Ameen Qudir

Published:
2017-06-19 00:30:49 BdST

আষাঢ়ের বৃষ্টিমুখর নাইট ডিউটি ও একগুচ্ছ কদম


 

 

 

ডা. নাসিমুন নাহার
___________________________________

তুপার বিয়ে এবং ডিভোর্স দুটোই হয়েছিল বৃষ্টি ভেজা আষাঢ়

মাসে। সারা বছর ইংরেজি ক্যালেন্ডারের হিসেবে জীবন চললেও কেন যেন জুন মাস এলেই প্রবল বর্ষণমুখর সন্ধ্যা অথবা মুষলধারে বৃষ্টি তুপাকে মনে করিয়ে দেয় প্রকৃতিতে এখন আষাঢ় মাস চলছে।

ব্যস্ত জীবনে সময় কই অতীতের জাবর কাটার?
তবুও ফেলে আসা জীবনের কিছু কিছু স্মৃতি মাঝে মাঝে ফ্ল্যাশ ব্যাক হিসেবে মাথায় উঁকিঝুঁকি মারে।এই যেমন এই মুহূর্তে হাসপাতালে নাইট ডিউটি করতে এসে প্রচন্ড নস্টালজিক হয়ে গেল আজ তুপা।

ঘটনা তেমন কিছু না।আর সব নাইটের মতোই তুপা ফলোআপ দিচ্ছিল ওয়ার্ডে - কেবিনে। কেবিন 009 এ এটেনডেন্স বসার সোফাতে সাদা পলিথিন দিয়ে প্যাঁচানো একগুচ্ছ কদম ফুল রাখা দেখে হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখল একটু।

চোখে চোখ পড়তেই বেডের তরুণী রোগী লাজুক হাসি দিল।নিজেই বলতে শুরু করল--- 'আফনাদের জামাই নিয়া আসছে বিকালে।
মানুষডা একটু পাগলা টাইপ।হুটহাট কিসব কইরা ভীষন লজ্জায় ফেলাইয়া দেয় আমারে।
এমনতে কড়া মেজাজের মানুষ।কিন্তু মনডা এক্কেরে শিশুর লাহান।ফুলগুলা আইন্যা বলল--কমলা বানু বর্ষাকালে প্রেমিকারে কদম ফুল দেবার নিয়ম আছে বুঝছ।আমি তো চমকাইয়া বললাম--এই নিয়ম কেডা বানাইছে? তিনি বলল--সেইটা তোমার না জানলেও চলবে।
যেহেতু বিবাহের পূর্বে প্রেম করা হয় নাই তাই স্ত্রী হিসেবে তুমিই আমার প্রেমিকা বুঝলানি।'
এই পর্যন্ত বলেই আবার লাজুক হাসি দিল পেসেন্ট কমলা বানু।

কমলা বানুর ব্রেষ্ট ক্যান্সার।ঊনিশ বছরের বাচ্চা একটা মেয়ে।বিয়ে হয়েছে বছরখানেক।বিয়ের কয়েক মাসের মাথায় হঠাৎ অসুখ ধরা পড়েছে।এই হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে কয়েক মাস ধরে।চিকিৎসা চলার সময়ে ভর্তি থাকে আবার বাড়ী চলে যায়।মোটামুটি পুরনো রোগী।কেমো নেবার সময় হাসপাতালে ভর্তি থাকে টানা কিছু দিন।ফলে চঞ্চল মিশুকে স্বভাবের কমলা ডাক্তার নার্স হাসপাতালের সবার কাছেই খুব প্রিয় পরিচিত মুখ।সবার সাথেই তার খাতির।

কমলা শরীর কেমন সেটা বল? আর ফুল আনা তো নিষেধ।--- বলল তুপা।
কমলা জিভ কেটে বলল--না না আমি ফুল ধইরা দেহি নাই।এইজন্যই তো পলিথিন দিয়া প্যাচাইয়া আনছে হে।

ফলোআপ শেষ করে পাশের কেবিনে চলে গেল তুপা।

রাউন্ড শেষ করে ওয়ার্ড থেকে বের হবার সময় কেবিন 009 এ আবার গেল ফাইল নিয়ে।
সিস্টারকে কিছু ইন্সট্রাকশন দিল মেডিসিন নিয়ে।
কেবিনের পেসেন্ট হালকা করে ডাকল ম্যাডাম একটু হুনবেন ?

তুপা এগিয়ে গেল।জিজ্ঞেস করল--কোন সমস্যা কমলা?
কমলা ভীষন কাঁচুমাচু হয়ে প্রায় ফিসফিস করে বলল--- যদি কিছু মনে না নেন একটা কথা কমু।আমি তু আফনের ছুডু বইনের মত।
তুপা-- হুম বল।
কমলা--আমাদের স্যারও কি ডাক্তার? আফনের মতোই সুন্দর দেখতে? স্যার কি আফনেরে কদম ফুল দিছে এইবার বর্ষাতে?

যদিও পেসেন্টের বেডে বসা ঠিক না।তবুও তুপা কমলার বেডে বসে কেমোর প্রভাবে চুল ঝরে যাওয়া মাথায় হালকা করে হাত বুলিয়ে বলল--- কমলা বানু সবাই কি আর তোমার মত ভাগ্যবতী হয় বল?আমি ডিভোর্সড।কোন স্যার নেই এই অদ্ভুত সুন্দর বর্ষাকালে কদম ফুল দেবার মতো।কিন্তু তোমার গিফট পাওয়া ফুলগুলো দেখে মনটা ভরে গেল।তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠ বালিকা।বর্ষার বৃষ্টিতে প্রিয় মানুষের হাত ধরে না ভিজলে পাপ হবে কিন্তু।

চঞ্চলা কমলা একটু থমকে গেল যেন।নিজেকে সামলে নিয়ে বলল---- এমুন ক্যান হয় ম্যাডাম কইতে পারেন ? আপনি যে কত ভালা একটা মাইয়া তা হাসপাতালে ভর্তি থাইক্কা আমি বুঝছি।রোগীরা নার্সরা অন্য সবাই কত যে পছন্দ করে আপনেরে।আর এই যে আমি ক্যান্সারে ভুগতেছি কতদিন ধইরা।কেমো নিতাছি।চুল চামড়া দেখছেন কেমন বিশ্রী হইয়া গেছে।কবে না জানি দুম কইরা মইরা যামুগা।
জামাই তাও নতুন বৌর লাহান ভালোবাসে এহনো।বুঝবারই দেয় না আমার লাইগ্যা সে পানিতে পড়ছে।সবাই কইছে এই রোগাইত্যা বউ কেউ পালে ? ফালাইয়া দে।হে হুনে নাই কারো কথা।
একটু দম নিয়ে আবার বলে কমলা---
আর আফনের মতো ভালা সুন্দরী ডাক্তার মাইয়ারও ডিভোর্স হয় !! দুনিয়াডা খুব খারাপ বুঝলেন ম্যাডাম।

তুপা ঠোঁট টিপে একটু হেসে বলল ডার্লিং পেসেন্ট কমলা বানু আমার শোন-- ডিভোর্সের সাথে ভালো বা খারাপ মেয়ে/ছেলে হবার কোন সম্পর্ক নেই কিন্তু।
এই যেমন ধর, তোমার একটা পচা অসুখ হয়েছে শরীরে। কিন্তু এজন্য কি তুমি দায়ী বল? কখনও কিন্তু না। ঠিক তেমনি ডিভোর্সও হচ্ছে একটা অসুখ বলতে পার।মনের সাথে মন না মিললে সবাই পারে না একসাথে সংসার নামক বন্ধনে আবদ্ধ থেকে অসুস্থ হতে।তখন একটু সার্জারি মানে কাটাকুটি করে অপারেশন করে দুজন মানুষকে সুন্দর সুস্থ জীবনের জন্য আলাদা হয়ে যেতে হয় কখনো কখনো !

তুপা কেবিন থেকে বের হবার সময় কমলা আবার পিছু ডেকে টলমল চোখে কান্নার ঢোক গিলতে গিলতে বললল---- ম্যাডাম আমি খুব খুশি হমু এই পলিথিনে পেঁচানো কদমগুলা যদি আফনে নেন।এইডা আমার উপহার আফনার জন্য এইবারের বর্ষায়।আমি যদি বাঁইচা থাকি আমার মাইয়ারে আফনের গল্প হুনাব আমি।
গল্পের নাম হইব- 'ডাক্তাররে কদম ফুল উপহার দিলাম'।ম্যাডাম আফনের খুব ভালা পাই আমি।

সাদা পলিথিনে প্যাঁচানো কদম গুচ্ছ হাতে তুলে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে একটু দাঁড়িয়ে বড় করে একটা শ্বাস টেনে নিয়ে একবারও পিছু না ফিরে কেবিন 009 থেকে দ্রুত বেরিয়ে এল ডা.তুপা।

_____________________________

ডা. নাসিমুন নাহার , সুলেখক

আপনার মতামত দিন:


মেডিক্যাল ক্যাম্প এর জনপ্রিয়