Ameen Qudir

Published:
2018-12-12 04:38:36 BdST

আত্মহত্যা প্রতিবাদের ভাষা হতে পারে না: অপমানেরও নয়






অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল
_______________________________



পেশাগতজীবনে প্রতিদিন মোকাবিলা করতে হচ্ছে আত্মহননের চেষ্টাকারীদের। চেম্বারে এ ধরনের ক্লায়েন্টের সংখ্যা বাড়ছে। অসংখ্য ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তি, কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী আত্মহত্যার ‘ইচ্ছে’ ও ‘পরিকল্পনা’ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে সমাজের সর্বস্তরে। অনেকে আত্মহত্যার চেষ্টা (attempt) করছে। সফল হয়ে কেউ কেউ চলে যাচ্ছে ‘না-ফেরার’ দেশে। যথাসময়ে চিকিত্সা পেলে কেউবা ফেরত আসে হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ) থেকে। জীবন সুন্দর, বেঁচে থাকা আনন্দের জেনেও কেন এ আত্মহননের চেষ্টা করে মানুষ, প্রশ্ন জাগে সবার মনে।


আত্মহত্যার নানা ব্যাখ্যা রয়েছে। সব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এ নিবন্ধে উপস্থাপন না করে অতি সমপ্রতি রাজধানীর ভিখারুন্নিসা স্কুলের ছাত্রী অরিত্রীর আত্মহত্যার ঘটনার আলোকে নিচের একক ব্যবচ্ছেদটা তুলে ধরতে চাই। আকস্মিক তীব্র মনঃকষ্ট (a sudden intense psyche ache) বা আচমকা অচিন্তনীয়-অবিশ্বাস্য অপমানবোধের শরাঘাত থেকেও আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে যেতে পারে। এ ধরনের তীব্র মনোদহন সামাল দিতে না পেরে আত্মহত্যার চেষ্টা (attempt) নিয়ে ফেলতে পারে কেউ কেউ। ‘Her soul was killed before suicide’— এমন কথা লেখা একটা প্ল্যাকার্ড দেখেছি আমরা বাচ্চাদের প্রতিবাদের মিছিলে। আত্মার স্বর মরে যাওয়ায় অপমানের তীব্র আঘাত সইবার শক্তি ছিল না মেয়েটির। শিশুদের ভাষায় আত্মহত্যার আগে অরিত্রীর আত্মাকে হত্যা করা হয়েছিল। তাই সে আত্মহত্যা করে ফেলেছে। অরিত্রীর আত্মার কষ্ট তীব্রবেগে সঞ্চারিত হয়ে গেছে কেবল শিশুদের আত্মায় নয়, পুরো জাতির বুকে। বেদনায় নির্বাক হয়ে গেছি আমরা সবাই। তবু তুলে ধরতে চাই- ধর্ম বলে, বিজ্ঞান বলে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলে : আত্মহত্যা প্রতিবাদের ভাষা হতে পারে না। অপমানেরও নয়। এ কঠিন দহন-জ্বালা, শরাঘাত মোকাবিলা করতে হবে আত্মহত্যা না করে ভিন্নভাবে। বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য প্রয়োজন প্রবল আত্মবিশ্বাস, আত্মপ্রত্যয়ী মন।

স্পষ্ট করে বলছি, আত্মহত্যার ঝুঁকির বিষয়ে সাধারণ মানুষ তো বটেই পরিবারেও সচেতনতা থাকতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণদের পাশে দাঁড়াতে হবে। মনোচিকিত্সা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। আত্মহত্যা-চেষ্টা গ্রহণের আগেই তাদের পাশে দাঁড়ালে সুইসাইড প্রতিরোধ করা সম্ভব। শিশু-কিশোরদের মনে রাখতে হবে আমি শত ঘা খাব, পরাজিত হব, আঘাত পাব, ব্যর্থ হব, হোঁচট খেয়ে চিত্ হয়ে পড়ে যাব, আবার আমি উঠে দাঁড়াব, হাঁটব— এটাই আমার জীবন। কিন্তু ধ্বংসাত্মক কোনো সিদ্ধান্ত নেব না। ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে ইতিবাচক জীবন গড়ব। তাদের আরও মনে রাখতে হবে এ জীবন কেবল আমারই নয়, আমার বাবা-মায়েরও, পরিবারের, দেশের, সবার। আত্মহত্যার মতো ধ্বংসাত্মক সিদ্ধান্ত কখনও কারও নেওয়া উচিত নয়। আমাকে হত্যা করার অধিকার নেই আমার। কিন্তু আত্মহত্যার আগে বাস্তবতার সঙ্গে সম্পর্ক প্রায় ছিন্ন হয়ে যায় ভুক্তভোগীর। তারপরও বাঁচতে চায় মানুষ। বাঁচার জন্য হাত বাড়াতে চায়। ওই মুহূর্তে সহমর্মী, সহযোগিতাপূর্ণ একটি বাড়ানো হাত রক্ষা করতে পারে চরম পরিণতি থেকে। Extreme nihilism বা তীব্র ধ্বংসাত্মক চিন্তনের ফাঁকফোকর দিয়েও গভীর তল থেকে এক মন বেঁচে থাকতে চায়। আর অন্য মন ঠেলে দিতে চায় চরম পরিণতির দিকে। এ দ্বান্দ্বিক-সময়ে চারপাশের মানুষের সহযোগিতা বিপর্যয় রোধ করতে সক্ষম।

অরিত্রীর ক্ষেত্রে আমরা খুঁজে দেখব স্কুল কর্তৃপক্ষ পরীক্ষায় মোবাইল ফোন ব্যবহারের বিষয়টি নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলেছেন কিনা। তার মতামত জানতে চেয়েছিলেন কিনা, তাকে ডিফেন্ড করার সুযোগ দিয়েছিলেন কিনা। সে এর আগেও এ ধরনের অপরাধ (নকল) করেছিল কিনা, করে থাকলে ওই সময় অভিভাবককে জানানো হয়েছিল কিনা, এ ধরনের অপরাধ না করতে তাকে সতর্ক করা হয়েছিল কিনা, সতর্কতার পরও সংশোধন না হয়ে থাকলে কেন হয়নি তা নির্ণয় করা হয়েছিল কিনা, তার বাবা-মায়ের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছিল কিনা, নাকি প্রথমবারই সে এ ধরনের অপরাধ করেছে— ইত্যাদি

নানা প্রশ্ন রয়ে যায়। হয়তো শিক্ষকরা তাদের প্রতিষ্ঠানের নিয়ম-নীতির জোরালো অবস্থান থেকে সব বিচার করেছেন, তারা হয়তো অনেক যুক্তি দেখাবেন কিন্তু তাদের যুক্তিগুলো যথার্থ হবার সম্ভাবনা দেখছি না। শিশুদের সহনশীলতা কম। সব পরিস্থিতির সঙ্গে শিশুরা মানিয়ে নিতে পারে না। অরিত্রীকে সংশোধনের সুযোগ দেওয়া উচিত ছিল।

সবার উদ্দেশে বলব : আত্মহত্যাকারীকে মহিমান্বিত (glorify) করা যাবে না। আবেগ সংযত করে কথাটা মনে রাখতে হবে আমাদের। আর এ কারণে প্রতিটি ধর্মে আত্মহত্যাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সুইসাইড নিরুত্সাহিত করার জন্য, ঝুঁকি মোকাবিলা করার জন্য, প্রতিরোধ করার জন্য ধর্মীয় শিক্ষা হচ্ছে ‘আত্মহত্যা করলে বেহেস্ত পাব না।’ এ ধমীয় মূল্যবোধের কারণে প্রচুর ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিরা আত্মহত্যা না করে চিকিত্সার জন্য আসেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিষয়টিকে decriminalization করার কথা বলেছে। ‘আত্মহত্যার চেষ্টা করাও অপরাধ’— এ আইন বাতিলের উদ্যোগ নিয়েছে। যদিও অনেক দেশে আইনটি বলবত্ আছে। আইনের কার্যকারিতাও রয়েছে কোনো কোনো দেশে। আইন থাকলেও আমাদের দেশে তা কার্যকর নেই। যেহেতু আত্মহত্যার পেছনে থাকে নানা ধরনের মানসিক রোগ, মনোসামাজিক সংকট, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাই একে অপরাধ হিসেবে দেখতে চায় না। তবে জোর দেওয়া হচ্ছে এর প্রতিরোধে। কোনো আত্মহত্যাকারীকে মহান করে প্রচার করতে থাকলে আত্মহত্যার ঝুঁকি নিয়ে এখনও যারা বেঁচে আছে, ঘুরে বেড়াচ্ছে চারপাশে, অথবা ক্রমাগতভাবে বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ড থেকে নিজেকে গুটিয়ে ফেলছে তারা উদ্বুদ্ধ হয়ে যাবে আত্মহননে। অথবা ঘটমান এ ধরনের ঘটনার আবারও মুখোমুখি হলে অন্য কোনো সমাধানের পথ না খুঁজে না পেয়ে তারা সুইসাইডকে অবলম্বন হিসেবে বেছে নেবে (Learned behaviour)।

কোমলমতি শিশুদের বলছি : যখনই কোনো বন্ধু কষ্ট পাবে, সংকটে জাড়িয়ে যাবে, ভেঙে পড়বে কোনো ঘটনার শৃঙ্খলে আটকে, তার পাশে দাঁড়াতে হবে। তাকে সাপোর্ট দিতে হবে। তার কথা শুনতে হবে। তাকে চিকিত্সার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এভাবে আত্মহত্যা ঠেকানো যায়। আর শিক্ষকদের বলছি : অরিত্রীকে সংশোধনের সুযোগ দেওয়া উচিত ছিল। সে অমানবিক নিষ্ঠুর নির্মম বিচারের শিকার হয়েছে। নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া ছাত্রীর মনোজগত আমলে নিয়ে যেভাবে অপরাধের বিষয়টি ইতিবাচকভাবে সামাল দেওয়ার কথা ছিল সেভাবে সামাল দিতে স্কুল কর্তৃপক্ষ ব্যর্থ হয়েছে। শিশু না ভেবে মেয়েটির সঙ্গে প্রাপ্তবয়স্কদের মতো আচরণ করা হয়েছে। তাকে ও তার পরিবারকে অপমান অপদস্থ করা হয়েছে। মেয়ের সামনে তার বাবাকে অপমান করা হয়েছে। শিক্ষিকার পায়ে ধরে মাফ চাওয়ার পরও মাফ করা হয়নি। আর সেই অপমান সইতে না পেরে অরিত্রী আত্মহত্যা করেছে বলে প্রচার পাচ্ছে মিডিয়াতে।

শিশুরা অপরাধ করলে তার বিচার করতে হবে কিশোরআইনের স্তরে নেমে। কিশোর মনস্তত্ত্ব বুঝে। শিশুরা ভুল করবে, না বুঝে অপরাধও করে ফেলতে পারে। বিজ্ঞান তা স্বীকার করে নিয়েছে। কারণ চারপাশ প্রত্যক্ষ করার ক্ষমতা কিশোর-কিশোরীদের পরিপূর্ণভাবে বিকাশ লাভ করে না। এ কারণে তাদের যেকোনো অপরাধ বিবেচনায় রাখতে হয় কিশোরআইনের আলোকে। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করেছি, অরিত্রীর ক্ষেত্রে বিচারটি হয়েছে নির্মম, নিষ্ঠুরভাবে। এডাল্ট আইনকেও যেন ছাড়িয়ে গেছে শিক্ষকদের বিচারিক হিংস্রতা।

আমার জানা মতে বি.এড., এম.এড. শিক্ষা কার্যক্রমে শিশু-কিশোরদের মনস্তত্ত্ব পড়তে হয় প্রশিক্ষিত শিক্ষকদের। তাহলে ঘাটতি কোথায়? এসব প্রশ্নের উত্তরও খুঁজে বের করতে হবে আমাদের। প্রশ্ন জাগে, অদক্ষ শিক্ষকের অভয়ারণ্য কি হয়ে যাচ্ছে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলো? নাকি ব্যাণিজিক নেশায় জড়িয়ে যাওয়ার কারণে নৈতিকতা হারাচ্ছেন জাতির মেরুদণ্ড হিসেবে খ্যাত আমাদের প্রিয় শিক্ষকরা? নাকি অতিরিক্ত চাপের কারণে দিশেহারা থাকেন তাঁরা? এসব প্রশ্নের বাইরে গিয়েও বলতে চাই কোনো শিক্ষকের হাতকড়া আমরা দেখতে চাই না। জেলে যাক তাঁরা, তাও দেখতে চাই না। আমরা চাই, এ ঘটনার মধ্য দিয়ে পুরো জাতি জেগে উঠুক। ভবিষ্যতে ইতিবাচকভাবে এ ধরনের ঘটনাকে যেন আমরা বিচার-বিশ্লেষণ করি। ভালো খবর হলো যেসব ছাত্র-ছাত্রী শিক্ষকের বিচার চেয়েছে তারাই আবার শিক্ষকের কারামুক্তি চাচ্ছে। কারারুদ্ধ শিক্ষকের জন্য কাঁদছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, ছাত্র-শিক্ষক যেন একে অপরের বিরুদ্ধপক্ষ হয়ে না যায়। এ আশা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সমূহের সামগ্রিক ক্ষতকে কিছুটা হলেও লাঘব করবে বলে মনে হচ্ছে।

মিডিয়াকে বলছি : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) নীতিমালা অনুসরণ করতে হবে আত্মহত্যার ঘটনা প্রকাশে/প্রচারে। বিশ্ব সংস্থার ওয়েবসাইটে তা সুন্দরভাবে দেওয়া আছে। আত্মহত্যাকারীকে মহিমান্বিত করা যাবে না। কিন্তু যে-সব সামাজিক ক্ষত আত্মহত্যার প্ররোচনা দেয়, আত্মহত্যা উসকে দেয় তার ব্যাপারে কঠোর অবস্থানে থেকে খবর পরিবেশন করতে হবে। যেন ভবিষ্যতে প্ররোচনাকারীরা কোনোভাবেই কোমলমতি শিশু-কিশোর কিংবা তরুণদের আত্মহত্যার পথে ঠেলে দিতে না পারে। অরিত্রী ঘটনার সামাজিক ক্ষত বলতে বুঝানো হচ্ছে নিপীড়নমূলক স্কুলিং ব্যবস্থা, রুট মেমোরাইজেশন নির্ভর পরীক্ষা পদ্ধতি এবং অসংবেদনশীল ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক সম্পর্ক। এসব সম্পর্ক কীভাবে উন্নত করা যায়, কীভাবে শিক্ষার্থীদের আত্মবিশ্বাস বাড়ানো যায়— বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে। ধৈর্য তৈরির জন্য প্রয়োজন ‘থিংক পজিটিভ’ বা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির চর্চা। কেবল টিনএজারকেই তা করলে চলবে না, মা-বাবা ও পরিবারের অন্য সদস্যদেরও করতে হবে। ঘরে ঘরে স্নেহ-মমতার বন্ধন অটুট রাখতে হবে। পারিবারিক যেকোনো কাজে বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সন্তানের মতামত শুনতে হবে। তার বয়সের স্তরে নেমে বুঝতে হবে তাকে। এসব বিষয়কে গুরুত্ব দিতে হবে মিডিয়া কর্মীদের।

লেখক অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল : মনোশিক্ষাবিদ ও বাংলাদেশের প্রধান কথাসাহিত্যিক

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়