Ameen Qudir
Published:2017-04-25 16:53:34 BdST
"৭ খুনের আসামী বলেন আল্লাহর কথা শুনে আজ আমার এ অবস্হা"
অধ্যাপক ডা.মো. তাজুল ইসলাম
______________________
পলাশ,বর্তমান বয়স ৩৪। মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে।বাবা খুব রাগী মানুষ ছিলেন।প্রায়ই মারধর করতো। ১০-১১ বছর বয়সে তাদেরই এক ক্লাশমেট মেয়ের প্রেমে পড়ে তারা দু'বন্ধু।ঐ বন্ধুর রোল ছিল-১, তার রোল ছিল-২ ও ঐ মেয়ের রোল নং ছিল -৩। একদিন জুম্মার নামাজ শেষে তার ঐ বন্ধু বলে দোস্ত তোর কাছে একটি জিনিস চাইবো,দিবি? সে বলে হা দেবো।বন্ধু বলে এমনি বললে হবে না কসম খেতে হবে।পলাশ বলে কসম।বন্ধু বলে তাহলে কোরআন ছুয়ে বল।মসজিদ থেকে কোরআন এনে শপথ করায় বন্ধু যা চাইবে সে তা দিবে।
তখন বন্ধু বলে তুই আর বাড়ি ফিরে যাবি না,অন্যত্র চলে যা,তুই থাকলে ঐ মেয়েকে আমি পাবো না।পলাশ দ্বিধ্বায় পড়ে।কিন্তু কোরআন ছুয়ে কথা দিয়েছে সেটি বরখেলাপ করবে কিভাবে? তার মন বলে আল্লাহর কোরআন ছুয়ে শপথ ভাঙ্গলে চরম গুনাহ হবে।তাই সে তার সঙ্গে থাকা ৭-৮ টাকা সম্বল করেই ফরিদপুর থেকে ঢাকা চলে আসে।কমলাপুর এসে এক হোটেলের সামনে কাদতে থাকে।তখন হোটেলওয়ালা তাকে হোটেলে কাজ করতে দেয়।তবে সেখানে তাকে প্রচুর মারধর ও নির্যাতন সহ্য করতে হয়।এক সময় সেখান থেকে ৫০০ টাকা চুরি করে সে পালিয়ে মিরপুরে চলে যায়।
মিরপুরে এক মাঠে বসে থাকা অবস্হায় দুজন লোক তাকে ফুসলায় বোম মারতে পারবি? সে বলে আমি তো জানি না।তারা বলে শিখিয়ে দেবো।সে থেকে শুরু।
সে এক হরতালে বোমা মারে। পুলিশ তাকে দেখে ফেলে।কিন্তু সে দৌড়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।তার সাহস ও বুদ্ধি দেখে তার কদর বেড়ে যায়।ক্রমশ সে বোমা বানাতে শিখে,এরপর দেশীয় অস্ত্র বানাতেও শিখে এবং দুর্দান্ত কিলার হিসেবে নাম কুড়িয়ে ফেলে(?)।
চাদা না দিলে দিনে দুপুরে খুন করতো।এ পর্যন্ত ৭ টি খুন করেছে বলে জানায়।
১ম খুন- গরুর ব্যাপারীর কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা দাবী করে।অন্য আরেক গ্রপ ও সে সময় ঐ লোকের কাছে চাদা আনতে যায়।তখন পলাশ প্রতিপক্ষকে গুলি করে মেরে ফেলে।এটি নিয়ে তেমন কিছু হয়নি,কেননা তার গ্রপ ছিল অধিকতর শক্তিশালী। সে তখন কিছুদিন চিটাগাং এ গা ঢাকা দিয়ে থাকে।
এক সঙ্গে ৩ খুন- ম্যানেজারের কাছ থেকে চাদা আনতে যায়।সে ৫ লাখ টাকা দাবী করে, ম্যানেজার বলে ৩ লাখ নিন।
এতে তার মেজাজ বিগড়ে যায়, আমাদের কথার উপর কথা।সে বলে ৬ লাখ দিবি।কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে সে গুলি করে। ঐ লোক মারা যায়।তখন আরো দুজন এগিয়ে আসলে তাদের ও গুলি করে মেরে ফেলো।
সে প্রায়ই ছদ্মবেশে অপারশনে যেতো।তার নাম ডাক বাড়ার সাথে সাথে সে গড ফাদার ও বদল করতো।রাজনীতির উচ্চ স্তর থেকে তাকে ব্যবহার করা হতো ও তাকে শেল্টার দেওয়া হতো।কিন্তু এক সময় পুলিশের হাতে ধরা পরে ও জেলে যেতে হয়।
অপরাধ জগতের অনেক খবর জানে বলে পুলিশ তাকে তাদের সোর্স হিসেবে নিয়োগ দেয়।পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করার সময় এক " খারাপ" মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়।সে মেয়েটিকে শুধু ভোগ করবে ভাবে।কিন্তু মেয়েটি তার পিছু লেগে থাকে।একসময় তারা বিয়ে করে।কিন্তু মেয়েটি তার খারাপ কাজ ছাড়ে না।তাই সে বউ নিয়ে দূরে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়,যাতে সেও অপরাধ জগত থেকে দূরে থাকে,তার বউ ও খারাপ কাজে যেতে পারবে না।
দূরে গিয়ে তার অবৈধ উপার্জন হারাতে হয়।সে এখন রিক্সা চালায়।একদিকে আর্থিক অসঙ্গতি অন্যদিকে পুলিশের চাপ, তাই সে এখন দিশেহারা।আবার পুরনো জগত থেকে বিভিন্ন " মিশনের" আহ্বান আসছে।একসময় টাকার অভাব ছিল না,চাইলে হাজার হাজার টাকা পেয়ে যেতো।এখন দু পয়সা দিয়েও কেউ সাহায্য করে না।তার মনে হয় তাহলে কি আবার ঐ অপরাধ জগতে ফিরে যাওয়াই সঠিক কাজ হবে?
তার বউ হযরত শাহজালালের মাজারে নিয়ে তাকে শপথ করায় যাতে সে তার বউকে ক খনো না ছাড়ে।সে শপথের কারনে খারাপ জেনেও বউ ছাড়েনি।তার ভাষ্য আল্লাহর কথা শুনতে গিয়ে আজ আমার এ অবস্হা।আমি এখন কি করবো?
সংক্ষিপ্ত পর্যবেক্ষণ :
১। কোরআন ছুয়ে শপথ: এটি আদৌ সঠিক কোন কাজ কিনা? ধর্মের মৌলিক জিনিস না জেনে ও না মেনে শুধু কোরআন এর শপথের নামে যা কিছু করা কতটুকু ইসলাম সম্মত? ধর্মীয় গোড়া বিশ্বাস ও প্রকৃত ধর্মীয় অনুশাসন পূর্ন ভাবে জীবনে ধারন করা এ দুয়ের মধ্যে যে বিশাল পার্থক্য রয়েছে তা আমরা কতটুকু শিখতে পেরেছি, শিখাতে পেরেছি? জঙ্গীবাদীরা ও ইসলামের ও কোরআনের সামগ্রিক শিক্ষা গ্রহন না করে,খন্ডিত কিছু গোড়ামীর উপর দৃড় অন্ধ বিশ্বাসকে ধারন করে ইসলামের নামে পুরোপুরি ইসলাম বিরোধী নৃশংস কাজ করে যাচ্ছে।
নামাজ রোজার নাম নেই নিছক কোরআন এর শপথের নামে অনেক জগন্য কাজ আমাাদের সমাজে অহরহ ঘটছে।প্রকৃত আলেমদের তাই ইসলামের মূল ও পূর্নাঙ্গ ব্যাখ্যা সবার সামনে তুলে ধরতে হবে যাতে শুধু কোরআন শপথ করেছে বলে পলাশের মতন মারাত্মক ভুল কেউ না করে
২। মাজার শপথ: সেটি তো আরো নাজায়েজ কাজ।কিন্তু মাজার,পীর ভক্তদের সংখ্যা কি আদৌ কমছে? ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা,বিজ্ঞানের আলো সবার মাঝে ছড়িয়ে না দিলে এ সব অপচর্চা কমার সম্ভাবনা কম
৩। রাজনৈতিক শক্তির শেল্টারে পলাশদের মতন ক্রিমিনাল তৈরী হয়।রাজনীতির শুদ্ধিকরন কবে আসবে? পুলিশ প্রশাসনে দুর্নীতি , অপরাজনীতি বন্ধ করতে না পারলে সমাজে অপরাধ নির্মূল করা কঠিন কাজ।বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাধবে কে?
_______________________________
অধ্যাপক ডা.মো. তাজুল ইসলাম: দেশের জনপ্রিয় লেখক কলামিস্ট। সুবক্তা। সোশ্যাল সাইকিয়াট্রিস্ট। অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, কমিউনিটি অ্যান্ড সোশ্যাল সাইকিয়াট্রি বিভাগ, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা
আপনার মতামত দিন: