতি সপ্তাহে বাসায় এসে দেখে যাচ্ছেন। তবুও কাজ হচ্ছে না।’
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,
‘কাজ না হলে আমি কি করব?’
‘আমার ধারণা, আপনি দেখলে তুতুন সুস্থ্য হয়ে যাবে।’
‘এই ধারণার উৎস কি?’
নাজমুস সাবের দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
‘জানি না।’

সাবের সাহেব বেশ দীর্ঘ আলোচনার চেষ্টা চালালেন। একমনে তুতুনের পছন্দ অপছন্দ নিয়ে বিষদ আলোচনা করলেন। পছন্দের মধ্যে কবিতা, গান কোন কিছুই বাদ দিলেন না। খুটেখুটে বললেন।
আমি আলোচনায় আগ্রহ পাচ্ছি না। আধোশোয়া হয়ে আমার শোবার ঘরের বিছানায় বসে আছি। শোবার ঘর বলে আমার সুনির্দিষ্ট কোন ঘর নেই। যে ঘরে রান্না করি, সে ঘরেই ঘুমাই। এই ঘরকে ‘শয়ন্না’ ঘরও বলা যায়। একই সাথে শয়ন ও রান্না----শয়ন্না।
আমার হাতে রাশিয়ার জাতীয় কবি আলেকজান্ডার পুশকিনের কবিতাসমগ্র। আমার সমস্ত চিন্তাভাবনা পুশকিনের একটি বিশেষ কবিতাকে কেন্দ্র করে ঘোরাঘুরি করছে। বিশেষ কবিতায় পুশকিন বলেছেন, I love you and probably still do.
বড় বেদনার কবিতা। মহামতি পুশকিন কবিতার মাধ্যমে প্রেয়সীকে বলেছেন, এখনো ভালোবাসি হয়তো কিন্তু তোমার কোন যন্ত্রনার কারণ হতে চাই না। বড় নৈরাশ্যের কবিতা।

আমি এই বিশেষ কবিতাটির আগাগোড়া ইতিহাস ঘাটছি। কবিতা লেখা হয়েছিল রুশ ভাষায়। রুশ ভাষায় আমার দখল নেই। আমার কিঞ্চিত দখল আছে ইংরেজিতে। জেনিয়া গুরারিকে ধন্যবাদ। জেনিয়া গুরারি চমৎকার নৈরাশ্যের একটি কবিতাকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন।
সাবের সাহেব এখনো বিড়বিড় করেই যাচ্ছেন। আমি পুশকিনে ডুবে আছি। পুশকিন পড়তে পড়তে কিছু অস্পষ্ট শব্দ কানে আসছে। সাবের সাহেব বলছেন, ম্যাজিক...জীবনানন্দ...কবিতা...মুখস্ত...প্রেম...একাকীত্ব...
বিশৃংখল শব্দ। মনোযোগ না দিয়ে এইসকল শব্দের গুঢ় রহস্য উদ্ধার করা অসম্ভব। আমি অসম্ভব রহস্য বাদ দিয়ে পুশকিনে মনোযোগ দিলাম।


নাজমুস সাবেরের সাথে আমার স্বাক্ষাত হবার একমাস পেরিয়ে গেছে।
এর মধ্যেই তিনি কয়েকবার মোবাইলফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছেন। বিশটার মত দীর্ঘ ইমেইল করেছেন। আমি অগোছালো মানুষ। ইমেইল দেখলাম একমাসের মাথায়। মোবাইলে যোগাযোগ করব করব ভেবে দুই মাস পার করে দিলাম। তৃতীয় মাসের মাথায় সেগুনবাগিচায় উপস্থিত হলাম।

শিল্পকলার সামনে বিশতলা বিশাল নীল দালান। কড়া নীল নয়। শরতের আকাশ দুপুরে যেমন নীল হয়, তেমন হালকা টানের নীল। পঞ্চম তলায় নাজমুস সাবের থাকেন। বিশাল শিল্পপতি মানুষ। গাজীপুরের ঐদিকে তিনটা গার্মেন্টস আছে।
সাবের সাহেবের দ্বিতীয় দর্শনে আমি মোটামুটি চমকে গেলাম। ভদ্রলোক আগে বেশ গোছানো ছিলেন। এখন তার চুল উষ্কখুষ্ক। চোখ লাল। ফোলা ফোলা। সেখানে মারাত্মক ভয়ের চিহ্ন।
নাজমুস সাবেরকে জিজ্ঞাসা করলাম,
‘আপনার মেয়ে কোথায়?’
নাজমুস সাবের আঙ্গুল তুলে একটা ঘরের দিকে দেখালেন। হুড়হুড় করে বললেন,
‘ও তিনদিন থেকে কিছু খায়নি। অনেক বুঝিয়েছি। অনুরোধ করেছি। খাচ্ছে না।’
‘আপনার স্ত্রী নেই?’
‘না নেই।’
‘মারা গেছেন?’
‘না। পাঁচ বছর আগে আমার এক বন্ধুকে বিয়ে করে আমেরিকায় চলে গেছে। এখন আমি মেয়েকে নিয়ে আছি বড় ঝামেলায়।’
‘নিজের মেয়েকে ঝামেলা বলছেন কেন?’
সাবের সাহেব কেঁদে ফেললেন। ছোট মেয়েদের মতো। কান্না বিজড়িত ভারী কন্ঠে বললেন,
‘নাজীব সাহেব, ও ছাড়া আমার কেউ নাই। প্লিজ একটু দেখেন।’

আমি দরজার সামনে দাড়ালাম।
ঠকঠক করে আওয়াজ করলাম। দরজা খুলে গেল।
সাবের সাহেবের কথা সত্য। তার মেয়ের গায়ের রঙ্গ কালো। অতিরিক্তরকম কালো। মাথায় অল্প চুল। এত অল্প চুলে মেয়েদের খুবই বাজে লাগার কথা। আমাকে দেখে মৃদ্যু হাসল। হাসিতে সামনের দাতগুলো বের হয়ে আসল। দাতেও গণ্ডগোল। একটার উপর আরেকটা উঠে বসে আছে। একটা দাত কালো। আমি চোখেমুখে বেশ দুশ্চিন্তা নিয়ে বললাম,
‘তিতলি, তুমি ব্যস্ত আছো?’
তুতুনের হাসি উধাও। চোখভরা বিস্ময়। বিস্ময় নিয়ে আমাকে বলল,
‘আমি তুতুন। তিতলি কে?’
‘ওহ। ভুল হয়েছে। আমি আসি।’
তুতুন বিরক্ত হয়ে বলল,
‘কি জন্য নক করেছেন?’
আমি চোখেমুখের দুশ্চিন্তা কিছুটা বাড়িয়ে বললাম,
‘আমি তোমার পাশের বাসায় থাকি। মাঝেমাঝে তোমার বাবার সাথে দেখা হয়। আজকেও দেখা হল।’
‘কথা বাড়াবেন না। দরজায় নক করেছেন কেন?’
‘তোমার মোবাইলে কি ডেটা আছে?’
‘আছে। কেন?’
আমি হাফ ছেড়ে বাঁচার ভঙ্গিমা করলাম।
‘একটু গুগল করো তো, মেলানোসাইট বেশি থাকলে স্কিন ক্যান্সার কম না বেশি হয়----জরুরী জানা দরকার।’
‘মেলানোসাইট কি?’
‘মেলানোসাইট ত্বকে থাকে। এটা বেশি থাকলে মানুষ কালো হয়, কম থাকলে সাদা হয়। আমার প্রশ্ন হল- বেশি থাকার সাথে ক্যান্সারের সম্পর্ক কতটুকু?’

তুতুন প্রচন্ড রাগ নিয়ে দরজা দুম করে বন্ধ করল। আমার ধারনা-সে নিজের বর্নের ব্যাপারটি নিয়ে আরেকবার আঘাত পেল। আঘাত পেলে পাবে। আমার সূক্ষ্ম উদ্দেশ্য ছিল- তাকে রাগিয়ে দেওয়া। আমি রাগিয়ে দিতে পেরেছি।

ফ্রয়েড সাহেবের মতে- তুতুন আমার উপর প্রচন্ডরকম রাগ নিয়ে এখন মোবাইল খুলে গুগল করবে। সে মিলিয়ে দেখবে মেলানোসাইটের সাথে ক্যান্সারের সম্পর্ক কতটুকু। আমি জানি, জবাব পাবার পর সে ভ্রুঁ কুচকাবে। বিস্ময় নিয়ে দেখবে, মেলানোসাইট বেশি থাকলে ক্যান্সার হবার সুযোগ অল্প। কালোদের স্কীন ক্যান্সার হবার সম্ভাবনা সাদাদের তুলনায় অল্প। এই তথ্য দেখার পর তুতুনের রাগ ধুপ করে পড়ে যাবে। হঠাৎ রাগহীন জগতে সে এক ধরণের মায়া নিয়ে আমার কথা ভাববে। কেন লোকটাকে রাগ দেখালাম? আহারে! কত দুশ্চিন্তা নিয়ে আমার কাছে এসেছিল।
আমি এই সময়ের অপেক্ষায়।

তুতুন দরজা খুলল রাত দশটায়। বেসিনে হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসল। খেতে বসে সাবের সাহেবকে বলল,
‘বাবা, একটা পোড়াবেগুন ভাজি করে দাও তো। মা ভালো বেগুনভাজি করত। অনেকদিন খাই না।’
সাবের সাহেব আরেকবার বাচ্চাদের মত কেঁদে ফেললেন।
‘বাবা, কাঁদবে না। বড় মানুষের কান্না দেখলে বিরক্ত লাগে। ঐ লোকটা কে ছিল?’
সাবের সাহেব কান্না থামিয়ে বললেন,
‘কোন লোকটারে মা?’
‘আমার দরজায় যে নক করল, সেই লোক।’
সাবের সাহেব ব্যাপারটাকে উড়িয়ে দিয়ে বললেন,
‘উনি ম্যাজিশিয়ান। ম্যাজিক ট্যাজিক দেখান। পার্কে ঘোরাঘুরি করেন। ভালো লোক। জানেন অনেক। বেশ দরিদ্র।’
‘তুমি তাকে দরিদ্র বলছ কেন?’
‘সরি মা।’
‘উনি কি আবার আসবেন?’
‘কেন রে মা?’
তুতুন জবাব দিল না।

শোবার সময় তুতুন দুম করে দরজা বন্ধ করে দিল। সাবের সাহেব অস্থির হয়ে টেলিফোন করলেন।
‘নাজীব সাহেব।’
‘বলুন।’
‘তুতুন রাতে ভাত খেয়েছে।’
‘আশ্চর্য! খাচ্ছে কি খাচ্ছে না, এটা আমাকে বলছেন কেন?’
‘তাইতো। কেন আপনাকে বলছি? সরি।’
‘সাবের সাহেব।’
‘জ্বি।’
‘আপনার এখন ভালো লাগছে?’
‘জ্বি ভালো লাগছে। তবে ভয়ও লাগছে।’
‘কেন?’
‘তুতুন দরজা বন্ধ করেছে।’
‘আশ্চর্য! দরজা বন্ধ করলে ভয় পাবেন কেন?’
সাবের সাহেব দ্বীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
‘ওহ। তাইতো। কেন ভয় পাবো?’


ভোরে তুতুনকে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করা হল।
বাম হাত ভর্তি হ্যাজিটেশন কাট (Hesitation cut)। ব্লেড দিয়ে অনেকবার টান দেওয়া। অল্পের জন্য রেডিয়াল আর্টারি আলাদা হয়নি।
আমি হাসপাতালে পৌছলাম বিকেলে। সাবের সাহেব এটেডেন্স রুমে বসে আছেন। তার চোখ আগের চেয়ে বেশি লাল। উদভ্রান্ত দৃষ্টি। সাবের সাহেব আমার হাত ধরে ফেললেন।
‘নাজীব সাহেব, কি করব কিছু একটা বলুন। আমার একটায় মেয়ে।’
আমি হাসিমুখে জবাব দিলাম,
‘ব্লিচিং করে আনুন। কালো মানুষ সাদা হয়ে যাবে।’
‘ব্লিচিং কি?’
‘কিছু না।’

তুতুন বিছানায়। আধশোয়া।
বাম হাতে সাদা রোল ব্যান্ডেজ। কনুই থেকে কবজি পর্যন্ত। মুখভরা হাসি ঝুলে আছে। আমাকে দেখে তুতুন তেমন প্রতিক্রিয়া দেখাল না। এমনভাবে তাকালো যেন আমি তাকে প্রতিদিন এভাবে দেখতে আসি। দুচারটা ভালোমন্দ কথা বলে বিদায় নিই।
তুতুনের মুখভরা হাসি নিয়ে জিজ্ঞাসা করল,
‘আপনার প্রশ্নের জবাব পেয়েছেন?’
‘কোন প্রশ্ন?’
‘মেলানোসাইট না কি যেন?’
‘আমি পেয়েছি কি না সেটা গুরুত্বপুর্ণ নয়। তুমি পেয়েছ?’
‘জ্বি পেয়েছি। বলব?’
‘না, বলতে হবে না।’
তুতুন ভ্রুঁ কুচকে ফেলল। ভ্রুঁ কুঁচকানো অবস্থায় তুতুনকে বেশ চমৎকার লাগছে। আমি বললাম,
‘কাল সময় হবে তোমার?’
‘কেন?’
‘কাল আমার ম্যাজিক শো আছে।’
তুতুন অতিরিক্ত আগ্রহ নিয়ে বলল,
‘কখন শো?’
‘সেটা বলা যাবে না। তুমি দেখতে চাও?’
তুতুন চোখ নামালো। কোন জবাব দিল না।

তুতুনের স্বাভাবিক কর্মাকান্ড দেখে অনুমান করা যায়, তার বাইপোলার ডিজর্ডার (Bipolar Disorder) আছে। বাইপোলার রোগীরা বড় ভয়ংকর। কখনো প্রচন্ড হাসাহাসি করবে। সবকিছুতেই আনন্দ পাবে। নাচবে, গাইবে। যখন মন খারাপ করবে তখন অতিরিক্তরকম মন খারাপ করে বসে থাকবে। তাদের চোখ দেখে বোঝা যাবে না, আত্মহত্যার মত ভয়াবহ একটি পরিকল্পনা তাদের মাথার ভেতর ঘুরে বেড়াচ্ছে।।
আমার দৃষ্টিতে- তুতুন একজন ভয়ংকর রোগী।

তুতুনের এই বিচিত্র রোগের পেছনে যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে।
প্রথমতঃ তার গায়ের রঙ কালো।
কালো রঙ অস্বাভাবিক কিছু নয়। ব্যাপারটিকে অস্বাভাবিক করা হয়েছে। সাবের সাহেবের মা বেশ যত্ন নিয়ে তার নাতনীকে অপদস্ত করেছেন। কালো বলে তার নাতনীর নাম বদলে ফেলেছেন। এই ব্যাপারটি আগ্রহের সাথে সবার সাথে গল্প করেছেন। তুতুন ব্যাপারটি শুনতে শুনতে বড় হয়েছে। একসময় তার মাথায় স্থায়ীভাবে গেথে গেল----কালো মানে খারাপ কিছু। মানুষের মাঝে সে আলাদা একটি জাত।
তুতুন ব্যাপারটিকে সহজভাবে নিতে পারেনি। নিল কঠিনভাবে। তার ধারণা- সে অসুন্দর। অসুন্দরদের প্রতি মানুষের আগ্রহ কম। তারা মূল্যহীন।

দ্বিতীয়তঃ বড় আঘাতটি আসে ক্লাশমেটদের কাছ থেকে।
ক্লাশমেটরা তুতুনকে কয়লার সাথে মিলিয়ে ছন্দ বানিয়েছে। মানুষ বন্ধুদের কাছ থেকে অল্প সহানুভুতি আশা করে। এটা অপরাধ নয়। তুতুনও সহানুভুতি আশা করেছে। পায়নি। দাদীর অপবাদটি দৃঢ় হয়ে তার উপর চড়ে বসেছে।

তুতুন বড় কঠিন সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। তার সাথে আমার বিস্তারিত কথা হয়নি। তার আত্মহত্যার আরো অনেক কারণ থাকতে পারে। কথা না বলে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যাচ্ছে না।
তুতুন আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞাসা করল,
‘ম্যাজিক শো তে কারা আসবে?’
‘কারা আসবে এখন বলব না। কিছু রহস্য থাকুক।’
তুতুন বেশ অস্থিরতার সাথে বলল,
‘আপনি শো তে আমাকে নিয়ে যাবেন?’
আমি এই প্রশ্নের অপেক্ষায় ছিলাম। এটা এক ধরণের ফাঁদ। তুতুন ফাঁদে পা দিয়েছে।
‘অবশ্যই নিয়ে যাবো। তবে শর্ত আছে।’
তুতুন ভ্রুঁ কুঁচকে বলল,
‘শর্ত কি?’
আমি বললাম,
‘আমি তোমাকে আমার তিনটি গোপন কষ্টের কথা বলব। তুমি আমাকে তিনটি গোপন কষ্টের কথা বলবে। যদি আমার থেকে তোমার কথাগুলো বেশি কষ্টের হয়, তাহলে শো তে নিয়ে যাবো।’
তুতুন ভ্রুঁ কুচকে বলল,
‘এটা কি আপনার কোন খেলা?’
‘হ্যা তুতুন, এটা আমার খেলা।’
‘যদি আপনি জিতে যান?’
‘তোমাকে নিয়ে যাবো না। আমি একা যাবো।’
তুতুন হেসে বলল,
‘আচ্ছা। আপনি আগে বলুন। এরপর আমি বলব।’
আমি ধীর কন্ঠে বেশ সময় নিয়ে বললাম,
‘আমার কোন মেয়ে নেই। আমার মেয়েকে আমি নিজ হাতে তুলে খাইয়ে দিতে পারি না। আমার মেয়ে আমাকে তার হাতে তুলে খাওয়ায় না।’
তুতুন ভ্রুঁ কুঁচকে বলল,
‘এগুলো আপনার কষ্ট?’
‘হ্যা। এগুলো আমার কষ্ট।’
‘আমার গোপন তিনটি কষ্ট হল---- আমার স্মৃতিশক্তি খুবই দূর্বল। আমি অসুন্দর। সবাই আমার দিকে সহানুভুতির দৃষ্টিতে আমাকে কেউ কোনদিন পছন্দ করে বলবে না-আমি তোমাকে ছাড়া একদিনও থাকতে পারব না।।’
‘চারটা কষ্ট?’
‘জ্বি।’

আমি বললাম,
‘তুতুন, তুমি জিতে গেছো।’
‘কিভাবে?’
‘আমার মনে হয়েছে, তাই।’


উদ্দেশ্য বেইলী রোড।
গাড়ি বজ্রের মত ছুটছে। মতিঝিলের এদিকটায় ভালো জ্যাম থাকে। আজ নেই। এত ফাঁকা রাস্তা সহজে দেখা যায় না। মনে হচ্ছে-সব মানুষ ঢাকা ছেড়ে অন্য কোথাও চলে গেছে।
তুতুন জানালার গ্লাস নামিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। বাতাসে তার চুল উড়ছে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম,
‘তুতুন?’
তুতুন হেসে বলল,
‘জ্বি।’
‘তুমি বাংলা বোঝো?’
‘অল্প অল্প বুঝি।’
‘তোমার বাবা বললেন-তুমি বাংলা বোঝো না।’
‘বাবা অনেক কিছুই বলেন।’
‘বাংলা কিভাবে শিখলে?’
‘একা একা।’
‘একাএকা কেউ শিখতে পারে না। তুমি তো ভয়াবহ কাজ করে ফেলেছ। বইপত্র কিছু পড়?’
‘পড়ি।’
‘কার কবিতা তোমার ভালো লাগে?’
‘জীবনানন্দ দাস।।’
‘জীবনানন্দের কোন জিনিসটা ভালো লাগে, কোনটা লাগে না?’
‘তার ‘হিজল বন’ শব্দটা ভালো লাগে। যতবার হিজল বন শব্দটাপড়ি ততবার হিজল বন দেখতে ইচ্ছা করে। তবে বেশ কিছু কবিতায় উনি ‘ঘাস’ শব্দটি ঘুরে ফিরে ব্যবহার করেছেন। যেমন-----সুরঞ্জনা, তোমার হৃদয় আজ ঘাস। এটা খুবই বাজে লাগে। বাকীগুলো মাস্টারপিস।’
‘এত কঠিন কঠিন কবিতা বুঝতে পারো?’
‘পারি।’
‘মিথ্যা বলছ?’
‘আমি মিথ্যা বলি না।’
‘আচ্ছা তোমার পরীক্ষা নিই। দেখি কেমন পারো?’
‘আচ্ছা।’
আমি বললাম,
‘হাজার বছর আমি হাটিতেছি পথ পৃথিবীর পথে-----এই বাক্য জীবনানন্দের কোন কবিতার অংশ?’
‘জীবনানন্দের কোন কবিতায় এই বাক্য নেই।’
‘মানে?’
‘হাটিতেছি---শব্দের আগে ‘পথ’ শব্দটি বসবে। তাহলে বাক্যটি শুদ্ধ হয়। শুদ্ধ বাক্যের কবিতার নাম- বনলতা সেন।’
আমি বিরক্তির ভঙ্গিতে বললাম,
‘এটা সহজ ছিল, তাই পেরেছ। কঠিন একটা বলি। দেখি পারো কি না?’
‘আচ্ছা! বলুন।’
‘আবার আসিয়ো তুমি, আসিবার ইচ্ছা যদি হয়----কোন কবিতা?’
তুতুন বলল,
‘কবিতার নাম-পঁচিশ বছর পরে। ধূসর পাণ্ডুলিপিতে আছে। কবিতায় মোট একশ পয়তাল্লিশতা শব্দ আছে।’
আমি বিস্মিত হলাম। চোখ কপালে তুলে চুপ করে বসে রইলাম। একদিকের গ্লাস নামিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম।

আমার দ্বিতীয় ফাঁদের কাজ চলছে।
আমি বুঝতে পারছি, তুতুন আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তার মনে একটা ঝড় চলছে। ঝড়ের কারণ-তুতুন ভাবছে, আমি তার মেধা দেখে বিস্মিত হয়েছি। নিজেকে পরাজিত সৈনিক মনে করছি।
এই মুহুর্তটা খুব গুরুত্বপুর্ণ। তুতুন কিছুটা সময় নেবে ব্যাপারটাকে বুঝতে। একসময় ভাবতে শুরু করবে- সে আসলে অনেক মেধাবী। সবকিছু জানে। পারে। তার স্মৃতিশক্তি মারাত্মক তীক্ষ্ম। তার স্মৃতিশক্তি দূর্বল----এই কথাটি সত্য নয়।


বুমারস ক্যাফে।
বেইলী রোড।
কোনার দিকে একটা টেবিলে আমরা বসে আছি। চারপাশে বেশ কিছু পরিবার। কয়েকটি যুগল উচ্চস্বরে হাসাহাসি করছে।

তুতুন সাধারণত বাইরে ঘুরতে বের হয় না। বের না হবার যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে। সে কালো। দেখতে অসুন্দর। এই ব্যাপারটি সবসময় তার মস্তিষের মধ্যে ঘোরাফেরা করে। প্রচন্ড হীনমন্যতা থেকে তার মনের ভেতর এক ধরণের ভয়ের সৃষ্টি হয়। এই বুঝি সবাই আমাকে অপছন্দ করে ফেলল।
এই মুহুর্তে তুতুন আমার সামনের চেয়ারে মুখোমুখি বসে আছে। তার মুখ কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা। বিচিত্রকারণে ব্যাপারটি আমার ভালো লাগছে না। একজন মানুষ শুধুমাত্র অসুন্দর হবার জন্য মুখ ঢেকে অসহায় হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে---ব্যাপারটি অমানবিক।
তুতুনের চোখের ভাষা অস্পষ্ট। ভালো করে তাকালে বোঝা যায়- সেখানে এক ধরণে হীনমন্যতা ভর করেছে। সে তার অসুন্দর মুখের ছবি কাউকে দেখাতে চায় না।
আমি আধঘন্টা বসে থাকার পর বিরক্ত হয়ে বললাম,
‘বেয়ারা আসছে না কেন বলো তো?’
তুতুন বলল,
‘এটা সেলফ সার্ভিস রেস্টুরেন্ট। কাউন্টারে গিয়ে আনতে হবে।’
‘ওহ! তুমি কিভাবে বুঝলে?’
‘দেয়ালে দেখুন। কয়েকটা ডিজিটাল মিটার। নাম্বার উঠছে কিছুক্ষন পরপর। তার মানে সেই টেবিলের খাবার রেডি। নিয়ে যান।’
আমি তুতুনের বুদ্ধিতে মুগ্ধ হয়ে বললাম,
‘আশ্চর্য! আমি কত কম জানি? এই সহজ জিনিসটা আমার মাথা ধরতেই পারল না?’
তুতুন বলল,
‘ওই ছেলেটা কি আমার দিকে তাকাচ্ছে?’
‘কোন ছেলেটা?’
কাউন্টারের কোনায়। সাদা চেক শার্ট পরা।’
আমি কাউন্টারের কোনায় তাকালাম। একটা সাদা চেক শার্ট পরা ছেলে দাড়িয়ে আছে। বয়স পঁচিশ ছাব্বিশ। সুদর্শন। চোখেমুখে মায়া। ছেলেটা একদৃষ্টিতে এদিকে তাকিয়ে আছে। আমি বললাম,
‘হ্যা, তাইতো। এদিকেই তাকাচ্ছে।’
তুতুন অসহায়ের মত বলল,
‘আমার খারাপ লাগছে।’
‘কেন?’
‘সবাই কেমন সহানুভূতি নিয়ে আমার দিকে তাকায়।’
‘সহানুভূতি কেন হবে? এমনও হতে পারে, সে তোমাকে পছন্দ করে ফেলেছে। হতে পারে না?’
‘না। এটা কোন দিন হতে পারে না। দেখেছেন সে কত সুন্দর। আর আমি কেমন? মুখ ঢেকে ঘুরতে হয়।’
আমি হেসে বললাম,
‘পছন্দ করেও তো তাকাতে পারে তুতুন। আমার তাইমনে হচ্ছে। তুমি প্রমান দেখতে চাও?’
তুতুন অবিশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে বলল,
‘চাই।’
‘মুখের কাপড় সরাও।’
তুতুন বিস্মিত হল। কাপড় সরালো না। আমি আরেকবার বললাম।
‘কাপড় না সরালে প্রমান দেখবে কিভাবে?’
তুতুন বলল,
‘যদি অন্য কিছু ঘটে?’
‘ঘটবে না। আমার উপর বিশ্বাস রাখো।’
তুতুন অবিশ্বাস নিয়ে মুখের কাপড় সরিয়ে ফেলল। তার মুখে লজ্জা। ভয়ংকর রকম লজ্জা। মাটির সাথে যেন মিশে যেতে পারলে বেঁচে যায়।
তুতুন বলল,
‘দেখবেন----ছেলেটা এখন মুখ ফিরিয়ে নিবে। আমার মুখ দেখে সে ভয় পেয়ে যাবে।’
‘ভয় পাবে কেন?’
‘কারণ বলতে ইচ্ছা করছে না।’

তুতুন জবাব না দিয়ে ফিসফিস করে বলল,
‘আশ্চর্য! ছেলেটা এখনো তাকিয়ে আছে।’
‘তাই নাকি?’
‘জ্বি। এখনো তাকিয়ে থাকবে কেন?’
‘কারণ তুমি সুন্দর।’
তুতুন দ্বিধান্বিত হল। কিছুটা লজ্জাও পেয়ে গেল। আমি এই মুহুর্তের অপেক্ষায় ছিলাম। বিড়বিড় করে বললাম,
‘দেখেছ, ছেলেটার চোখভরা ভালোবাসা।’
‘ভালোবাসা কেন?’
‘সে তোমাকে পছন্দ করে ফেলেছে।’
‘আপনি কিভাবে বুঝলেন?’
‘আমি জানি না। আমার ধারনা, ছেলেটি তোমাকে বলে ফেলতে পারে, আমি তোমাকে ভালোবাসি।’
তুতুন বিস্মিত হল। তার চোখভরা দ্বিধা।

তুতুন বলল,
‘বলেছিলাম না, ছেলেটা চলে যাবে?’
‘চলে যাচ্ছে?’
‘হ্যা যাচ্ছে।’
তুতুনের কন্ঠ ভারী। কিছুটা অভিমান। কিছুটা লজ্জা।

ছেলেটা ধীরেধীরে পাশ দিয়ে চলে গেল। ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’ টাইপের কোন কথা বলল না। পাশ দিয়ে যাবার সময় একবার দাড়ালো। আমাদের টেবিলের উপর একটা দৈনিক পত্রিকা রেখে চলে গেল। তুতুন অভিমান নিয়ে পত্রিকাটা টেবিল থেকে ফেলে দিল।

পত্রিকার নীচে একটা লাল গোলাপ। লাল কাগজ পেঁচিয়ে বানানো। কাগজ খোলা হল। কাগজে ছোট্ট করে লেখা ----আপনাকে বেশ ডিসেন্ট লাগছে। কখনো যদি মনে হয় একা পথ চলতে ক্লান্ত----জানাবেন। অপেক্ষায়।
এরপর ছোট করে একটা ফোন নাম্বার লেখা।

তুতুন লেখা পড়ে লাল হয়ে গেল। কৃষ্ণবর্ণের জন্য লালচে আভা ঠিকঠাক দেখা গেল না।


বসুন্ধরা সিটিতে সিনেমা দেখা হল।
সিনেমার নাম ‘ফাস্ট এন্ড ফিউরিয়াস’। ভয়াবহ মুভি। মুভির আগাগোড়া গাড়িভাঙ্গা আর গোলাগুলি। তুতুন বেশ আনন্দ নিয়ে দেখল। গুলির সময়ও তার চোখে মুখে আনন্দ। গাড়ি দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে, তবুও তার চোখেমুখে আনন্দ।
দীর্ঘক্ষন পর বোঝা গেল, সে সিনেমা দেখছে না। তার সকল আগ্রহ হাতের তালুতে রাখা ছোট কাগজ। সেখানে লেখা- অপেক্ষায়।
তুতুনের হাসির উদ্দেশ্য কি? অপেক্ষায় থাকা যুবকের জন্য? নাকি ‘ডিসেন্ট’ নামক শব্দটি?
তুতুনের তিনটি কষ্ট ছিল।
সে অসুন্দর। সেই সমস্যার কিছুটা সমাধান হয়েছে। একটা সুদর্শন ছেলে তার দিকে মুগ্ধ অয়ে তাকিয়ে ছিল। ডিসেন্ট নামক একটি শব্দ দিয়ে তুতুনের ‘অসুন্দর’ ব্যাপারটিকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে গেছে। বিস্ময়করভাবে তুতুন কথাটি বিশ্বাস করেছে। এখন তার চোখেমুখে আনন্দের ঝিলিক।
‘অপেক্ষায়’ শব্দটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কেউ একজন তাকে সামনে এসে বলতে পারে-অপেক্ষায় আছি----এই বিশ্বাসটি তুতুনের মধ্যে চলে এসেছে। সুক্ষ্ম আশা করা যায়, তার তৃতীয় সমস্যারও সমাধান হয়েছে।
সমাধান হয়েছে বলে- পুরো সিনেমা তুতুন মুখের কাপড় সরিয়ে রেখে দেখছে। তার চোখেমুখে বড় আনন্দ!

সিনেমার শেষদিকে তুতুন চেঁচিয়ে বলল,
‘আপনার ম্যাজিক শো কখন?’
আমিও চেঁচিয়ে বললাম,
‘বলা যাবে না। এটা রহস্য।’
‘কোথায় হবে সেটা অন্তত বলুন।’
‘সেটাও রহস্য।’


রাত এগারোটা।
বাসায় ফেরার সময় তুতুন জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল। জানালার বাতাসে তার মাথার চুল উড়ছে। বাইরের দিকে তাকিয়েই আমাকে জিজ্ঞাসা করল,
‘বাবার সাথে আপনার কথা হয়?’
‘হয়।’
‘আমি জীবনানন্দের কবিতা পড়ি, এটা কি বাবা আপনাকে বলেছে?’
‘সেটা কি জানা গুরুত্বপুর্ন?’
‘না গুরুত্বপুর্ণ নয়। আশ্চর্যের ব্যাপার হল-আমি দুটো মাত্র কবিতায় মুখস্ত করেছি। আপনি প্রশ্ন করেছেন সেই দুটো থেকেই। অন্য কোন কবিতা থেকে প্রশ্ন করলে আমি জবাব দিতে পারতাম না। ব্যাপারটা বিচিত্র নয়?’
‘হুম। বিচিত্র।’
‘আপনি কিভাবে ব্যাপারটা ধরতে পেরেছেন?’
‘আমি জানি না তুতুন।’
‘আপনি কেন এই সহজ সরল প্রশ্নগুলো করেছেন?’
‘আমি চেয়েছি তুমি যেন বুঝতে পার তুমি চমৎকার মেধাবী একটি মেয়ে।’
‘আপনার উদ্দেশ্য সফল হয়েছে?’
‘আমি জানি না তুতুন।’
তুতুন নিস্পৃহ কন্ঠে বলল,
‘বুমারসের ছেলেটাও কি আপনার পরিচিত?’
আমি বললাম,
‘পরিচিত হলে কি খুব অপরাধ হবে?’
‘না হবে না। তাকে কি আপনিই বলেছেন ওভাবে আমার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে?’
‘দৃষ্টিতে মুগ্ধতা বানানো যায় না। আপনাতেই আসে। তার মুগ্ধতা তোমার ভালো লাগেনি?’
‘লেগেছে। তবে আমার মনে হচ্ছে ছেলেটা আপনার পরিচিত। আপনি তাকে বলেছেন যেন আমার দিকে মুগ্ধভাবে তাকিয়ে থাকে।’
‘তোমার এমন ধারনার উৎস কি?’
‘কোন উৎস নেই। আমার শুধু মনে হচ্ছে।’
‘আর কি মনে হচ্ছে তুতুন?’
‘আমার হাতের নাম্বারে ডায়াল করলে কাউকে পাবো না। দেখা যাবে বন্ধ। অথবা অন্য কোথাও চলে যাবে। সেই ছেলেটা ধরবে না।’
‘তোমার ধারণা মিথ্যা হতে পারে না?’
‘পারে।’

তুতুন বিড়বিড় করে বলল,
‘আমার মা জীবনানন্দ ভালো আবৃতি করত। তার প্রিয় দুটি কবিতা বনলতা সেন এবং পঁচিশ বছর ধরে। মা প্রতিদিন আবৃতি করে আমাকে শোনাত। আমি সেখান থেকেই মুখস্ত করে ফেলেছি। আপনার ম্যাজিক শো আজ হবে না?’
‘না তুতুন। আজ হবে না।’
‘কেন?
‘সেটা রহস্য। আমি অতিশয় লজ্জিত তুতুন।’
তুতুন আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘আমার মাথায় একটা ব্যাপার ঘুরছে। বলব?’
‘বল।’
‘আমার কেন যেন মনে হচ্ছে আমি এই শো দেখে ফেলেছি।’
‘কিভাবে দেখলে?’
তুতুন মৃদ্যু হেসে বলল,
‘আপনি যেদিন আমার দরজায় প্রথম নক করে তিতলি ডাকলেন সেদিন থেকে ম্যাজিক শো শুরু হয়েছে। আপনি জানেন না, আমি সারারাত কান্নাকাটি করেছি। কেউ একজন আমাকে তিতলি ডেকেছ----এই আনন্দ আমি রাখি কোথায়!’
‘ওহ।’
‘এরপর ধীরে ধীরে কবিতা থেকে প্রশ্ন করলেন। আমাকে বুঝিয়ে দিলেন-আমি অনেক জানি।
বুমারসে যে ছেলেটা আমার দিকে তাকিয়ে ছিল সেই ছেলেও আপনার ম্যাজিকের চরিত্র। তার কাজ হল একটা ইল্যুশন তৈরি করা। যে ইল্যুশন আমাকে ভাবতে বাধ্য করবে----আমি অনেক মায়াবতী একটা মেয়ে।’
‘তুমি নিজেকে মায়াবতী ভাবতে পারছ তুতুন?’
‘পারছি কি না বলব না।’
‘কেন বলবে না?
‘এটা রহস্য।’
তুতুনের চখে মুখে আনন্দ।


সাবের সাহেব বেলকনীতে বসে ছিলেন। গাড়ির শব্দ শুনে লিফটের সামনে নিজে এগিয়ে আসলেন। তুতুন লিফট থেকে নেমে সাবের সাহেবের হাত ধরে উত্তেজিত ভঙ্গিমায় বলল,
‘বাবা, তাড়াতাড়ি খাবার রেডি করো।’
সাবের সাহেবের আনন্দে চোখে জল আসল। তুতুন বিরক্ত হয়ে বলল,
‘বাবা, বাচ্চাদের মত কাঁদবে না। এক্ষুনি বুয়াকে বলে দাও। যাও।’
‘দিচ্ছি মা।’
‘দিচ্ছি দিচ্ছি বলছ কেন? যাও এক্ষুনি। আজ আমি ম্যাজিশিয়ানের সাথে একসাথে বসে খাবো। তুমি আলাদা খাবে। ব্যালকনীতে দুটো চেয়ার বসাও। কেউ যেন এদিকে না আসে। আসলে পাঁচ তলা থেকে ফেলে দিব।’
সাবের সাহেব বাচ্চা শিশুদের মত রান্নাঘরে ছুটে গেলেন। পেছন পেছন তুতুনও চলে গেল। বাইরে থেকে থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে তাদের আনন্দ। এই বাড়িতে আজ ঈদ। দুজন কাজের লোক ধস্তাধস্তি করে দুটো চেয়ার টেনে নিয়ে গেল ব্যালকনীতে। তারাও বড় আনন্দে।

আমি লিফটে উঠলাম।
এই দালান থেকে বের হয়ে যেতে হবে। এখানে আমার কাজ শেষ।


সাবের সাহেবের ড্রাইভার ময়েনউদ্দিন গাড়ি গ্যারেজ করেছে। এখন সে গেটের কাছে একটা টুলে বসে আছে।
ময়েনউদ্দিন ম্যাচের কাঠি দিয়ে কান গুতোগুতি করছে। আরামে তার চোখ অর্ধেক বন্ধ। আমাকে দেখেও তেমন কোন ভাবান্তর হল না। তার কাছে কান গুতানো হল পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ কাজ।

আমি গাড়ি ছাড়াই রাস্তায় নামলাম।
কিছুক্ষন আগেও আকাশ বেশ পরিষ্কার ছিল। এখন নেই। মেঘ জমে ঘন অন্ধকার। এই ভরা শীতে আকাশ এমন হবার কথা নয়।
সেগুনবাগিচার আকাশভেঙ্গে বৃষ্টি নামার সম্ভাবনা প্রবল। দুই এক ফোঁটা করে পড়তে শুরু করেছে। বৃষ্টির ফোটা সোয়েটারের উপর পড়ছে। সোয়েটার ভেদ করে ভেতরে ঢোকার মত সাহস পাচ্ছে না। কেন পাচ্ছে না?
সে এক রহস্য!
__________________________
রাজীব হোসাইন সরকার; ডাক্তার, সুলেখক।

আপনার মতামত দিন:


মেডিক্যাল ক্যাম্প এর জনপ্রিয়