Ameen Qudir

Published:
2017-05-11 18:46:25 BdST

চিকিৎসকরা কেন আক্রান্ত


 

 

 

ডা. রেজাউল করীম
___________________________

 

ক্লিনিকাল এস্টাবলিশমেন্ট আইন নিয়ে চিকিৎসকরা খুশি নয়, সেকথা আমরা অনেকবার বলেছি। রাজ্য সরকার আইন পাশ করেছেন, বিধানসভায় তাদের প্রভুত সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে। সুতরাং আইন বানানোর অধিকার তাদের আছে। আমাদের কি কি বিষয়ে আপত্তি আছে তা বলার আগে একটি প্রয়োজনীয় বিষয়ে আলোচনার প্রয়োজন আছে, সেটা এই বেলা বলে রাখা ভাল।

 

স্বাস্থ্য এমন একটি বিষয় যেটা নিয়ে আমাদের মত সাধারন মানুষ যাই ভাবুক না কেন যারা দেশ চালান তারা কি সে নিয়ে ভাবিত? সংবাদপত্র গুলি কি তা নিয়ে চিন্তিত? টক শো গুলি কী তা নিয়ে কোন সদর্থক আলোচনা করেন? যেহেতু স্বাস্থ্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আমাদের জীবনের নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করে তাই এ নিয়ে বিতর্কের প্রয়োজন আছে। আমাদের পার্লামেন্টে নানা জিনিস নিয়ে আলোচনা হয় কিন্তু স্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনার জন্য নির্ধারিত সময় মাত্র ৩ শতাংশেরও কম।

 

সংবাদপত্র যে খবর ছাপে তার মাত্র শতকরা এক ভাগ স্বাস্থ্য নিয়ে। জনশিক্ষা বা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে সেখানে আলোচনা হয় না। বেশীর ভাগ ই স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উপরের, হিমশৈলের চূড়া নিয়ে তারা মুখর থাকেন- অনেকসময়ে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার মধ্যে পার্থক্য নিয়ে তাদের ধারনা অস্বচ্ছ। যে সরকার চল্লিশ পাতা জোড়া স্বাস্থ্য আইন বানিয়েছেন, সেই সরকারের বিত্তমন্ত্রী স্বাস্থ্য বাজেট বরাদ্দের সময় তার বক্তৃতা মাত্র একটি বাক্যে শেষ করেছেন। বাহ্যত স্বাস্থ্য নিয়ে বিতর্কে শাসকের ও বিদগ্ধ সমাজের অনীহা কোন গোপন বিষয় নয়।
যে আইনসভা বিতর্ক ছাড়া বাজেট পাশ করেছেন, সেই একই সভায় জনপ্রতিনিধিরা যে কোন বিতর্ক ছাড়া নিয়ন্ত্রন বিধি নিয়ে বিল পাশ করবেন তা বলা বাহুল্য।

 

দেশের মানুষের কাছে কোন সংকট বেশী গুরুত্বপূর্ণ তা আগে নির্ধারন করা প্রয়োজন। এ রাজ্যে শতকরা প্রায় ৬০ শতাংশ মা রক্তাল্পতায় ভোগেন, শতকরা ৩৪ ভাগ শিশু অপুষ্টির শিকার, লাখে ১৪৫ জন মা প্রসবকালীন জটিলতায় মারা যান, হাজারে ৩১জন নবজাতক মারা যাচ্ছে, আমরা সুপেয় পানীয় জল দিতে পারি নি, টীকাকরনে আমরা পিছিয়ে আছি, আমাদের ৭০০০ নতুন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র দরকার। পরিকাঠামোর অভাবই মূল সমস্যা। পশ্চিমবঙ্গে জনসংখ্যার তুলনায় শয্যা অপ্রতুল- প্রতি হাজার জনসংখ্যা পিছু সরকারী শয্যা সংখ্যা ১টির কম (০.৮)। চিকিৎসকের সংখ্যা গ্রামান্চলে প্রতি ১৮০০ জনে মাত্র একজন।

 

এমতাবস্থায় স্বাস্থ্য নিয়ে মানুষের ক্ষোভ খুব স্বাভাবিক। যদি অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোন থেকে দেখা হয় তাহলে বলতে হয় যে, সরকার রাজ্যের মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ের মাত্র ১৭.৩% ব্যয় করে। বাকী পুরোটাই ব্যক্তিগত খরচা- তার শতকরা ৭৪% খরচ হয় স্বাস্থ্য সংক্রান্ত নানা সরন্জাম ও ওষুধ কিনতে। আমার কাছে ২০১৪ সালের পর প্রয়োজনীয় তথ্য নেই কারন তথ্য সংক্রান্ত পুস্তিকাটি সরকারী ওয়েব সাইটে পাওয়া যাচ্ছে না। তবে পুরনো তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে যে রাজ্যে ২০১৩-১৪ সালে প্রায় ৭০ লক্ষ রোগীর চিকিৎসা হয়েছে। রোগীর মৃত্যুহার ও এ রাজ্যে তুলনামূলক ভাবে কম। তাহলে, পুরো ক্ষোভের মূল লক্ষ্য হিসেবে চিকিৎসকরা কেন আক্রান্ত হচ্ছেন? চিকিৎসকদের মধ্যে দুচারজন খারাপ আছেন তাদের পক্ষে বলতে চাই না। কিন্তু, মানুষের মূল অভিযোগ শয্যা পাচ্ছি না, প্রয়োজনের সময় দেখাতে পারছি না. পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য মাসের পর মাস বসে থাকতে হচ্ছে. এর কোনটায় চিকিৎসকদের আয়ত্বের মধ্যে নয়।
বেসরকারী পুঁজি বিনিয়োগ আমাদের দেশে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে হয়েছে । বস্তুত বেসরকারী স্বাস্থ্য ব্যয় সরকারের চেয়ে অনেকবেশী। জিডিপির মোট ৪.৫.% ব্যয়ের প্রায় ৩.৩% ব্যয়ই বেসরকারী বিনিয়োগ। বেসরকারী প্রতিষ্ঠান টাকা খরচ করেছে মুনাফা অর্জনের জন্য। তারা তা করছেনও । ওভার বিলিং এর সমস্যা বেসরকারী বিমা থাকলে হবেই- এর অন্যথা হওয়ার সম্ভাবনা কম। সুতরাং বেসরকারী প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রন করতে গিয়ে চিকিৎসক নিয়ন্ত্রন খুব বিপজ্জনক পরিস্থিতি। চিকিৎসক শত সতর্কতা নিলেও সব মৃত্যু রোধ করা যায় না। কিন্তু আইনে তাদের জন্য শাস্তির যে বিধান রচিত হয়েছে তাতে কিন্তু শাসকের রাগ ও সংস্কারের ছাপ দেখা যাচ্ছে। সমাজের বৃহত্তর অংশের মানুষের মৃত্যুর দায় যাদের তাদের বিরুদ্ধে খুনের মামলা না করে যারা বাঁচানোর চেষ্টা করছেন তাদের বিরুদ্ধে আইন?
যারা আইনের সপক্ষে কথা বলছেন তারা একবার আইনটি পড়ে বিতর্ক করলে ভালো হয়- কি কি ভাল ও কেন ভালো জানালে খুব সুবিধা হয়। আমাদের ধারনা আইনটি পড়ে আলোচনা করলে সকলের সুবিধা হবে। আমরা মনে করি বর্তমান পরিস্থিতিতে জনগনের চোখে ধুলে দেওয়াই এ আইনের উদ্দেশ্য । চিকিৎসকরা চিকিৎসা করতে ও রোগীরা চিকিৎসকের কাছে যেতে ভয় পাবেন। এই পরিবেশের বদল দরকার। তার জন্য আইন আদালতের প্রয়োজন ছিল না। আমাদের মুখ্যমন্ত্রী জননেত্রী, শুনেছি তিনি নিজেকে দিদি বলে সম্বোধন পছন্দ করেন। তাঁর রাজ্যে চিকিৎসকরা অসহায় বোধ করছেন, নানা ভাবে হেনস্থা হচ্ছেন। তিনি তাঁদের সমস্যার সমাধান করবেন, এটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু, দুর্ভাগ্যজনকভাবে তা ঘটে নি। তিনি বৃহৎ কর্পোরেশন যারা চালান তাদের কথা শুনেছেন, নার্সিংহোম যারা চালান তাদের সাথে কথা বলেছেন, তাঁর কমিশনের একাধিক সদস্য আছে যারা বড় কর্পোরেট হাসপাতালের পরিচালকমন্ডলীতে উচ্চপদে আসীন, কমিশনের চেয়ারম্যান ছাড়া অন্যপদগুলিতে যাঁরা আসীন তাদের কেউ কেউ এমনকি সুপ্রিম কোর্টের রায়ে দোষী সাব্যস্ত, তো কারো নামে বধুপীডনের অভিযোগ আছে। কিন্তু সাধারন চিকিৎসক যারা স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ধরে রেখেছেন, যারা নানা ভাবে হেনস্থা হচ্ছেন, যারা এমনকিছু রোজগার ও করেন না, যারা সাধারন মানুষের পাশে দাঁডিয়েই লড়াই করেন তাদের কথা তাঁর কাছে পৌছচ্ছে না।
আইন আদালতের দ্বারস্থ হওয়া গনতন্ত্রে স্বীকৃত পদ্ধতি। আদালতের নির্ণয় সবার কাছে গ্রহনযোগ্য। তাই চিকিৎসকদের একটা অংশ আইনের শরণাপন্ন হতে চান। অনেকে বলছেন, সরকারী চিকিৎসকরা এই আইনের প্রভাব থেকে মুক্ত। ধারনাটি সঠিক নয় বলে মনে করি। স্বাস্থ্য পরিসেবার পরিচালক হিসেবে সরকার এই আইনের ফাঁস থেকে মুক্ত কিন্তু সরকারী পরিষেবা প্রদানকারীরা এর অপ্রত্যক্ষ প্রভাব থেকে মুক্ত নন। পাইকারী হারে চিকিৎসকরা মার খাচ্ছেন- মহিলা চিকিৎসকরাও বাদ যাচ্ছেন না। সেদিন যারা গুসকরায় চিকিৎসককে মেরে তার ভিডিও বানিয়ে প্রচার করলো তারা এখনো গ্রেপ্তার হয় নি, লালগোলায় ও পালের গোদা গ্রপ্তার হয় নি...রানাঘাটে যারা তছনছ করে চিকিৎসকের স্ত্রীকে শাবল দিয়ে খোঁচালে তারা বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াচ্ছে।এর বিরুদ্ধে চিকিৎসকদের স্বার্থে ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব যার সেই আই এম এ রাজ্য শাখা নানারকম বিবৃতি দিয়ে নিজেদের দায় এড়াচ্ছেন। তারা মুখ্যমন্ত্রীকে চিকিৎসকদের করুণ অবস্থা সম্যকরূপে বলতে পারতেন। আই এম এ রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার শিকার হবে না এটাই কাম্য ছিল। তা হয় নি। কেউ বলছেন আইনের প্রয়োগ তেমন ভাবে হবে না, চিকিৎসকদের থানায় ডেকে পাঠালে এস এম এস করবেন। অর্থাৎ সাপটি মারবো না, ফনায় একটা সুতো বেঁধে মুখ বন্ধ রাখবো। সে সাপ কি করবে সাপ আর বেদেই জানে, বাকিরা গোবিন্দায়: নম:। তাই, নজরুলের কথা ধার করে বলি - বন্ধু , বড় বিষ জ্বালা এই বুকে/ দেখিয়া শুনিয়া খেপিয়া গিয়াছি/ তাই যাহা আসে কই মুখে।
_____________________________

ডা. রেজাউল করীম । পশ্চিম বাংলার প্রখ্যাত চিকিৎসক । মানবসেবী। কবি ও কল্যাণকলামিস্ট।

আপনার মতামত দিন:


মেডিক্যাল ক্যাম্প এর জনপ্রিয়