Ameen Qudir

Published:
2017-01-15 15:30:20 BdST

কোথাও বিপদে পড়লে যেভাবে পুলিশের সাহায্য নেবেন



অতিরিক্ত উপ পুলিশ কমিশনার নাজমুন নাহার ডাক্তার প্রতিদিনকে জানিয়েছেন , লেখাটি তার সম্মতি সাপেক্ষে রচিত।
______________________

ধরুন, আপনি আর আপনার বান্ধবী বোরখা কিনতে গেলেন নিউমার্কেটে।

বায়তুল আমান মসজিদের নিচে শাওন ফ্যাশনে ঢুকলেন। দু-একটা বোরখা দেখার পর বাজেটে কুলাবে কিনা বুঝতে দাম জানতে চাইলেন। দোকানি আপনাকে রঙ পছন্দ করতে বললেন। আপনি বুঝলেন রঙ পছন্দ না করলে দাম বলবে না। অগত্যা আপনি একটা বোরখা দেখিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ধরেন এইটা’।

দোকানি দাম হাঁকলো ৩২০০ টাকা। আপনি জানেন প্রকৃত মূল্যের চেয়ে এই দাম কয়েকগুণ বেশি। ফলে আপনি দর-দামের প্রয়োজনই মনে করলেন না। বান্ধবীকে নিয়ে বেরিয়ে যেতে গেলেন। দোকানি আপনাকে ডেকে বললো, পছন্দ যখন করেছেন, একটা দাম বলতেই হবে। আপনি চুপ থাকলেও বান্ধবী বলে বসলো, ‘১১০০ টাকা।’ দোকানি সঙ্গে সঙ্গে প্যাকেট করে বোরখাটা আপনার হাতে গছিয়ে দিলো!

যেহেতু আপনি ক্রেতা, অতোটা পছন্দও হয়নি, ফলে আপনি বললেন, ‘দেখুন, কিনবো আমি। দাম তো আমি বলিনি। আমি আরেকটু দেখে আসি। আপনি প্যাকেটটা রাখেন।’

এবার দোকানি হুংকার ছাড়লেন। বোরখা না নিয়ে বেরোতে দেবে না। আপনি তখন বললেন, ‘আপনি তো জোর করে গছিয়ে দিচ্ছেন। না নিলে কি করবেন?’ আপনার ব্যাগ টেনে দোকানির উচ্চস্বরে জবাব, ‘দোকানের মধ্যেই বেইজ্জতি করবো।’
আপনি স্বভাবতই ভয় পেয়ে কথা না বলে দ্রুত বেরিয়ে যেতে গেলেন। এবার দোকানি তার কর্মচারিসহ দুই হাতে ব্যারিকেড দিয়ে আপনাকে আটকালো! উপর্যপুরি গালি খেয়ে শারিরিকভাবে লাঞ্ছিত হবার ভয়ে বাধ্য হয়ে বোরখার প্যাকেট নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে নিউমার্কেট থেকে বেরিয়ে এলেন আপনি!

এই মুহুর্তে আপনি কি করবেন?
যেহেতু আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, ধরে নিচ্ছি আপনি চুপচাপ মেনে নিতে চাইছেন না। কিছু একটা করতে চাইছেন। হয়তো বন্ধুদের জানাবেন। তারা হল থেকে একগাদা ছেলে-পেলে এনে মারপিট করবে। নিউমার্কেটের কর্মচারি এবং আপনার বন্ধুরা মিলে হয়তো বেশ কজন আহত হবে। তারপর পরদিন আবারো একই ঘটনা ঘটবে অন্য কোন মেয়ের সাথে। এসব ঘটনার সম্ভাব্য পরিণতি এমনই।

কিন্তু, না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের যে মেয়েটির সাথে গত বৃহস্পতিবার এমন ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে সেই মেয়েটি মারপিটের মধ্যে যায়নি, চুপচাপ মেনেও নেয়নি। সে এগিয়েছে আইন মেনে এবং প্রতিবাদের সঠিক রাস্তাটা ধরে।
ফলাফল? সফল প্রতিবাদের আরো একটি দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে আজ।

আজ থেকে ঠিক দুমাস আগে নিউমার্কেট এলাকায় এমনই এক ঘটনায় লাঞ্ছনার শিকার হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রী ও তার মা। সেই ঘটনা এবং তার প্রতিবাদের বিস্তারিত উল্লেখ করে দেয়া আমার একটি পোস্ট ফেসবুকের কল্যানে ভাইরাল হয়েছিল। এরপর মার্কেটগুলোতে তৈরি হয় ব্যাপক গণসচেতনা। নিউমার্কেট থানা পুলিশ বড় বড় ব্যানার ছাপিয়ে তাতে উর্ধতন কর্মকর্তাদের ফোন নাম্বার দিয়ে মার্কেটগুলোতে টানিয়ে দিয়েছেন। মেয়েরাও এখন নিয়মিত অভিযোগ করছেন। প্রতিকার পাচ্ছেন।
কিন্তু এতো কিছুর পরও পুনরায় এমন আরেকটি ঘটনা ঘটবে তা কেউই আশা করিনি। তবে আশার কথা, এমন ঘটনা ঘটনার পর ভূক্তভোগি মেয়েটি অভিযোগের সঠিক পদ্ধতিটি অনুসরণ করায় অপরাধীকে আইনের আওতায় এনে বিচারের মুখোমুখি করা গেছে।

গত বৃহস্পতিবার বোরখা কিনতে গিয়ে লাঞ্ছিত হবার ঘটনা ঘটনার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ফেসবুক গ্রুপ ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার’-এ পুরো ঘটনা উল্লেখ করে ভূক্তভোগি মেয়েটি একটি পোস্ট দিয়েছিল। যেহেতু এমন একটা ঘটনায় পূর্বে আমরা একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পেরেছিলাম, সেহেতু মেয়েটিকে তার বন্ধুরা আমার সাথে যোগাযোগ করতে বলে। মেয়েটি যোগাযোগ করে। একটি লিখিত অভিযোগসহ তাকে থানায় যেতে পরামর্শ দেই। এরই মধ্যে কথা বলি ওই জোনের অপরাধীদের কাছে ক্রমেই ত্রাস হয়ে ওঠা সৎ ও কর্মঠ পুলিশ অফিসার নাজমুন নাহার আপুর সাথে। তিনি পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দেন। আজ সকালে মেয়েটির বাবাও নরসিংদী থেকে চলে আসেন। এরপর নাজমুন আপুর নির্দেশে এসআই মনির ভাইয়ের নেতৃত্বে দুপুর সাড়ে বারোটায় অভিযান চললো নিউমার্কেটে।

অপরাধ স্বীকার করার পর দোকান মালিক সমিতির জোর চেষ্টা এবং মেয়েটির বাবার পা ধরে মাপ চেয়েও রক্ষা পায়নি ওই বজ্জাত কর্মচারি। তাকে থানায় ধরে আনে পুলিশ। থানায় ছেলেটির গগণবিদারী কান্না ও ক্ষমা প্রার্থণার এক পর্যায়ে মেয়েটির নরম মনের বাবা মানবিক দিক বিবেচনায় মামলা থেকে বিরত থাকেন। জীবনে আর কোনদিন এমন কাজ করবে না এই মর্মে মুচলেকা দিয়ে এবং ওই দোকান থেকে চাকরি হারাবে এমন শর্তে লোকটাকে দোকান মালিকের জিম্মায় দেয়া হয়। মেয়েটি ও তার বাবা শেষমুহুর্তে ওইভাবে ক্ষমা না করলে নিশ্চিত ৬ মাসের জেল খাটতে হতো অপরাধীকে।

একটু সাহস নিয়ে এগিয়ে এলে, নিয়ম মেনে প্রতিবাদ করলে এবং সেই প্রতিবাদটা সঠিক যায়গায় পৌঁছে দিতে পারলে- এই দেশেও যে অপরাধীকে আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেয়া সম্ভব, তা আবারো প্রমাণিত হলো। নেই নেই করেও আমাদের যতটুকু নাগরিক সুযোগ-সুবিধা আছে আমরা তার কতটুকুই বা ব্যবহার করতে পারছি?

আতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) নাজমুন নাহার আপুকে ধন্যবাদ দিতে চাই না। শুধু এটুকুই বলতে চাই, আপনার মতো সৎ ও নিষ্ঠাবান অফিসার আছে বলেই আমাদের আশার প্রদীপটা এখনো নিভে যায়নি। যাপিত জীবনের সমবেত কষ্টগুলো, বেদনাগুলো আমরা আপনাদের কাছে পৌঁছে দিয়ে কিছুটা হলেও শান্তি পাই। মহান সৃষ্টিকর্তা আপনার এবং আপনার পরিবারের মঙ্গল করুক।
স্যালুট সাহসী মেয়েটিকে এবং তার বাবাকে। প্রতিটি ময়েটের পরিবার যদি এভাবে সাহস যোগায় অন্যায়ের প্রতিবাদ করায়, তবে আর কোন মেয়েকে নীরবে চোখের জল মুছতে হবে না। ধন্যবাদ মেয়েটির বন্ধুদেরও যারা তাকে একা অনুভব করতে দেয়নি, সাহস যুগিয়েছে প্রতিবাদের।

এই দেশে কিছু হয় না বলে যারা পাশ কাটিয়ে যান, যারা প্রতিবাদের বদলে প্রতিনিয়ত অন্যায়কে মেনে নেন, তাদের প্রতি অনুরোধ, নিজের যায়গা থেকে একটুখানি আওয়াজ তুলুন। জনারণ্যে শুরুতে সেই আওয়াজ বড় ক্ষীণ আর বেমানান ঠেকলেও ধীরে ধীরে দেখবেন আরো সহস্র আওয়াজ আপনার দিকে ছুটে আসছে। গণমানুষের সম্মিলিত সেই আওয়াজের সামনে দাঁড়ায়, এমন অপশক্তি কোথায়?

ক্যাম্পাস থেকে বন্ধুদের এনে মারপিট না করে মেয়েটি যেভাবে সঠিক পন্থায় লিখিত অভিযোগটি করেছিল, তার একটি নমুনা দিলাম :

বরাবর,
জনাব নাজমুন নাহার
অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ।

বিষয় : নিউমাকের্টে শপিং করতে গিয়ে দোকানির অভদ্র আচরণের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ প্রসঙ্গে

জনাব,
আমি ফওজিয়া রহমান (ছন্মনাম), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের একজন নিয়মিত ছাত্রী। আমার সেশন --------। আমি ------- হলের অবাসিক ছাত্রী। আমার পিতার নাম ------------। গত বৃহস্পতিবার বিকালে নিউমার্কেটে বান্ধবীদের নিয়ে শপিং করতে যাই। বায়তুল আমান মসজিদের নিচের ‘শাওন ফ্যাশন’ নামক একটি দোকানে বোরখা পছন্দ করতে ঢুকি। দাম শুনে পছন্দ না হওয়ায় অন্য দোকানে যেতে চাইলে দোকানি আমাদের বাধা দেন। দাম শুনে না কিনে চলে যাবার জন্য আমাদের যাচ্ছে তাই ভাষায় গালাগাল করেন। প্রতিবাদ করলে আমাদের উপর আরো চড়াও হয়ে তিনি বেইজ্জতি করবেন বলে হুমকী দিয়ে আমাদের ব্যাগ টেনে ধরেন। ভয়ে বেরিয়ে যেতে চাইলে তিনি আমাদের পথ আটকে দেন। এক পর্যায়ে চরম অপমানিত হয়ে শারিকি লাঞ্ছনার ভয়ে আমরা বোরখা কিনতে বাধ্য হই। এ ঘটনায় আমরা চরম অপমানিত ও লাঞ্ছিত হয়েছি। ওই দোকানির নাম না জানলেও দোকানটির অবস্থান আমি চিনি এবং দোকানিকেও চিনিয়ে দিতে পারবো। এই এলাকায় আমার মতো হাজার হাজার নারী এইসব বদমায়েশ দোকানির দূর্ব্যবহারের এবং কখনো কখনো হামলারও শিকার হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। আমি আমাদের সঙ্গে ঘটা এই ঘটনায় যথাযোগ্য বিচারের মাধ্যমে একটি উদাহরণ তৈরি করতে চাই। এ জন্য আপনার স্মরণাপন্ন হয়েছি।
অতএব, মহাদয়ের নিকট আবেদন, আমার অভিযোগটি আমলে নিয়ে, অভিযুক্তকে আইনের আওতায় এনে যাথোপযুক্ত শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে আমাকে বাধিত করবেন।

বিনীত নিবেদক
ফওজিয়া রহমান (ছন্মনাম)
সমাজবিজ্ঞান বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
সেশন-------------
হলের নাম---------
ফোন নম্বর -------

পুলিশ অফিসারদের ফোন নাম্বার :
এসআই মনির : ০১৭০৬২৬২৩৭৬ (মার্কেট সংক্রান্ত)
ওসি নিউমার্কেট : ০১৭১৩ ৩৭৩১২৮
এসি নিউমার্কেট সার্কেল : ০১৭১৩৩৯৮৫৩২ (ওসি ও এসআই আমলে না নিলে)
ডিসি রমনা : ০১৭১৩৩৭৩১২০ (উপরের তিনজনের কেউ আমলে না নিলে)


নাজমুন নাহার
অতিরিক্ত উপ পুলিশ কমিশনার
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ।

___________________________________
অতিরিক্ত উপ পুলিশ কমিশনার নাজমুন নাহার ডাক্তার প্রতিদিনকে জানিয়েছেন , লেখাটি তার সম্মতি সাপেক্ষে রচিত।
সাংবাদিক আবদুল্লাহ আল ইমরান রচনা করেছেন। জনস্বার্থে ডাক্তার প্রতিদিন এটি প্রকাশ করল ।

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়