Ameen Qudir

Published:
2017-02-23 16:31:24 BdST

ডাক্তার বনাম রোগী : লিখতে রীতিমত ভয় লাগছে


 



 

ডা. এজাজ আহমেদ, এমডি, পিএইচডি
_______________________________

এমন একটা স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে লিখতে একজন ডাক্তার হয়েও রীতিমত ভয় লাগছে। একজন স্বল্প শিক্ষিত কিম্বা দরিদ্র লোককে সহজে আগ-বাড়িয়ে জ্ঞান দেয়া যায়। কিন্তু একজন শিক্ষিত লোককে কিছু বলতে যাওয়া মানে আগ বাড়িয়ে চড় খাবার মত অবস্থা।


কিন্তু বিষয়টা কোন না কোন ভাবে বারবার এসে যাচ্ছে । ইদানিং পত্রপত্রিকায় বারবার সংবাদ হয়ে এসেছে, বিভিন্ন হাসপাতালে ডাক্তার, সাংবাদিক আর সাধারণ জনগণ তথা রোগীর লোকদের মাঝে মারামারি। ব্যাপারটা নিত্যনৈমিত্তিক কেন ঘটছে তা একটু খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। একজন ডাক্তার আর রোগীর সম্পর্কটা দার্শনিক হিপোক্রেটিসের শপথ দিয়ে কঠিনভাবে বাঁধা। প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির মধ্যে ব্যাপক ব্যবধানের কারণেই এমনটা বারবার ঘটছে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। একজন রোগী বা আমি নিজেই যখন একজন ডাক্তারের কাছে যাই, তখন প্রত্যাশা থাকেঃ

১। ডাক্তার আমার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনবেন।

২। কথা বলার সময় আমার প্রাইভেসির নিশ্চয়তা করবেন, অন্য ৩ জন রোগীর সামনে কি সব কথা বলা যায়?

৩। সমস্যা কি সেটা আমাকে বুঝিয়ে বলবেন।

৪। আমার অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনা করে একটা ট্রিটমেন্ট প্লান দিবেন, যে যুদ্ধটা আমি আর আমার ডাক্তার মিলে একসাথে জয় করতে পারব।

৫। একটু ভালো ব্যবহার সবারই অন্যতম প্রত্যাশা।

কিন্তু বাস্তবে কি পাই, ডাক্তার সব কথা শুনার আগেই প্রেসক্রিপশন লিখতে শুরু করেন, পেটে ২টা চাপ দিয়ে একটা প্রেসক্রিপশন হাতে ধরিয়ে বলেন, ঔষধ গুলো খেয়ে ২ দিন পর দেখা করবেন (একটু বাড়িয়ে বললাম, বাস্তবে এতটা হয়ত সবসময় ঘটে না, তবে ঘটে)। একটার বেশী ২টা প্রশ্ন করলেই ঝাড়ি খাবার সম্ভবনা।


ফলশ্রুতিতে দেখা যায়, ডাক্তার-পেশেন্ট রিলেশনশিপ কখনোই ডেভেলপ করে না। রোগীরা ঘন ঘন ডাক্তার বদল, ঠিকমত ঔষধ না খাওয়া, আর সুফলের বদলে কুফল পেলে ডাক্তারের অফিস বা হাসপাতাল আক্রমণ।

 

কিন্তু এমনটা কি হবার কথা ছিল? অপরিচিত একজন, হাতে একটা ঔষধ ধরিয়ে দিলে আমরা কেউই কখনো নিব না, খাওয়া তো দূরের কথা। অথচ ঔষধ সেবন করলে (মাত্রা অতিরিক্ত) মৃত্যু হতে পারে জেনেও আমরা ডাক্তারের দেয়া ঔষধ নির্দ্বিধায় খেয়ে নেই। ডাক্তারের উপর এতটা বিশ্বাস করি বলেই এই রিক্সটা নেই। সেখানে বিশ্বাসের বরখেলাপ হলে হতাশ হওয়াটাই স্বাভাবিক।

 

ডাক্তারের পক্ষটা একেবারেই না শুনলে ভারি অন্যায় হবে। একজন ছাত্রের ছোটবেলা থেকে কঠিন অধ্যবসায়ের ফসল মেডিকেলে চান্স পাওয়া। মেডিকেলের সবচে খারাপ ছাত্রটিও জীবনে অনেক রাত পড়তে পড়তে ভোর করেছে, দিনকে রাত করেছে। প্রতি সপ্তাহে আইটেম পরীক্ষা, মহাসমুদ্রের মত এক একটা প্রফেশনাল পরীক্ষা শেষ করে যখন তীরে এসে পৌঁছায় তখন ছাত্রের চেয়ে পরিবারের অন্য সবার প্রত্যাশা হয়ে যায় অনেক বেশী।

ডাক্তার যখন দেখে তার চেয়ে অনেক কম মেধার সঙ্গীরা জীবন যুদ্ধে গাড়ী-বাড়ি, স্ত্রী সন্তান নিয়ে অনেক দূর এগিয়ে গেছে, তখন একজন ডাক্তারকেও সমাজের সাথে তাল মেলানোর জন্য জীবন যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়, ন্যায়-অন্যায়ের সাথে আপোষ করতে হয়। ছুটে চলাই জীবন, সারাদিন চাকরী, তারপর প্রাইভেট প্র্যাকটিস, ক্লিনিক ভিজিট, ছুটির দিনে মফঃস্বলে প্র্যাকটিস। ডাক্তার তখন পরিণীত হয় টাকা উপার্জনের যন্ত্র, পরিবারের সবাই হয়ে পড়ে তার উপর নির্ভরশীল।

 

এমন কি লতায়-পাতায় আত্মীয় থেকে শুরু করে পুরা গ্রাম পর্যন্ত। বিরামহীন চাহিদা মিটাতে গিয়ে একজন মানুষের ভিতর কি আর কিছু থাকা সম্ভব?

হাতের নাড়ী ধরেই সব কিছু বলে দেয়া সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন উন্নত প্রশিক্ষণ।

এতগুলা বছর পড়ার পর কয়জনের ভাগ্যে জোটে পোষ্ট-গ্র্যাজুয়েট প্রশিক্ষণের? মামার জোর কি সবার থেকে? মেডিসিনে ৬ মাস আর সার্জারিতে ৬ মাস ইন্টার্নই করে, মেডিসিন আর সার্জারির মত বিশাল সাগরকে সামাল দেওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। সবচে বড় অসুবিধা মডার্ন টেকনোলজি সব ডাক্তারের নাগালের মধ্যে নেই। ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠা কয়টা ল্যাব রিপোর্টের উপর একজন ডাক্তার নিশ্চিন্তে নির্ভর করতে পারে? সিটি-স্ক্যান, MRI, প্যাথলজি, আলট্রা-সাউন্ড, বিভিন্ন বিশেষ ব্লাড টেস্ট ছাড়া কি আধুনিক যুগে ডাক্তারি করা সম্ভব? শুধু ডাক্তারকে দোষ দিয়ে লাভ কি?

যেটা করা প্রয়োজনঃ

১। মেডিকেল শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢালাও করে সাজানো দরকার। বাস্তব জীবনে যে রোগ এবং কমপ্লিকেশনস গুলো একজন ডাক্তারের সবচে বেশি জানা প্রয়োজন সেগুলোর উপর জোর দেয়া প্রয়োজন। অনেক সময় দেখা যায়, পরীক্ষা পাশ করতে গিয়ে এমন সব পড়তে হয় যা বাস্তবে খুব একটা কাজে আসে না। বিরল সব রোগের আদ্যপান্ত লাইনের পর লাইন মুখস্ত অথচ সাধারণ রোগ ধরতে পারছে না। কারণ একটাই, থিওরিতে স্ট্রং, প্রাকটিক্যালে কাঁচা।

২। ভর্তি পরীক্ষায় একটা মনস্তাত্বিক অংশ থাকা প্রয়োজন, যেটাতে নিশ্চিত করবে একজন ছাত্রের এই প্রফেশনে যে অধ্যবসায় এবং ত্যাগের প্রয়োজন আছে, সেটা করতে পারবে কিনা। সব প্রফেশন সবার জন্য নয়।


অনেক সময় দেখা যাচ্ছে, মেডিকেল স্টুডেন্ট কিছুদিন পরই বুঝতে পারছে এই প্রফেশন তার জন্য নয়। তারপর পিতামাতার চাপে পড়ে যাচ্ছে, পাশ করে ব্যবসা বা অন্যকিছু করছে, এটা একজন মেধাবী ছাত্রের জন্যও লস, প্রফেশনের জন্যও লস। শুধু টাকা উপার্জনের জন্যও এই প্রফেশন নয়। তাই উন্নত বিশ্বে এটার উপর খুব গুরুত্ব দেয়া হয়।

 

৩। নাইন-টেন থেকেই ছাত্রদের বিভিন্ন হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয়, ইন্ডাস্ট্রিতে টুরের ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন, যাতে ছাত্ররা বুঝতে পারে কোন বিষয়ে তাদের ইন্টারেস্ট।

৪। ইন্টার্নশিপের সময় বাড়িয়ে সাবজেক্ট স্পেসিফিক করা প্রয়োজন, যেমন মেডিসিন বা সার্জারিতে ১ বছরের পরিবর্তে ২-৩ বছরের ট্রেনিংএর ব্যবস্থা করা উচিত। এ সময় উপযুক্ত বেতন থাকা আবশ্যক। এত বছর লেখাপড়ার পর একজন ইন্টার্ন-ডাক্তার সমসাময়িক অন্যান্য প্রফেশনের তুলনায় যে বেতন পায়, সেটা রীতিমত হাস্যকর।

৪। পোষ্ট-গ্র্যাজুয়েট প্রশিক্ষন সহজতর এবং সহজলভ্য করা উচিত।

৫। মডার্ন টেকনোলজি যেন সব ডাক্তারের নাগালের মধ্যে থাকে সরকারের সেদিকে নজর দেয়া উচিত।

৬। প্যাথলজি ল্যাব, হাসপাতাল এবং ক্লিনিকগুলোর মান নিয়ন্ত্রণের জন্য কঠিন ব্যবস্থা থাকা উচিত।

৭। ভূল চিকিৎসার কারনে ক্ষতির প্রতি ডাক্তারদের দায়বদ্ধতা কোনমতেই এড়াতে দেয়া উচিত নয়। ভুলটা ইচ্ছাকৃত নাকি অন্য কোন ব্যাপার তা যাচাইয়ের জন্য যথাযথ কতৃপক্ষ থাকা উচিত।

 

৮। ডাক্তারদের রোগীদের সাথে কমিউনিকেশনে পারদর্শী করে তোলার জন্য বিভিন্ন হাসপাতালে অথবা সেমিনার করে কোর্সের আয়োজন করা উচিত। ডাক্তারি পেশায় কমিউনিকেশনটা একটা আর্টের মত। যে ডাক্তার এই আর্টে যত বেশী পারদর্শী সে তার পেশাদারিত্বে তত বেশী সফল। আমেরিকায় ডাক্তারদের জন্য হাসপাতাল কর্তিপক্ষ এই ধরনের কোর্সের আয়োজন করে থাকে।

 

৯। রোগীরা যাতে ডাক্তারদের প্রকৃত মূল্যায়ন করতে পারে সে জন্য পেশণ্ট সার্ভের ব্যবস্থা থাকা উচিত। যাতে নূতন রোগীরা ডাক্তারের রেংকিন দেখে ডাক্তার পছন্দ করতে পারে, আর ডাক্তারও নিজের যশ-খ্যাতি অটুট রাখার জন্য রোগীকে সেরা সেবা প্রদান করায় সচেষ্ট থাকবে।

ডাক্তারি প্রফেশনটা অন্যান্য প্রফেশনটার মতই সমাজের একটা অংশ। অন্যান্য প্রফেশনে যেমন ভালো লোক আছে, খারাপ লোক আছে, এই প্রফেশনেও আছে। পুরা সমাজ আর দেশের ইনফ্রাস্টেকচারের প্রগতিমুখী পরিবর্তন না করে শুধুমাত্র ডাক্তারী প্রফেশনের পরিবর্তন সম্ভব নয়। কিছু ডাক্তার রোগী দেখে শেষ করতে পারে না, আর কিছু ডাক্তার রোগী পায় না। একটু মাথা খাটালেই বুঝা যাবে ব্যবধানটা জ্ঞান আর ব্যবহারের পার্থক্যের কারনেই।

তারপরও শত প্রতিকূলতার মাঝে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মাঝে বাংলাদেশের ডাক্তার এবং চিকিৎসা ব্যবস্থা অনেকটা এগিয়ে। এর জন্য ডাক্তারদের বাহবা না দিয়ে উপায় নেই। তবে সম্মান কেউ কাউকে এমনিতেই দিয়ে দেয় না, এটা অর্জন করতে হয়।

_________________________________

লেখকঃ এজাজ আহমেদ। MD, Ph.D.
লোকসেবী।
বর্তমানে আমেরিকায় চিকিৎসক হিসাবে কর্মরত।

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়