Ameen Qudir

Published:
2019-02-13 00:20:30 BdST

বিশেষঅধিক ইনসুলিনের সঙ্গে কয়েকটি বিশেষ ক্যানসারের অতি ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র


 

 


ডা. সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়
---------------------------------------------
কখনো কি ভেবেছেন যে ১/ ডিসলিপিডিমিয়া, ২/ হাইপারটেনশন, ৩/ করোনারি হার্ট ডিজিজ ও সেরিব্রোভাসকুলার ডিজিজ, ৪/
বিষাদ বা ডিপ্রেশন, ৫/আলঝাইমার্স ডিমেনশিয়া ৬/ অনেক ধরণের ক্যানসার ও ইনসুলিনের আধিক্য র সঙ্গে সংযুক্ত। নিঃসন্দেহে ইনসুলিন একটি জীবনদায়ী হরমোন বা অন্তঃক্ষরী প্রোটিন। টাইপ ১ ডায়াবেটিস এর অভাগা রোগী দের জন্য এটি জীবনের সমান দামী। কিন্তু অন্যত্র এর আধিক্য মানবজীবনে আদৌ সুখকর নয়। বিজ্ঞানের অগ্রগতি র সঙ্গে বহু কিছুর ধারণাই এমনকি ৩৬০ ডিগ্রী পরিবর্তিত হচ্ছে।
যত ইনসুলিনের মাত্রা বেশি ততো বেশি বেশি এর কুপ্রভাব। আগে ক্যানসার কে জীবন শৈলী জনিত অসুখ বলে ভাবা হতো, এখন অধিক ইনসুলিনের সঙ্গে কয়েকটি বিশেষ ক্যানসারের অতি ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র ইতোমধ্যেই প্রমাণিত।

এক্ষেত্রে ইনসুলিনের মাত্রা উপবাসী রক্তেও যেমন বেশি, খাওয়ার দু ঘন্টা পরেও আরো বেশি।

অনুগ্রহ করে মনে রাখুন যে শরীরের কোষে গ্লুকোজ পৌঁছে দেয়, এবং কোষগুলি গ্লুকোজ থেকে Acetyl -CoA তৈরী করে এবং এই শক্তি আমাদের শরীরের কোষগুলির ব্যাটারী বা পাওয়ার হাউস, মিটোকন্ড্রিয়া র কার্যকরী শক্তিসূত্র।
এবারে একটি কিন্তু আছে। এই অতি প্রয়োজনীয় কর্মের শেষে, এই ইনসুলিন কিন্তু আমাদের শরীরের অন্যতম স্টোরেজ হরমোন, যার কাজ হলো লিভারের এবং মাসলের গ্লাইকোজেন স্টোর কে পূর্ণ করা ( এই প্রক্রিয়ার নাম, লাতিন ধারায়, গ্লাইকোজেন -ও - লিসিস) বা গ্লাইকোজেন তৈরী করা,( অবশ্যই গ্লুকোজ থেকে) , ভবিষ্যতে র প্রয়োজন এর জন্যে। ( বা বলা ভালো, অনাহারের সময়ের জন্যে বা হটাৎ কোন কারণে প্রয়োজন হলে।)
ভুল খাদ্যগ্রহণ পদ্ধতি এবং চতুর্দিকে সুলভ ও প্রচুর খাদ্য আছে বলে একটি মানুষ দিনে রাতে অন্তত ৮ বার বা আরো বেশি বার খেয়েই চলেছে।সাধারণত এই খাদ্যগুলি কার্বোহাইড্রেট জাতীয়, সুস্বাদু এবং দামেও সস্তা। এইজন্য প্রচুর ইনসুলিনের ক্ষরণ হচ্ছে এবং হয়েই চলেছে। অথচ আমাদের শরীরের অধিকাংশ কোষের ই এত গ্লুকোজের প্রয়োজন নেই। অনেক ক্ষেত্রে নিজেদের এই গ্লুকোজের অত্যাচার থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখার জন্যই এরা নিজেরাই ইনসুলিন রেজিস্টেন্স তৈরী করে ফেলছে। অন্য মতে, দিনের অধিকাংশ সময় উচ্চ মাত্রার ইনসুলিনের সংস্পর্শে থাকতে থাকতে এরা ইনসুলিনের উপস্থিতি সম্পর্কে উদাস হয়ে পড়ছে। ( যেমন টি ব্যাকটেরিয়া বা জীবাণু সারাক্ষণ এন্টিবায়োটিক এর সঙ্গে একই পরিবেশে থাকতে থাকতে সেই এন্টিবায়োটিক দ্বারা আর প্রভাবিত হয় না বা, এন্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্স তৈরী হয়। ) এই ইনসুলিন রেজিস্টেন্স ই সকল নষ্টের গোড়া। এরি জন্যে রক্তে ডিসলিপিডিমিয়া, এরই জন্যে রক্তনালীর দেওয়াল নমনীয় থেকে কঠিনতর হয়ে হাই ব্লাড প্রেসার বা হাইপারটেনশনের সৃষ্টি, এরি জন্যে করোনারি আর্টারি ডিজিজ, এরি জন্যে সেরিব্রো ভাস্কুলার ডিজিজ।

সুগার বা গ্লুকোজ কিন্তু দীর্ঘকালীন বিচারে একটি সুস্বাদু বিষ বই আর কিছু নয়।

মানবশরীর সুগার বা গ্লুকোজ কে এর প্রাথমিক জ্বালানী বা শক্তিকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করে। কিন্তু, অনাহার বা অন্য প্রয়োজনের সময়ে এবং লিভার ও মাসল এ সঞ্চিত গ্লাইকোজেন নিঃশেষ হলে শরীর বাধ্য হয় চর্বি বা ফ্যাট কে শক্তির যোগান হিসেবে ব্যবহার করতে।
বিবর্তনের শুরু থেকেই মানুষ সহ অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীর ক্ষেত্রেও এমনটি ই হয়ে আসছে।
এখানে একটি কিন্তু বা আবশ্যিক শর্ত আছে অবশ্য। যেহেতু অনাহারে রক্তে ইনসুলিনের মাত্রা ন্যূণতম থাকে একমাত্র তখনই আমাদের শরীর এই দ্বিতীয় যোগান কে ব্যবহার করতে পারে। ইনসুলিন স্টোরেজ হরমোন হওয়ার কারণে এই চর্বি বা ফ্যাট ভাঙার পদ্ধতিকে বাধা দেয়, কারণ এই ইনসুলিন নিজেই এই স্টোরেজ ভাণ্ডার বা ফ্যাট দেপো তৈরী তে সরাসরি সাহায্য করে। এই পদ্ধতির লাতিন নাম লিপো ( ফ্যাট) লিসিস। এক্ষেত্রে অবশ্য একটি সুবিধে আছে। কেউ সাহস দেখালে, সে সত্যিই সাহসী না ভান করছে, সে ছাড়া আর বোঝা সম্ভব নয় কারো, শরীর ও বুঝতে পারে না যে সত্যিই অনাহারের পরিবেশ আছে অথবা খাদ্য না গ্রহণ করে উপবাসের অভিনয় করা হচ্ছে, রক্তে ইনসুলিনের মাত্রা কম থাকলেই, শরীরের শাদা ফ্যাট uncoupling of protein এর সাহায্যে এবং গ্লুকাগন হরমোনের ক্ষরণে ফ্যাটি অ্যাসিডে পরিবর্তিত হয় এবং একই Acetyl - Co A তে পরিবর্তন হয়ে আমাদের কোষের চালক বা ব্যাটারি মিটোকন্ড্রিয়া তে শক্তির যোগান দিতে পারে এবং সমস্ত শরীরবৃত্তীয় এবং বিপাকীয় কাজকর্ম আবার, বরং আরো ভালো ভাবে চালু হতে পারে। মনে রাখুন ১ গ্রাম গ্লুকোজ যেখানে ৪ কিলোক্যালরি বা ক্যালরি শক্তি উৎপাদনে সম্ভব সেখানে ১ গ্রাম ফ্যাট বা চর্বি থেকে পাওয়া সম্ভব ৯ কিলোক্যালরি অথবা ৯ ক্যালরি শক্তি।ফ্যাটি অ্যাসিড এর ব্যবহারে উৎপন্ন হয় অ্যাসিটোন এবং বিটা হাইড্রক্সি বিউটিরিক অ্যাসিড যা নিষ্কাশিত হয় প্রধানতঃ মূত্রের অথবা শ্বাসের মাধ্যমে।
এটি একটি স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় কাজ এবং এই অবস্থাকে বলা হয় কিটোসিস। ( কখনো ডায়াবেটিক কিটো অ্যাসিডোসিস এর সঙ্গে গুলিয়ে ফেলবেন না।)
কিটোসিস অবস্থার সুবিধাগুলি কি কি?
১। আমাদের সবকটি ইন্দ্রিয় অনেক বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং আমাদের মস্তিষ্ক আরো বেশি সতেজ ও সক্রিয় হয়,চিন্তাশক্তি এবং দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা আরো দ্রুত ও সক্রিয়তর হয়, যেমনটি হতো আমাদের পূর্বজ দের হান্টার গ্যাদারার যুগে ( Hunter - gatherer era) কারণ হোমো সেপিয়েন্স বা মানুষ ছিল নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর প্রাণী যার ছিল না অসীম শারীরিক শক্তি, না ভয়ংকর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বা ঘ্রাণশক্তি। মানুষ কে শিকারী পশু ও সরীসৃপ দের এড়িয়ে ফল ও গাছের মূল বা কন্দ সংগ্রহ করতে হতো, প্রতিটি মূহুর্তেই যথাসম্ভব সজাগ থাকতে হতো। ( প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য এই সময়েই বিপদ দেখলে বা অনুভব করলে মারো অথবা পালাও বা Fight or Flight নীতি ভিন্ন উপায় ছিল না। , নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বিচার করলে মানুষের শারীরিক ক্ষমতার নিরিখে পালিয়ে জীবন রক্ষা করাই হতো বেশি।)
২/ ক্যানসার বা কর্কট রোগাক্রান্ত কোষগুলি সচরাচর অক্সিজেন হীন অবস্থাতেই বাঁচে এবং বৃদ্ধি পায় এবং এদের খাদ্য হলো গাঁজানো গ্লুকোজ এবং সাধারণ কোষের থেকে অন্তত ২০ গুণ বেশি পরিমাণে। উল্লেখ্য এটিই PET স্ক্যান এর মূল সূত্র। ক্যানসার সেল ধরা পড়ে তাদের বিশেষ ভাবে প্রস্তুত গ্লুকোজের বিশাল আহরণ দেখেই।
এই ক্যানসার কোষ কিন্তু গ্লুকোজ ছাড়া বাঁচতে পারে না, এবং ফ্যাটি অ্যাসিড বা ফ্যাট বা চর্বি ব্যবহার করা বিপাকীয় অবস্থায় তাদের মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী।
৩/ যেই মস্তিষ্কের ক্ষমতার সার্বিক উন্নতি হয়, এবং মস্তিষ্ক নিজ ক্ষমতার তুঙ্গে অবস্থান করে, এপিলেপ্সি বা মৃগী অথবা ডিপ্রেশন বা বিষাদ স্বাভাবিকভাবেই অন্তর্হিত হয়। আরো কারণ এই যে আমাদের মস্তিষ্ক এই পরিবর্তিত ঈন্ধন ব্যবস্থার সম্যক সদব্যবহার করতে সক্ষম।
৪/ ডায়বেটিস মেলিটাস ২ স্বাভাবিকভাবেই বিলুপ্ত হয় কারণ না ইনসুলিন, না গ্লুকোজ, কোন টির ই আর বিপাকীয় ক্রিয়াতে আদৌ প্রয়োজন হয় না। অতএব এর ই সঙ্গে ইনসুলিন রেজিস্টেন্স ও ডিসলিপিডিমিয়া ও স্বাভাবিক হয়ে আসে। দ্রুত কমতে থাকে হাইপারটেনশন বা বেশি ব্লাড প্রেসার, ও কার্ডিও ভাস্কুলার ও সেরিব্রো ভাস্কুলার ঘটনাগুলির সংখ্যা।
৫/ একধরণের ডিজেনেরেটিভ প্রোটিন যা TAO প্রোটিন নামে পরিচিত এবং যে প্রোটিনের গুচ্ছ জমা হয়ে অ্যামাইলয়েড প্লাক ( Amyloid plaques) বা পরবর্তীকালের আলঝাইমার্স ডিমেনশিয়া র কারণ, সেগুলি তৈরী হতে পারে না, যখন মস্তিষ্ক ফ্যাট কে ইন্ধন হিসেবে ব্যবহার করছে।
৬/ কার্বোহাইড্রেট এর তুলনায় আমাদের শরীরে চর্বি বা ফ্যাট এর পরিমাণ অনেক বেশি, এবং এর সমস্ত টাই আমাদের শরীরের পক্ষে ব্যবহার্য।
অবশ্য এ জন্য আমাদের খাদ্যে উচ্চমানের স্যাচুরেটেড বা সম্পৃক্ত ফ্যাট খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। খুব কঠিন নয় তা প্রকৃত প্রস্তাবে কারণ লাগে পরিমাণে অনেক কম। ( ১ গ্রাম ফ্যাট = ৯ ক্যালরি শক্তি) । একই কারণে শক্তি কম পড়ার ও কথা নয়, বা ক্লান্তি ও আসে অনেক কম।
৭/ স্থূলতা এবং শরীরে ঘটে চলা অনেক ইনফ্লামেটরী প্রসেস ( Inflammatory processes) ও কমে আসবে কারণ এইগুলোর মূল পথিক ইনসুলিন রেজিস্টেন্স এর ই যে আর অস্তিত্ব রইলো না।
এর প্রতিফলন পাওয়া যায় বিভিন্ন ইনফ্লামেটরি মার্কার ( Inflammatory marker) যেমন CRP বা hs -CRP র মাপ দেখলে । ( C Reactive Protein ; highly selective C Reactive Protein)
৮/ মানব শরীরের মাংস পেশী তে গ্লুকাগন এর কোন রিসেপ্টর না থাকায় মাংসপেশি র নষ্ট অথবা রুগ্ন হওয়ার সম্ভাবনাই নেই কোন। তাছাড়াও ঘুমানোর সময় মস্তিষ্ক থেকে গ্রোথ হরমোনের ক্ষরণ হওয়ায় মাংসপেশী এবং সমস্ত দেহই পুষ্ট হবে।
৯/ কিটোসিসে শরীর কে রাখতে হলে স্বাভাবিকভাবেই নির্দিষ্ট খাদ্য তালিকা মেনে চলতে হবে। বলা বাহুল্য একই তালিকা সর্বদা ও সর্বথা প্রযোজ্য নয়।
১০/ ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং ও কিটোজেনিক ডায়েট প্ল্যান মেনে চললে, অতি শীঘ্রই স্থূলতা, ডায়বেটিস ২, পিসিওডি, এবং উপরে উল্লেখ্য অসুখ থেকে প্রায় বিনা অথবা সামান্য ওষুধে এই সব অসুখ থেকে মুক্তি পাওয়া / প্রতিরোধ করা সম্ভব।
শুধু গর্ভবতী এবং ৯ বছর বয়সের কম বাচ্চাদের জন্য এই প্ল্যান এখনো পরীক্ষিত নয়। স্তন্যদায়িনী দের অবশ্য এই ডায়েট প্ল্যান মেনে চলার বাধা নেই কোন।। ***

------------------------------------------

ডা. সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়
সুলেখক । কবি।

Diabetes & Endocrinology Consultant
M.D. at University of Madras । প্রাক্তন :
Calcutta National Medical College and Madras Medical College (MMC

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়