Ameen Qudir

Published:
2017-04-06 22:39:57 BdST

সিজার অপারেশন ও একটা গল্প


 

ডা. অসিত বর্দ্ধন
__________________________

ভ্যঙ্কুভারের কাছে হাসপাতালে রাতের অন্ কল ডিউটি। সারাদিন ওটি, শেষ করে ফিরেছি রাত ৩ টায়। জামা কাপড় ছেড়ে শুয়ে পড়তে ১৫ মিনিট লাগল না। শরীর টা আর চলছ না! কখন ঘুমিয়ে পড়েছি নিজে জানিনা।


মনে হোল অনেক দুর থেকে ফোনের শব্দ, চোখ বন্ধ রেখেই সেল ফোনটা হাতড়াই। ঘুম জড়ান গলায় বলি, হ্যালো!
"অসিত উই হ্যাভ এ কর্ড প্রলাপ্স কামিং । নিড ইউ এট ইয়োর আরলিয়েস্ট।"ফোন কেটে গেল। আমার ঘুম উধাও সাথে সাথেই।

একটানে শার্টের ভেতর দুই হাত, প্যান্ট কোমর পর্যন্ত তুলে চেন আটকালাম , মোজা টা পায়ে দিয়েই গ্যারাজে যেয়ে জুতার ফিতা না বেঁধেই গাড়ি স্টার্ট দিলাম।সব কিছুর উপড়ে লম্বা হুডি পড়েছি যেন আমার সদরঘাট দেখা না যায়! হাইওয়ে দিয়ে গেলে ২০ মিনিট লাগে বাসা থেকে হসপিটাল। ভেতর পথে ১৯ মিনিট। কিন্তু হাইওয়ে ধরলাম গাড়ি জোরে চালাত পারব বলে। ১১০ কিমি স্পিডের রাস্তায় গাড়ির কাঁটা ১৫০ এর ঘরে কাঁপছে! অন্য সময় পুলিশ ধরলে গাড়ি জব্দ হতো সাত দিনের জন্য, গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়ে গাড়িটা থানায় নিয়ে যেত, আর গৌরি সেনের ঘরে জমা দিতে হতো শ সাতেক ডলার।
তবে আজ সিজার করতে যাচ্ছি, তাই পুলিশ ধরলে ছেড়ে দেবে, বরঞ্চ এস্কর্ট করে নিয়ে যেতে পারে। হাইওয়ে থেকে নেমে ৫০ কিমি স্পিডের রাস্তাতেও ১০০ তে যাচ্ছি। টার্ন নিতে যেয়ে গাড়ি একটু স্লিপ করেই যাচ্ছিল!
পারকিং থেকে দৌড়ে গেলাম অবস ওয়ার্ডে।
দেখি নার্স হাসছে , আমার চেহারা দেখে!
রোগী কোথায়? আমি হাঁপাই, বুড়ো বয়সে উসাইন বোল্ট হওয়া যায় না কি!
"কাম ডাউন, উই ডোন্ট নিড সি এস"
ব্রম্ভতালু জ্বলে গেল, "হোয়াট!"

এই মহিলা হোম বার্থ করাতে চেয়েছিলেন। মিড ওয়াইফের তত্ত্বাবধানে ছিলেন, রাত থেকে একটু একটু ব্যাথা হচ্ছিল, ভোর রাতে ব্যাথাটা যখন বেশি, তখন স্বামী ভদ্রলোক মিড ওয়াইফকে ফোন করেন। এরপরে নিজে একটু পরীক্ষা করতে যেয়ে দেখেন সাদা কি একটা বেরিয়ে আছে। দেখতে নাড়ীর মত। আবার মিড ওয়াইফকে ফোন করলেন।

মিড ওয়াইফ বললেন "তুমি ঠিক সাদা দেখেছ? "
"আলবৎ"
এম্বুলেন্স , অবস ওয়ার্ড, নার্স, সার্জন, আর এই বেচারা ক্লান্ত এনেস্থটিস্ট সবাইকে ফোন করতে ২ মিনিট, রোগী হাসপাতালে পৌঁছাতে ১৫ মিনিট আর পরীক্ষা করতে ২ মিনিট। ২০ মিনিটের মধ্যে জানা গেল সব ঠিক আছে। সাদা বস্তুটি নাড়ী নয়, মিউকাস!
এর মধ্যে নার্স ইমারজেন্সি ওটি খুলে ফেলেছে।
ওই স্বামীর শাপান্ত করতে করতে আবার ঘর মুখো হই।
তবে সিজার না হওয়াতে অসন্তুষ্ট নয় কেউ! এক ঘণ্টা বেশি ঘুমের সুযোগ পাওয়াতে সবাই খুশি !

একটা কর্ড প্রলাপ্স ঢাকার বাসায় হলে বাচ্চাটার কি হবে? প্রসুতিবিদ, এনেস্থটিস্ট , নার্স সবাই কি ২০-৩০ মিনিটের মধ্যে বাচ্চা ডেলিভারি করাতে পারবেন?


কি হবে, যদি প্রসূতি বিদ বলে থাকেন যে এখনো যেহেতু ভাল করে ব্যাথা ওঠেনি, আপনি আবার আগামী কাল সকালে আসেন, অথবা ব্যাথা বেড়ে গেলে আসেন। রোগী বাসায় গেলেন আর তারপরে কর্ড প্রলাপ্স হোলো!

পরের দিনের পত্রিকার শিরোনাম কল্পনা করুন!

আমাদের হাসপাতাল গুলোতে সাধারণ প্রসবের জন্য যে জনবল, যন্ত্রপাতি, জরুরি প্রয়োজনে সিজার করার ব্যবস্থা সহ এমন ব্যবস্থা কি আছে যে রোগীকে শেষ সময় পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করবে? গর্ভস্থ শিশুর অবস্থা পরিমাপের যন্ত্রপাতি? শিশুর কিছু হলে তার দায় কার?
পশ্চিমা উপাত্ত মাথায় রেখে দেশীয় অপ্রতুল জনবল ও কাঠামো , এবং আমাদের আকাশচুম্বী চাহিদার সমন্বয় কি আদৌ সম্ভব?
এই কাঠামো ঠিক না করে সিজারর সংখ্যা বাড়ার জন্য যে উদ্বেগ, এবং যে চাহিদা সেটা আমার কাছে অনেকটা ডাকাতের বাড়ির বউয়ের গল্পের মত। ছোট করে গল্পটা বলি।

এক ডাকাতের বাড়ির মেয়ের সাথে একটা ভাল মানুষের প্রেম হয়েছে। সেই ডাকাতের বাড়িতে রাত্রে নিমন্ত্রণ হয়েছে ভাল মানুষের। বাজিয়ে দেখার জন্য যে সে সত্যি এই বাড়ির উপযুক্ত কি না। মেয়েটি তাকে কিভাবে ডাকাতের বাড়ির পরীক্ষা পার হতে হবে সব শিখিয়ে দিয়েছে। যেমন পিড়ি দিলে সেটা নাড়া দিয়ে দেখতে হবে নীচে কিছু আছে কিনা। গদিতে বসা যাবে না, ভেতরে ছুড়ি থাকতে পারে, ইত্যাদি। সেইদিন রাতে খাওয়ার শেষে ওই ভাল মানুষ শুনছেন যে বাড়ির গিন্নি কাজের মেয়েটিকে আগামীকালের বাজারের ফর্দ দিচ্ছেন।
"এই নে দশ টাকা, কাল সকালে ষোড়শ ব্যাঞ্জন রান্না করব, মাছ, মাংস, সবজি, দুধ, দই, মিষ্টি ও ফলমুল আনবি। "
ভাল মানুষটি ভাবছে এটা কি একালের না কি শায়েস্তা খাঁ'র আমলে গল্প?
তখনো গিন্নিমার কথাটা শেষ হয়নি।

" আর বাজার শেষে দশটা টাকা ফেরত ও নিয়ে আসবি''

__________________________

ডা. অসিত বর্দ্ধন । পাঠক ধন্য সুলেখক। প্রবাসী। তার তৈরী করা অ্যাপস ডাক্তারদের কল্যাণে এখন জনপ্রিয়।

আপনার মতামত দিন:


মেডিক্যাল ক্যাম্প এর জনপ্রিয়