Ameen Qudir

Published:
2016-11-25 16:30:06 BdST

আশির দশক- সিনেমা, 'রাজা কনডম '


      

ডা. নুরুল হাসান বাবু
___________________________

 

আশির দশকে আমাদের বিনোদনের শ্রেষ্ঠতম মাধ্যম ছিল সিনেমা হলে মুভি দেখা -আমরা বলতাম বই দেখা । মুভি গুলোকে বই বলার কারণও ছিল - মুভিগুলো সত্যিকার অর্থে একটা সুন্দর কাহিনী নির্ভর ছিল , এক একটা মুভি দেখা মানে একটা উপন্যাস জাতীয় বই পড়ার মত ব্যাপার । তাছাড়া অনেক মুভিই তৈরী হত কোন এক বিখ্যাত বা নন্দিত সাহিত্য / বইয়ের কাহিনী নিয়ে । সেই সময়কালে বই বা সিনেমা দেখা আর সিনেমার গান ছিল আনন্দে তো বটেই দু:খ -বেদনা -হতাশায় ভাঙ্গা মন ভাল করার মহা ঔষধ ।প্রসঙ্গত আমার সেই গুনধর মামাত ভাই মো: সামছুল খাতুনের এক মহামূল্য Quote বিশেষ স্মরণযোগ্য -
"কাজ কাম নাই
টাকা পয়সা নাই
হাত খালি
মনটা খারাপ
কী করং মুই
যাওং বই দেখি আইসং...."

সিনেমা হলে গিয়ে শেষ দেখা পুরো ছবি 'কেয়ামত থেকে কেয়ামত ' বাংলা আর ইংরেজী 'Titanic' | এরপর বন্ধুদের সাথে নিয়ে কোন এক বাংলা ছবি দেখতে গিয়ে সেই যে মাঝপথে 'ওয়াক থু ' বলে বেরিয়ে এসেছি আর কখনো যাইনি । অথচ আমি ছিলাম এই বই দেখার পোকা । আজ বললে অনেকেই বিশ্বাসই করতে চাইবে না যে ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৮ বাংলাদেশের এমন কোন বাংলা মুক্তি প্রাপ্ত ছবি বা মুভি নেই যা আমি সিনেমা হলে দেখিনি। ৮৮ তে এস.এস.সি পরীক্ষার মাঝে জ্যাকা পরীক্ষার আগের দিন 'দুনিয়া ' নামে রোজিনা অভিনীত বাংলা-ভারত-পাকিস্তান যৌথ প্রযোজনার ছবিটা দেখেছিলাম । কোন কোন ছবি একাধিক বা বহুবার দেখারও অসংখ্য রেকর্ড জমা আছে । স্পষ্ট মনে আছে রাজদুলারী নামের ছবিটি ১৭ বার , ছুটির ঘন্টা ১০ বার , মতিমহল ৭ বার , এতিম ৫ বার দেখার বিশেষ রেকর্ডের কথা ।

স্কুলের টিফিনের জন্য বরাদ্দ নেই তবে ছবি দেখার টাকা জোটে কোত্থেকে ? এই প্রশ্ন আপনার মনে উদয় হওয়ারই কথা । আমার একমাত্র ঈদে মুক্তি পাওয়া ছবি দেখতে নিজ পকেটের পয়সা লাগত কারন ঈদের ছবির টিকেটের মূল্য থাকত আকাশ ছোঁয়া আর ঈদি পেয়ে কিছু টাকা হাতেও আসত। ছবি দেখার প্রথম ও প্রধান সোর্স আমার সেই সামছুল আর জামাল নামের দুই মামাত ভাই। গ্রাম থেকে আসা আমার সকল চাচা ফুফু আর চাচাত ভাই-ভাবী বা বোন - দুলাভাইয়ের দল হল দ্বীতিয় আর বাবা-মার সাথে মাঝে মধ্যে যাওয়া হল তৃতীয় সোর্স। নাইন/টেনে পড়ার সময় সুযোগ বাড়াল আমার স্বচ্ছল উদারমনা প্রিয়বন্ধু প্রদীপ।

 

 

       

সামছুল আর জামাল ভাইয়ের সঙ্গে সিনেমায় যাবার সুযোগ পাবার অন্যতম কারণ ছিল গানের কথা বা Lyrics আমার খুব সহজে মুখস্ত হওয়া । আমার ঐ গুনধর দুই মামাত ভাই এর Hobby ছিল সিনেমার গানের কথা বা Lyrics গুলো খাতায় লিখা আর মুখস্ত করা । যদিও সেদিনে সিনেমার গান লিখা ছাপানো চটি বই বাজারে পাওয়া যেত কিন্তু তাতে থাকত পুরোনো গান । তাদের দরকার লেটেষ্ট গান - লেটেষ্ট গানের বই এর দাম অনেক চড়া তার চেয়ে ঢের সস্তা আমাকে ভাড়া করা । আমি তাদের সদ্য দেখা ছবির গরমাগরম Lyrics মুখস্ত লিখে দিতাম। রাজদুলারী ছবিটা অনেকবার দেখার কারণও ছিল সিনেমাটার অনেক গান ...হারারারারারা মোর পায়ের ঝুমরু ..ছমছম ছমছম বাজে ..দেখরে দেখ আমাকে ..অথবা ও দরিয়ার পানি ...তোর মতলব জানি ...ইত্যাদি গানগুলো মুখস্ত করতে সময় লেগেছিল । এখনো যত সেদিনের সিনেমার গানের Lyrics আমার মস্তিস্কে আছে , মেডিকেলে সবচেয়ে বেশী পড়া এনাটমী বা প্যাথলজীর অত পড়াও আমার মাথায় বা মনে নেই । তবে সামছুল বা জামালের সাথে দেখা অধিকাংশ ছবির আসন ছিল অত্যন্ত VIP মর্যাদার -একেবারে পর্দার সামনে মাথা উঁচু করে দেখা !

গ্রাম থেকে আত্মীয়দের রংপুরে ঘনঘন আসার প্রথম ও প্রধান কারণও ছিল ছবি দেখা । আর তারা ছবি দেখতে যাবে মানে আমিও যাব -আমার কদরের কারণ ছিল সোনার হরিঁন দূর্লভ সিনেমার টিকেট সংগ্রহে আমার বিশেষ ক্ষমতা । ক্ষমতার উৎস শর্বরী খালা- সেই সময়ের পর্দা কাপাঁনো সিনেমার পার্শঅভিনেত্রী -শর্বরী । মূলত তিনি সিনেমায় নাচের দৃশ্যে অভিনয় করতেন । শর্বরী খালার আত্মীয়া আমাদের প্রতিবেশী । রংপুরে তিনি তার আত্মীয়ার বাসায় বেড়াতে এলে আমাকে দেখতে আসতেন এবং সম্ভবত দুবার আমাকে নিয়ে তদানিন্তন রংপুরের সবচেয়ে মূল্যবান স্থান লক্ষী ও ওরিয়েন্টাল সিনেমা হলে সেখানকার মালিক/কর্মচারীদের কাছে সৌজন্য সাক্ষাতে নিয়ে যান । শর্বরী বলে কথা ..শর্বরীর ভাগ্নে মানে আমি তাদেরও ভাগ্নে । আমি চাইলে ব্লাকে (কালোবাজারে) বেচা টিকেট ও তারা ন্যায্য মূল্যে আমাকে দেবার ব্যবস্থা করে দিতেন।

 

     

আব্বা-আম্মার সাথে দেখতে যাওয়া সিনেমা গুলো ছিল বিশেষ উল্লেখযোগ্য ঘরানার ; মূলত ছবিগুলোতে ধুমছে কান্নার পর্বে ভরপুর একটা বিষয় থাকত । 'ছুটির ঘন্টা ' ছবি দেখে আম্মা কাদেঁন আমিও কাঁদি । 'এতিম ' ছবিতে রুনা লায়লার গাওয়া.."যেওনা যেওনা যেওনা মা ..আমাদের ছেড়ে চলে যেও না ..." গানের সময় আম্মা কাদঁতে কাঁদতে কয়েকটা রুমাল ভিজিয়ে শেষ আর আমার গলায় ব্যাথা । সেই বাংলা সিনেমা আর সেই দিন ....

সিনেমার মাঝখানে বিরতি বা Interval আগেও ছিল এখনও আছে । তবে আমাদের জন্য তা ছিল সলটেড বাদাম খাওয়া আর বাথরুমে যাবার জন্য অপরিহার্য অংশ ।বিরতিতে হল কর্তৃপক্ষ কিছু স্থির ও কিছু সচল ছবির বিজ্ঞাপনও সিনেমার পর্দায় প্রদর্শন করত । সবচেয়ে আর্কষনিয় ছিল 'আসিতেছে ' টাইটেলে আগামীতে মুক্তি পাবে বা এই প্রেক্ষাগৃহে দেখা যাবে এরুপ আগাম সিনেমার ট্রেলার । সেই ইন্টারভেলে বিনোদনের পাশাপাশি শিক্ষামূলক বা সরকারী বিজ্ঞাপনও থাকত।

সময়টা আশির দশকের শুরুর দিককার ..সরকার দেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে ব্যাপক কার্যক্রম শুরু করেছে । বাংলাদেশে সম্ভবত তখন জন্ম নিরোধক পিল কনডম ইত্যাদি নুতন অর্থাৎ কেবল আমাদানী হয়েছে -নাম 'মায়া বড়ি ' আর 'রাজা কনডম'।তাদের ব্যবহার বৃদ্ধিতে সিনেমা হলে বিজ্ঞাপন দেখানো শুরু হল। " ...খান ভাবনাহীন নিশ্চিন্তে জীবন কাটান , ...ওমুক দাম্পত্য জীবন মধুর করে " এমন আকর্ষনীয় কথায় বিজ্ঞাপন গুলো ভরা থাকত । এগুলো কি , ব্যবহার কি বা কী কাজে লাগে সে ব্যাপারে আমার বা আমার সেই মামাত ভাইদের সেই সময়ে বিন্দু বিসর্গ কোন জ্ঞানই ছিলনা।

 

 

   

সে সময় আমাদের ধাপের পুরোনো বাড়ীর সামনে খোলা বড় একটা আঙ্গিনা ছিল । তখনও বাসায় বিদ্যুৎ সংযোগ হয়নি আমাদের । গরমের রাতে এই আটটা নয়টার দিকে সেখানে মাদুর পেতে আমরা , আমাদের কজন ভাড়াটিয়া পরিবার আর আশপাশের প্রতিবেশী খোলা আকাশের নীচে বসে বা শুয়ে আকাশের চাঁদ বা খসে পড়া তারা দেখতাম । সাথে চলতো ভূত-পেত্নী বা রাজা-রাজকুমারীর organised কেচ্ছা-কাহিনী বা নিজেদের জীবনের দিনলিপির disorganised গল্প গুজব।একদিন আমাদের এক ভাড়াটিয়া মামী তার জীবনের কিছু হতাশা ব্যক্ত করে বললেন- " এত চিন্তা দু:চিন্তা আর ভাল লাগে না , জীবনটায় সুখ পাইলাম না।" তার কথা শেষ হতেই আমার সেই গুনধর সামছুল ভাই পরামর্শ দিয়ে বলতে লাগলেন - "মামী রাজা কনডম খান , সব চিন্তা শেষ করেন। রাজা কনডম সেবন , ভাবনাহীন সুখের জীবন।"
সামছুল ভাইয়ের পরামর্শ শেষ না হতেই বড়রা সবাই চুপ আর একে অপরের দিকে অবাক তাকাতে থাকলেন । দুএক জনের হায় আল্লা , ইয়া খোদা বলে উম্মা প্রকাশ শুরু হয়েছে -ততক্ষনে সামছুল ভাইয়ের বড় বোন মুন্নী আপা কোত্থেকে একটা লাঠি জোগাড় করে সপাত পেটাতে শুরু করেছেন তার গুনধর ভাই সামছুলকে। " হারামজাদা , শয়তান , হিতাহিত জ্ঞান নাই, বড়দের সন্মান করা নাই.." ইত্যাদি বকুনি সাথে বেদম পিটন ।

পিটন খেয়েও সামছুল ভাই বলতে থাকল- "মুই কি দোষ কননু, মুই মামীক তো ভালো কথাই কনু, রাজা কনডম খান , কনডম খায়া সুখী থাকেন । সিনেমা হলোত ইন্টারে সেই এডভ্যাটাইজ এ তো দেখায় । মুইওতো 'রাজা কনডম ' কই পাইম খুজোছং , রাজা কনডম খায়া কি শান্তি মুইও দেখিম !"

________________________________

 

 

 

লেখক ডা. নুরুল হাসান বাবু । জনপ্রিয় লেখক। সুখময় প্রাণবন্ত গদ্য লেখেন।
ইতোমধ্যেই সর্বস্তরের পাঠক মহলে ব্যাপক সাড়া ফেলেছেন।
Clinical Ultrasound Consultant at Popular Diagnostic Centre Ltd.
Works at Bangladesh Govt.
Former Assistant Registrar at National Institute of Mental Health
Studied Bachelor of Medicine & Surgery (MBBS) at Rangpur Medical College

আপনার মতামত দিন:


মেডিক্যাল ক্যাম্প এর জনপ্রিয়