Ameen Qudir

Published:
2018-12-02 01:38:05 BdST

ভরসা থাকুক :আরো কতকিছু ঘটে প্রতিদিন


 

দেবব্রত তরফদার
______________________________
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দেশের অর্থনীতি ও সমাজকাঠামোর পরিবর্তন হয় আর এর সঙ্গে তাল রেখে পরিবর্তন হয় সমাজের মানসিকতা আর মূল্যবোধের। আমাদের যাদের বয়স পঞ্চাশ বা তার বেশি তাদের কাছে বাহ্যিক পরিবর্তনের সঙ্গে মুল্যবোধের পরিবর্তনটা স্পষ্ট । বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যা এবং গবেষণার ফল আমাদের দিয়েছে আধুনিক উন্নত আর আরামের জীবন আর তা লাভ করতে হলে প্রয়োজন প্রচুর অর্থের সেকারনে অনেকেই ইঁদুর দৌড়ে সামিল । তাছাড়া রুটি রুজির তাগিদে অনেকেই ছিন্নমূল । বড় বড় মেট্রোপলিটন শহরে গতিশীল যান্ত্রিক জীবন । সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে নিজের বাইরে ভাবার সময় নেই।
আমাদের মফস্বল শহরে এতটা না হলেও এর প্রভাব পড়ছে । এখানকার বর্তমান প্রজন্ম মেট্রোপলিটনমুখী। তার জন্য নিজেদের প্রস্তুত করে চলেছে । এম বি এ , এম সি এ , সি এ , কস্টিং , সি এস , বি টেক , এম টেক এই সবের প্রস্তুতি । ছোটবেলা থেকেই কাঁধে বড় বড় বই এর বোঝা । তারপর স্মার্ট ফোন ,ল্যাপটপ , গ্যাজেট । এতেই তাদের লেখাপড়া ,বিনোদন। স্বভাবতই এরা আত্মকেন্দ্রিক , ঘরকুনো ,কিছুটা স্বার্থপরও । আপামর জনসাধারনের ফেসবুক , ওয়ার্টসএপ সর্বস্ব জীবন। লাট্টু ,লেত্তি ,ঘুড়ি, ফুটবল, ক্রিকেট পেটানো , হিচ্চে , আইস পাইস , গোল্লা ছুট , কুমিরডাঙা , হুশ হুশ , সাতঘুটি এসব এখন অস্তমিত । এখন কারো কাঁধে গিটার তো গলায় এস এল আর ।
এসব দেখে অনেকের মধ্যে গেল গেল রব ওঠে । এ কোন স্বার্থপর পৃথিবী ? কোথায় রেখে যাবো পরবর্তী প্রজন্মকে । চারদিকে হানাহানি , রাজনৈতিক অস্থিরতা , জাতপাতের বিভেদের নতুন ছবি, অবিশ্বাস , দুর্নীতি , শুধু নিজের আখের গোছানোর মানসিকতা , ব্যবসায়ে বহুজাতিক সংস্থার প্রভাব , বেকারত্ব , নিয়োগে দুর্নীতি , প্রতিবাদীর কন্ঠরোধ । এসব দেখে আমাদের মত বয়স্কদের মনে হওয়া স্বাভাবিক ।এমনিতেই পূর্ববর্তী প্রজন্ম পরবর্তী প্রজন্মের চালচলন , চিন্তাধারা , মানসিকতাকে কখনোই সুনজরে দেখেনা । সবক্ষেত্রে নিজের সময়ের মানসিকতা , মূল্যবোধ , রুচি , পছন্দ , ফ্যাশান এই সবের সাপেক্ষে বিচারের চেষ্টা করে । আবার পরের প্রজন্ম আগেরকে অনেকক্ষেত্রে করুনার চোখে দেখে । আমার অবশ্য একেবারেই এসব সমস্যা নেই । আমার বিভিন্ন বয়সী বন্ধুবান্ধব রয়েছে । এদের মধ্যে অনেকেই খুবই ঘনিষ্ঠ । আর বর্তমান প্রজন্ম যারা শুধুমাত্র অর্থ আর ক্ষমতাকে লক্ষ্য রেখে সীমাহীন সাফল্যের সিঁড়িতে পা রেখেছে তারা ছাড়া ( এদের সংখ্যা অবশ্য অনেক কম এর আদিকাল থেকেই এদের অস্তিত্ব রয়েছে ) বাকিদের সম্পর্কে আমি অবশ্য খুবই আশাবাদী।
এই যেমন নেদের পাড়ার সেই ছেলেটি যে আঠেরোতে পড়তেই বাবাকে জানায় তার জন্মদিনটি রক্তদান করে পালন করতে চায়। মুড়াগাছা স্কুলের বারো ক্লাসের সেই ছেলেটি , যার মা ক্যানসার রোগী , আর শ্রমজীবি বাবা হঠাৎই মারা যান দুর্ঘটনায় । মৃত্যুর কিছুদিন আগে বাবাকে বুঝিয়েছিল চক্ষুদানের গুরুত্ব । বাবাও বুঝেছিলেন , আর তারপর এই ঘটনা । হটাৎ বাবার মৃত্যুতে তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লেও বাবার ইচ্ছের মর্যাদা দেবার জন্য পিছিয়ে আসেনি । আবার আমি আমার স্ত্রীর উদ্যোগে প্রথমে মরণোত্তর চক্ষুদান ও দেহদান করেছি আর একথা জানার পর ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেএকদল আমায় কাঠগড়ায় দাঁড় করালো কেন আমি তাদের না জানিয়ে এই কাজ করেছি। এদের মধ্যে একজন সুমিত ঘোষ সে আমার কানে কানে বলে -- স্যার প্রথমটি তো আমি পারবোনা , দ্বিতীয়টিতে আছি। আমার এই দৃষ্টিহীন ছাত্রটি সম্পর্কে কিছু বলতেই হয় । মা শয্যাশায়ী বাতে , বাবা একটি দোকানে কাজ করে , হালে সে অবশ্য একটি সরকারি চাকরি পেয়েছে । কিন্তু গান বাজনা ব্যান্ড ইত্যাদি ছাড়াও তাকে দেখা যাচ্ছে কোনো ক্যানসার রোগীর জন্য চাঁদা তুলছে , নাহলে প্রতিবন্ধী কল্যাণ সমিতির হয়ে কাজে নেমেছে নতুবা ইটভাটার বাচ্চাদের শীতের পোশাকের জন্য চাঁদা তুলছে । কিছুদিন আগের একটি ঘটনা মনে পড়লো । ব্লাড ব্যাংকে বি নেগেটিভ রক্ত নেই, এক থ্যালাসেমিয়া পেশেন্টের মা দিশেহারা হয়ে স্থানীয় স্কুলের বাচ্চাদের জানায় আর সঙ্গে সঙ্গেই দলবেঁধে তারা ব্লাডব্যাংকে কিন্তু কারোরই আঠেরো পূর্ন হয়নি তাই তারা হতাশ । তারপর শুরু হলো তাদের গরুখোজা । আর আমরা যখন ব্যবস্থা করলাম তখন সেই ছোট্ট ছেলেটির হতাশ মুখ মনে পড়লো যার বি নেগেটিভ রক্ত থাকা সত্বেও বয়সের কারনে দিতে পারলো না।
একেবারে শিশুদের কথায় বাদ দেব কি করে। পুরোনো কাপড় কালেকশন করতে গিয়ে দেখেছি সমস্ত বিষয়টি জানার পর শিশু জেদ করে তার দামি বা নুতন জামা দিতে বাধ্য করায় মাকে । কেউ কেউ নুতন জামা কিনে দেবার জন্য বায়না করে । আমিই নিজেই কতবার বিড়ম্বনায় পড়েছি । একবার জগদ্ধাত্রী পুজোতে স্বীকৃতির ক্লাবের পুজোমন্ডপে ব্লাইন্ড স্কুলের ছেলেরা ক্যাম্প করেছে । ওদের অনুরোধে ক্যাম্পে গেলাম। অনেক কথাও হলো। আর আমার আট বছরের শিশুকন্যাটির মনে এমন প্রভাব পড়লো যে সে আর ঠাকুর দেখতেই গেল না ,আর সারাক্ষন ধরে প্ল্যান করলো দাদাদের কি দেওয়া যায়। আর একদিন স্কুল থেকে আনতে গিয়ে দেখি বন্ধুরা টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে স্টেশনের পথশিশু দের খাবার দিতে গেছে । আমার ছাত্রীর আট বছরের ছেলে হটাৎ জন্মদিনে ঘোষণা করে সে কোনো উপহার নেবে না আর তার জন্মদিনটি রাস্তার বন্ধুদের সঙ্গে সেলিব্রেট করতে চায়। আমার ছোট ভাই , বন্ধু সুশান্ত হালদার যদিও নাটকের দল চালায় কিন্তু তার বাইরে ছেলেদের নিয়ে মেতে ওঠে পথনাটিকায় যার উদ্দেশ্য জনসেবা , কখনো বা মেতে ওঠে সংশোধনাগারের আবাসিকদের নিয়ে নাটকে। আরো একদিন দেখলাম এক কান্ড । টোটোর দৌরাত্ত্বে রাস্তায় জ্যাম লেগেই থাকে , স্টেশন রোডে এমন একটা জ্যামে আটকে আছি আর উল্টো দিক থেকে বয়স্ক একজন টো টো ওয়ালা ভুল পথে ঢুকে আরো ঝামেলা বাঁধিয়ে ফেলেছে ।সবাই তাকে গালাগালি করছে এমত অবস্থায় ট্রাফিক পুলিশ এসে লাঠি দিয়ে টোটোয় দিল দু ঘা তার পর যেই লোকটিকে মারার জন্য লাঠি তুলেছে এমনি পিছন থেকে একটি সরু কন্ঠের চিৎকার -- খবরদার গায়ে হাত দেবেন না। দেখি এগারো বার বছরের একটি মেয়ে পরনে স্কুল ইউনিফর্ম , ততক্ষনে বাবার বাইকের পিছন থেকে নেমে পড়ে ট্রাফিক পুলিশের সামনে দাঁড়িয়ে বলছে -- মারছেন কেন , ভুল করলে ফাইন করুন । পুলিশ বাবাজিও বেকুব।
আরো কতকিছু ঘটে প্রতিদিন । রিক্সাওলা বানিয়ে ফেলল স্কুল , কেউ একাই পাহাড় কেটে বানিয়ে ফেলে রাস্তা, চা বাগানের লেবার যার নিজেরই খাওয়া জোটে না সে নামিয়ে দিল আস্ত একখ্যান এম্বুলেন্স , আর এক রিক্সাওলা বানিয়ে ফেলে ভ্রাম্যমাণ টেক্সট বুক লাইব্রেরী , সব্জিমাসি বানিয়ে ফেলে আস্ত একখ্যান হাসপাতাল , অশিক্ষিত গ্রামের ভিখারি বুড়ি খুঁজে বেড়ায় স্কুল ছুট বাচ্চাকে , জেলখাটা আসামি পাহারা দেয় জঙ্গল বছরের পর বছর যাতে অন্য কেউ গাছ না কাটে , ডি গ্রূপ পোস্টাল কর্মী লাগিয়ে ফেলে হাজার হাজার গাছ কয়েক বছরের নিরলস পরিশ্রমে আরো আরো।
অবাক লাগে এসব কাজে এগিয়ে আসে মধ্যবিত্ত , নিম্নবিত্ত , দরিদ্র পরিবার থেকে আসা লোক । আমি হয়তো ভুল হতে পারি , জীবনে অনেক কিছুই তো দেখিনি । আবার আর এক শ্রেণীর মানুষকে দেখেছি যারা অর্থনীতি সমাজনীতি হিউম্যান রাইটস মার্ক্স এঙ্গেলস এসব গুলে খেয়েছেন , বিপ্লব কোন পথে সে ব্যাপারে সারাদিন ব্যাখ্যা দেবে আর এই ধরনের ঘটনা আর লোককে করুনার চোখে দেখে। এভাবে নাকি কিছুই হয়না , সামগ্রিকভাবে কিছু হয়না কিন্তু বন্টন তত্ত্ব অনুসারে উদ্বৃত্ত আর ঘাটতির মধ্যে কিছু সাম্য আনা যায়। আর আমার ছাত্র ছটুর ভার্সানেই বলি -- পাঁজরের নীচে দুশ গ্রাম মাংসের দলা আছে না , সেটা মাপ কর তবে তো
। এই ধরনের লেখা অনেকবার লিখেছি ভবিষ্যতেও লিখবো তা ছাই কেউ পড়ুক না পড়ুক । (এর মধ্যে একজন জ্ঞানী মানুষ জানিয়ে দিলেন , আমার সুড়সুড়ি মার্কা লেখা আবার আইন কোর্টফোটের ভয় দেখিয়ে দিল । তা আমার লেখা পড়ে কারো সুড়সুড় করলে আমি আর কি করতে পারি ।) তা যতবারই এই লেখা লিখেছি ততবারই বন্ধুরা তাদের কমেন্টসে লেখে -- চল ভাই এদের জন্য কিছু করি । তারপর চুপ । কাউকে ছোট না করে বলছি সব কিছুর সময় আছে । তাই সদিচ্ছা থাকলেও এগোতে পারে না । তাই পালমশাই কাদার তালেই আকৃতি দেন আর লোহা গরম থাকতে থাকতে আঘাত করতে হয়। অভিভাবকদের অনুরোধ আপনার কাদার তালটির মধ্যে এরকম প্রবণতা থাকলে সেটাকে শুকোতে দেবেন না ।
শেষ করছি সদ্য একটি ঘটনা দিয়ে । যে দোকানে পান খাই তার কাছে চায়ের দোকানে কয়েকটি ছেলে ঠেক করে বিকেলে। দিনে বোধহয় কোনো লেদ কারখানা বা গ্যারেজে কাজটাজ করে । আমাদের সামনেই বিড়ি সিগারেট গুটকা চকার মকার চলে । আনেকেই খুবই বিরক্ত । আমার কিছুই মনে হয়না , চাঁদসড়কে দেখেছি মায়ের পেট থেকে পড়েই বে , বাঁ# ,বা#বিটা এইসব চলতো কাজেই আমার আব্যেস আছে। এদের মধ্যে যেটি সবচেয়ে সরেস সেটার চুল আবার আগুন রঙা । কদিন আগে সন্ধ্যাবেলা একজন ভদ্রলোক , গ্রামে বাড়ি, পা দুখানা হাঁটুর নিচ থেকে কাটা , এসে দাঁড়ালেন। আমি জিজ্ঞেস করি কোথায় যাবেন ? লোকটি বলে - বাসস্ট্যান্ড । আমি বলি - দাঁড়ান আপনাকে তুলে দিচ্ছি। কিন্তু স্টেশনের দিক থেকে আসা কোনো টো টো কেই থামাতে পারছিনা । হয় লোক ভর্তি নতুবা এড়িয়ে যেতে চাইছে । হটাৎ আগুনচুলো ছেলেটি আমার পাশে -- দাঁড়ান কাকু আমি দেখছি। বলে একটি খালি টোটোকে জোর করে দাঁড় করালো । টোটোওলা গাইগুই করছিল ভাবছে বোধহয় ভাড়াটাড়া পাবে না। ছেলেটি পা কাটা ভদ্রলোককে কোলে করে তুলে বসিয়ে দিয়ে খুব নরম স্বরে বললো -- দাদা এনাকে বাসে তুলে দেবেন । বলে একটি কুড়ি টাকার নোট তার হাতে গুঁজে দেয় । সওয়ারী ভদ্রলোক বার বার বলে -- বাবা আমার কাছে টাকা আছে । ছেলেটি বলে -- কেন কাকা আমি দিতে পারি না। আর আমাকে অবাক করে টোটো ওলা ছেলেটি দশ টাকা ফেরত দিয়ে বলে -- ভাই বেশি লাগবে না আমি এমনিই তুলে দেবো ওনাকে।
আমি এগিয়ে আসি ওর দিকে তাকিয়ে বলি - চল তোদের সঙ্গে চা খাই । দলটার পুরোটাই ছিল । ও বয়াম থেকে বিস্কুট বার করে আমার হাতে দেয়। অন্যরা একটু অবাক । চা খাই চুপচাপ , অন্যরাও ।হঠাৎই আমার আগমনে তাল কেটে গেছে । চা প্রায় শেষ । ছেলেটি বলে -- কাকু পয়সা দিলে খারাপ লাগবে। আমি হেসে বলি আচ্ছা অন্যকোন দিন। তারপর বলি -- গুটকাটা বাদ দিতে পারিস । ছেলেটি হাসে -- সারাদিন হাতুড়ি পেটাই , এই নেশাটা জিইয়ে রাখে। তারপর একটু চুপ করে বলে -- ঠিক আছে চেষ্টা করবো । তার চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হয় এই মুহূর্ত থেকে গুটকা ছাড়ার প্রক্রিয়াটা বোধহয় শুরু হলো। ওর কাঁধে হাত দিয়ে বলি -- চলি রে। মন বলে ভরসা থাকুক তোদের উপর ।

_____________________________

দেবব্রত তরফদার। কথাশিল্পী ।

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়