Ameen Qudir

Published:
2018-12-06 22:36:07 BdST

স্কুলব্যাগ বয়ে মেরুদন্ডে অনিরাময় ব্যাধি , অরিত্রির আত্মহনন: স্কুলিং নাকি মৃত্যু পরোয়ানা




মেজর ডা. খোশরোজ সামাদ
______________________________


নবম শ্রেনীর ছাত্রী অরিত্রি। বয়সটা স্বপ্ন দেখার সময়। অল্পেও এরা আনন্দিত হয়, সামাণ্য কষ্টে এরা মুষড়ে পরে। রবীন্দ্রনাথ 'ছুটি' গল্পে বলেছিলেন ' বার- তের বছরের মত বালাই আর নাই।' অরিত্রিকে প্রায় এই গোত্রেই ফেলা যায়। বড় হয়ে গেছে তাই,এরা শিশুদের সাথে মিশতে পারে না আবার পরিণতদের বয়সী না হওয়ায় তাদের সাথেও মিশতে পারে না। তাই এরা থাকে স্পর্শকাতর, সংবেদনশীল।

২।রবীন্দ্রনাথ আরো বলেছিলেন,' আনন্দের সাথে সম্পর্কহীন শিক্ষা অন্ধ, শিক্ষার সাথে সম্পর্কহীন আনন্দ পংগু'।আমাদের ছাত্রজীবনের অভিজ্ঞতায় দেখেছি অনেক শিক্ষকের পাঠদান রীতি সেকেলে,যান্ত্রিক, প্রাণপ্রাচুর্য বিবর্জিত। অনেকেই যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়ে আসেন না, অনেকে ভুল পড়ান।শিক্ষার্থীরা কোন প্রশ্ন করলে ধরে নেন ছাত্ররাই তাঁদের পরীক্ষা নিচ্ছে। বিষয়টি ব্যক্তিগতভাবে নিয়ে সকল আক্রোশ ঝাড়েন ছাত্র- ছাত্রীদের উপর। পান থেকে চুন খসলেই পিতামাতা তুলে খিস্তি- খেউড়,প্র‍্যাকটিক্যালে ফেল করিয়ে দেয়ার ভয়,টিসি দেয়ার হুমকি নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। এমন সাজা কিশোরমানসে তীব্র দহন আনে। অনিশ্চয়তা, ভীতি তাদের স্কুলের প্রতি বৈরাগ্যই শুধু নয় অনেকের মধ্যেই Psychosomatic Disorder বা মনোবিকার আনে যা তীব্র আকার ধারণ করলে আত্মহননের পথে ঠেলে দিতে পারে।

৩।পরিমল জলধর নামের এক পিশাচ শিক্ষক ভিখারুন্নেসা স্কুলে ছাত্রীকে ' নোট' দেয়ার নামে একান্তে ডেকে নেন,ধর্ষণ করেন,সেটিকে ভিডিও করে ব্ল্যাকমেইলের মাধ্যমে বারবার ধর্ষণ করেন।

৪।ধনী বা ক্ষমতাধর ব্যক্তির সন্তান,প্রিয়দর্শিনী ছাত্রীর প্রতি কিছু শিক্ষকের কদর্য উৎসাহ দৃশ্যমান,যা বাকী শিক্ষার্থীদের হীনমন্যতায় ভোগায়।

 

৫।ক্লাশে না পড়িয়ে বাসায় প্রাইভেট পড়াতে বাধ্য করবার বিষয়টি ওপেন সেক্রেট। সকল অভিভাবকের পক্ষে সেটি সম্ভব হয়ে উঠে না। খড়গ নেমে আসে শিক্ষার্থীদের উপর। বিদ্যালয় শুধু পাঠদানেরই স্থান নয়, নৈতিকতা শিক্ষার বিশেষ কেন্দ্র। সেখানে কোমলমতি অনেক ছাত্র- ছাত্রীরা এই সকল নৈরাজ্যে বিভ্রান্ত হয়ে অপরাধের পথে পা বাড়ায়। আজ ক্লাশ পার্টি,কাল ওমুকের জন্মদিন ইত্যাদির টাকা অনেক অভিভাবক দিতে না পেরে নিজেরা অভুক্ত থাকেন।আর রোদনভরা সেই নোংরাচিত্র সন্তানেরা দেখে আর কিছু না করতে পেরে মরমে মরমে মরে যায়।

৬।ভর্তি বাণিজ্যের শিকার হয়ে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী উপেক্ষিত হয়। শিক্ষক নিয়োগ দান নিয়ে হাজারো প্রশ্ন।ক্ষমতাধর মামা-চাচার জোরে অযোগ্য ব্যক্তি শিক্ষক নিয়োগের খবর মিডিয়াতে এসেছে।এঁদের পক্ষে মেধাবীদের পাঠদান শুধু অসম্ভবই নয়, তাঁদের অপার শক্তির সন্মন্ধেও ধারণা নেই। কিছুদিন আগেই নিরাপদ সড়কের দাবীতে অসংখ্য অরিত্রি তাঁদের অমিত সম্ভাবনার খনি উন্মোচন করেছিল।

৭।এত এত পরীক্ষা,বিশাল বিশাল সিলেবাস ছাত্রছাত্রীদের গ্রন্থকীট হতে বাধ্য করে। ফলে,তারা শিল্প - সাহিত্য- ক্রীড়াজগতের অপার আনন্দ থেকে বঞ্চিত থাকে। ফলে জিপিএ ফাইভ পাওয়ার ইঁদুর দৌড়ে তারা আত্মসর্বস্ব, রোবট হয়ে বেড়ে উঠে।

৮।ছোট ছোট শিশুদের বিশাল বইয়ের ঝোলা বহন মেরুদন্ডসহ কতরকম প্রতংগে ভয়াবহ অনিরাময় যোগ্য ব্যাধির সৃষ্টি করে ছবিটি তার প্রামাণিক দলিল।

৯।যে শিক্ষক মোবাইল এনে নকল করবার অপরাধে অরিত্রিকে ধারাল জিহ্বা দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করেছিল তার সন্তান বা অপরিণত বয়সের নিকটাত্মীয় যে ক্ষেত্র বিশেষে মোবাইলের অপব্যবহার করে সেটিও নিশ্চিত করে বলা যায়।

১০।সারা বিশ্বে যখন ' শিশুদেরকে হ্যা বলুন' আন্দোলনে সয়লাব তখন শুধু 'না না ',এটা করো না, সেটা করো না'এর শয়তানকে বোতলবন্দী পরিমণ্ডল থেকে শিক্ষার্থীদের মুক্তি দিতে হবে।

১১।আমি স্কুলে পঞ্চম শ্রেনীতে পড়বার সময় ব্যাচ টিচার ছিলেন আমির স্যার। কোন ছাত্র অসুস্থ হলে নিজের ক্ষমতা অনুযায়ী এটা - ওটা কিনে ছাত্রের বাসায় যেতেন। জর হলে স্পঞ্জ করে দিতেন,পায়ে ব্যথা পেলে পা মালিশ করে দিতেন।রোগী ভাল হলে তাঁর চোখের আনন্দ-অশ্রু আমরা অনেকেই দেখেছি।

১২।মা,অরিত্রি, আমাদের অপরাধ তেমন শিক্ষকের বন্যায় তোমাকে ভাসিয়ে নেয়ার বদলে এমন কষ্টই আমরা দিলাম যে, আত্মহননের মত ভয়ংকর পথ তোমাকে বেছে নিতে হল। তোমার আত্মহনন আমাদের অপরাধী করে দেয়। অন্যভূবন থেকে অরিত্রি মা,তুমি কি আমাদের ক্ষমা করবে?

____________________________

 

লেখক মেজর ডা. খোশরোজ সামাদ;
উপ অধিনায়ক ,
আর্মড ফোর্সেস ফুড এন্ড ড্রাগস ল্যাবরটরী ।

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়