Ameen Qudir

Published:
2017-03-22 22:32:14 BdST

প্রেতাত্মা বনাম সংসার খেকো মহাসুন্দরী


 

 

 


ডা. শিরিন সাবিহা তন্বী

 

_______________________________

খুব সকাল সকাল শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে আমি ওর দেয়া নীল শাড়ীটা বড্ড যত্ন নিয়ে পরছি।আমার স্বামী ঘুম থেকে উঠে বিছানায় কাত হয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে আমার পানে চেয়ে আছে।কুচি ঠিক করতে করতে বার বার আয়নায় তাকাচ্ছি আমি।


কি নিঁপুন অভিনয় আমার!আয়নায় আমার কোন ই প্রতিবিম্ব নেই।থাকবে কি করে?প্রেতাত্মাদের কি প্রতিবিম্ব পড়ে?আমি যে কেবল ই প্রেতাত্মা!

আমার স্বামীর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয় যেবার সে প্রথম সরকারী চাকরীর পরীক্ষা দিয়ে এল তখন।আমরা ওর মাস দুয়েক আগে তাদের বাড়ীতে ভাড়াটে হয়ে আসি।


বাবার ক্যান্সারের চিকিৎসায় গ্রামের বাড়ী বিক্রি করে আমরা শহরে বাসা ভাড়া করি।বাবাকে বাঁচাতে পারলাম না।সদ্য পিতৃহারা বিধ্বস্ত আমি আর আমার বিধবা মা।আমার শ্বাশুড়ী মানে তৎকালীন বাড়ীওয়ালী আমাদের দুজনের প্রতি খুব ই দয়াশীল ছিলেন।কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না।বাবার মৃত্যুর ছ মাসের মধ্যেই শোকে দুঃখে মা ও পৃথিবী ছাড়লেন।আমার শ্বাশুড়ী মা তখন মমতা আর দায়িত্ব বোধের ডাবল ধাক্কায় আমার মত অসম্ভব রুপবতী আর গুনবতী গেঁয়ো মেয়েটিকে তার ছেলের কাঁধে চাপিয়ে দিলেন।

বিয়ের অল্পদিনের মধ্যেই আমি বুঝতে পারলাম।রূপবতী বলে সে আমায় ভোগ করে।কিন্তু সে আমাকে ভালোবাসে না।এক ফোঁটা সম্মান ও করে না।
তার ধীর স্থির স্বভাব,শান্ত চাহনী আর অমন ব্যক্তিত্ব দেখে আমি রোজ ই তার প্রেমে বার কয়েক হাবুডুবু খেতাম।
এর মাঝে তার কি যেন চাকরীর প্রশিক্ষন এলো।চার মাসের জন্য সেখানে গেল সে।
ওখানেই আমার স্বামীর সঙ্গে পরিচয় হয় সেই সংসার খেকো মহাসুন্দরীর।সব অফিসার নাকি তার ফিগার দেখে তার রূপের ঝলক দেখে প্রশিক্ষন বাদ দিয়ে অপলক চেয়ে থাকত!কেবল আমার স্বামী ই তাকে পাত্তা দিত না।স্বামীর এক কলিগের থেকে এগুলো জেনেছিলেম।আর ঐ মায়ারাক্ষুসী এত পুরুষ থাকতে আমার স্বামীর ই প্রেমে পড়ল।

সে কি আর যেই সেই প্রেম!সর্বত্র রটে গেল।দুজনেই পৃথিবীকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে হচ্ছিল বন্য।

ট্রেনিং শেষে বাসায় আসতেই বুঝতেছিলেম কিছু একটি গন্ডগোল।এত ছোট আমি,অত শিক্ষে দীক্ষে ও নাই।কি করলে সব ঠিক হয়ে যাবে কিছু বুঝতেছিলাম না।শ্বাশুড়ী মা এক দরবেশ বাবার কাছ থেকে পানি পড়া এনে খাওয়াতে লাগলেন আমাকে।আলতা,স্নো,পাউডার ও কম মাখালেন না,যাতে তার ছেলে আমাকে একটু ভালবাসে।কাছে থাকে।
পানি পড়ায় কাজ হলো।
স্বামী ছুটি নিয়ে আমাকে সহ সিলেটে এক বাংলোতে বেড়াতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলেন।আমি তো খুশিতে বাকবাকুম।শ্বাশুড়ী মা ও ঝলমল করছিল।এতদিনে বোধ হয় সুখের দিন এলো!

এটা ছিল গত তিন বছর আগে এমন দিনের কথা।এই বাংলোতেই সতীনকে প্রথম দেখেছিলেম।
ওরা এমন ভাব করল যেন জানত ই না দুজন ই একি রিসোর্টে উঠবে!বন্ধু বলে পরিচয় করিয়ে দিল। সন্ধ্যার পরে আমাকে ওরা এক নির্জন রাস্তায় নিয়ে গেল।আমাকে কি যেন একটা জুস খেতে দিয়েছিল ঐ টিনা।আমি খেয়েছিলেম।তারপর খুব ঘুম পেল।যখন জেগে উঠলাম দেখলাম ওরা দুজন মিলে গাড়ীর ভেতরেই গলা টিপে আমাকে মারছে।শ্বাস বন্ধ হয়ে মারা গেলাম আমি।সে যে কি কষ্ট!

ঐদিন গলাকাটা অমাবস্যার রাত ছিল।আমি মরে যাবার পর আমার লাশটাকে ধাক্কা দিয়ে পাহাড় থেকে ফেলে দেয় ওরা।
মরে যাবার পর আর ব্যথা পাচ্ছিলাম না।শরীর থেকে বেরিয়ে গেছি তখন আমি !তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম,গাঁয়ের বাড়ীর এক সাধারন মেয়ে,মৃত বাবা মায়ের চোখের মনি কুসুমের ছোট্ট শরীরটাকে ওরা ঠেলে ফেলে দিচ্ছে।আমি চিৎকার করতে চাইলাম।গলা থেকে কোন আওয়াজ আসছিল না।
পরে দুজন মিলে ভাড়া গাড়ীটাকে ভাঙ্গল।লোকজনকে বলল দুর্ঘটনা।
ঐ রাতেই ওরা বিয়ে করল মালা বদল করে।পরে কোর্টে করেছিল।
আমাকে একেবারে মুছেই দিল পৃথিবীর বুক
থেকে!
দিশেহারা আমার আত্মা হন্যে হয়ে ঘুরতে ঘুরতে এই পাহাড়েই আরো অনেক অতৃপ্ত আত্মাকে সঙ্গী পেলাম।আমরা একে একে সব অপমৃত্যুর প্রতিশোধ নেয়ার পন করলাম এক অমাবস্যার রাতে।

প্রথম বিয়ে বার্ষিকী পালন করতে সেই পাহাড়, সেই রিসোর্টেই ওরা দুজন এলো।
আমি ঠিক তখন ই ভয়ংকর প্রতিশোধ নিলাম।
এই রিসোর্টের পেছনেই আমরা সব প্রেতাত্মারা বিড়াল রুপে এসেছিলাম।টিনা ছবি তুলছিল দামী ক্যামেরা হাতে।আমরা একে একে ওর সামনে এলাম।ওকে সম্মোহিত করে আমরা ওকে চোখের ধাঁধা দিয়ে রাস্তা ভুলিয়ে নিয়ে গেলাম দূরে এক দুর্গম পাহাড়ে।তারপর ঠেলে দিলাম অন্ধকার মৃত্যু কূপে।
তারপর????
আমি টিনা হয়ে গেলাম!ঔদ্ধত,বন্য আদিম,উত্তপ্ত রমনী!ওর ক্যামেরাটা গলায় ঝুলিয়ে চলে এলাম আমার অভিশপ্ত ১৯১ নম্বর ঘরে।এমন ভাব করলাম যেন কিছুই ঘটেনি।এ ঘরে টিনার আর আমার স্বামীর কি ছিল আমার জানা নেই।তবু আমি তার সাথে এ ঘরেই আসি।বিবাহ বার্ষিকী পালন করি।

আমি কুসুম নামক প্রেতাত্মা।টিনার শরীর ধারন করে লোকালয়ে আছি।

আমি সকলের মনের কথা জানি।
প্রথম বিবাহ বার্ষিকী পালনের পর টিনা বড্ড বদলে গেছে। সে যেন একটু বেশী রহস্যময়ী।ধীর স্থির শান্ত আর স্বল্পভাষী।এই টিনা ভীষন একরোখা - কোন ছবি তুলতে দেয় না।ঘরে আয়না রাখতে দেয় না।ওর আয়না নাকি আমি।গভীর মুগ্ধতা হৃদয়ে নিয়ে ঘুম চোখে চেয়ে থেকে ভাবছে প্লাবন,আমার স্বামী।।

______________________

ডা. শিরিন সাবিহা তন্বী । জনপ্রিয় লেখক-কলামিস্ট । পেশাজীবী নেতা।

আপনার মতামত দিন:


মেডিক্যাল ক্যাম্প এর জনপ্রিয়