Ameen Qudir

Published:
2018-10-19 23:16:34 BdST

ময়মনসিংহ মেডিকেলের শিক্ষার্থী যেভাবে এখন ভুটানের প্রধানমন্ত্রী


ময়মনসিংহ মেডিকেলের প্রাক্তন ছাত্র ডা. লোটে শেরিং



ডেস্ক রিপোর্ট
_________________________

আর কোন দ্বিধা নয়। সংশয়ের অবসান হয়েছে। আগে আমরা সুখবরটা ফলাও করে দিয়েছিলাম । বিষয়টা গৌরবের। বাংলাদেশের ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী ; বিসিপিএস থেকে পাশ করা চিকিৎসক ডা. লোটে শেরিং এখন সার্ক দেশ ভুটানের গনতান্ত্রিক মসনদে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন । যে কোন সময় শপথ।

ময়মনসিংহ মেডিকেলের প্রাক্তন ছাত্র ডা. লোটে শেরিং। বর্ণাঢ্য তার প্রফাইল। ভুটানের ন্যাশনাল এসেম্বলির ৪৭টি আসনের মধ্যে তার দল ড্রাক নাইএমরাপ সোগপা (ডিএনটি) ৩০টি আসনে জয়লাভ করে। বৃহস্পতিবার ১৮ অক্টোবর স্থানীয় সময় রাত সাড়ে ৮টায় দেশটির নির্বাচক কমিশন এ ফলাফল ঘোষণা করে। চ্যানেল নিউজএশিয়াসহ বিভিন্ন মিডিয়া থেকে পাওয়া সংবাদ এখানে যুক্ত করে প্রকাশ করা হল।

 

৫০ বছর বয়সী ডা. লোটে শেরিং ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন। তিনি মমেকের ২৮তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। পরে তিনি বাংলাদেশেই সার্জারিতে এফসিপিএস ডিগ্রি লাভ করেন। এছাড়াও তার ক্যানবেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমবিএ ডিগ্রি রয়েছে।

কর্মজীবনে ডা. লোটে শেরিং জেডিডব্লিউএনআরএইচ এন্ড মঙ্গার রিজিওনাল রেফারেল হসপিটালে কনসালটেন্ট সার্জন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সর্বশেষ জেডিডব্লিউএনআরএইচে তিনি ইউরোলজিস্ট কনসালটেন্ট হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৩ সালে তিনি চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করে রাজনীতিতে যোগ দেন।

 

ভুটানের স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমগুলো জানায়, ডিএনটি ১৬টি আসন জিতেছে। আর ডিপিটি জিতেছে ২২টি আসন। ক্ষমতাসীন পিডিপি ইভিএম পদ্ধতিতে নেয়া বুথগুলোতে ভোটে জিতে গেলেও ব্যালটে নেয়া কেন্দ্রগুলোতে হেরে যায়। দলটি নির্বাচনে মাত্র ৯টি আসনে বিজয়ী হয়েছে। আর ইভিএমে তাদের ভোট পড়েছে ৫৬ হাজার ১৮০ ভোট। আর ব্যালট পেপারে নেয়া কেন্দ্রগুলোতে তাদের ভোট সংখ্যা মাত্র ২৩ হাজার ৭০৩ ভোট।

যেভাবে জয়ী হলো ডিএনটি

নির্বাচনে জয়ের বিষয়ে বিশ্লেষণে দেশটির সবচেয়ে জনপ্রিয় সংবাদ মাধ্যম ইকোয়েনসেল তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, ডিএনটির এ বিস্ময়কর জয়ের কারণ মূলত ডা. লোটে শেরিং। তিনি একজন সার্জন হিসেবে আগেই মানুষের মন জয় করে নিয়েছেন। এছাড়াও তিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় তার পক্ষে ব্যাপক প্রচারণা চালিয়েছে তরুণ সমাজ। এগুলো তার জয়ের পক্ষে গেছে।

 

 

প্রথম দফা নির্বাচনে জয়ের পর ডা. লোটে শেরিংয়ের প্রতিক্রিয়া

প্রথম দফায় নির্বাচনে জয়ের পর ডা. লোটে শেরিং তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে খুবই খুশি। কারণ ডিএনটি গত ৫ বছর সংসদের বাইরে ছিল। যার কারণে আমাদের সমর্থকদের মধ্যে যার আমাদের আদর্শকে ভালোবাসে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত ছিল। নানা সীমাবদ্ধতার পরও আমাদের মধ্যে চিন্তার ঐক্য ছিল।

 

তিনি বলেন, জনগণের সঙ্গে সেই যোগাযোগটা অব্যাহত রাখব। তাদের মতামতকে শ্রদ্ধা করব। তবে আমাদের যেতে হবে বহুদূর। এজন্য আমাদের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে। আমরা খুবই আনন্দিত, সমর্থকদের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস আমাদের ব্যাপক উৎসাহিত করছে। তিনি বলেন, যদি সরকার গঠনের সুযোগ পাই তবে আমি আমার দেশের স্বাস্থ্যখাতকে আরও উন্নত করব। বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্বাস্থ্যসেবার বিষয়টি আরও গুরুত্ব দেয়া হবে। তিনি বলেন, ডিএনটি স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে কার্যকরী পদক্ষেপ নেবে।

এছাড়াও সিভিল প্রশাসনকে আরও গতিশীল করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়ার কথা স্থানীয় গণমাধ্যমের কাছে প্রকাশ করেন এ চিকিৎসক।

 

চিকিৎসা পেশা ছেড়ে কেন রাজনীতিতে

ভুটানের সংবাদ মাধ্যম বিবিএসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ডা. লোটে শেরিং বলেন, ভুটানের জনগণের অনেকের কাছে আমার পেশার বিষয়টি অস্পষ্ট। আমি বলতে চাই, আমি আমার (চিকিৎসক) পেশা ছেড়ে দেইনি; বরং আমার সঙ্গে পেশাও গিয়েছে। আমি সব সময় নিজেকে চিকিৎসক হিসেবেই ধারণ করি। আমি যেকোনো জায়গায় আমি প্র্যাকটিস করতে পারি। যখন কেউ বলে আমি চিকিৎসা পেশা ছেড়ে দিয়েছি তখন আমি আদৌ কষ্ট পাই আমি ছেড়ে যাইনি।

সাধারণ মানুষ রাজনীতিকে এতটা সিরিয়াসলি নেয়নি উল্লেখ করে আক্ষেপ করে ডা. লোটে শেরিং বলেন, সবাই বলে রাজনীতি একটি নোংরা জিনিস। রাজনীতিবিদরা দুর্নীতিবাজ। কিন্তু আমি এসব কথা শুনতে ও বিশ্বাস করতে চাই না। কারণ, রাজনীতিই পারে অন্যসব পেশাকে স্বচ্ছ করতে। ব্যক্তিগতভাবে আমি তা অনুভব করি। আমি আমার সর্বোচ্চটা দিয়ে দেশের নাগরিকদের সেবা করব।

চিকিৎসা ছেড়ে রাজনীতিতে আসা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘একজন চিকিৎসক হিসেবে আমি কেবল একজন রোগীর সমস্যা সমাধান করতে পারি। কিন্তু যদি আমি নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের কেউ হই তখন দেশের গোটা ব্যবস্থার যেসব সমস্যা আছে তার সমাধান করতে পারব।’

ডা. লোটে শেরিংয়ের জনপ্রিয়তার মূল রহস্য

নির্বাচনের আগে ভুটানের একটি সংবাদ মাধ্যমকে ডা. লোটে শেরিং বলেছিলেন, ‘আমি প্রতিদিন ১৫ থেকে ১৬ ঘণ্টা হাসপাতালে কাটাই। সেখানে সার্জারিসহ বিভিন্ন রোগীদের সেবা দেই। ওই সময় দেশ ও দেশের জনগণকে নিয়ে ভাবি।’ এই সেবার জন্য তিনি কারও কাছ থেকে অথবা কোনো সংস্থা থেকে কোনো অর্থ গ্রহণ করেন না বলে জানান শেরিং।

তিনি জানান, তার পেশাগত বিষয়কে রাজনৈতিক সুবিধার জন্য ব্যবহার করেননি। যদিও সেবার জন্যই মূলত ভোট পাওয়া যায়। এ নিয়ে তিনি কোনো বাধার সম্মূখীনও হননি।

রাজনীতিতে আসায় রাষ্ট্রকে ৬.২ মিলিয়ন ক্ষতিপূরণ বা পরিশোধ

২০১৩ সালে তিনি সিভিল সার্ভিস ছেড়ে রাজনীতিতে আসেন। চলতি বছরের মে মাসে তিনি ডিএনটি দলে ৪৭ প্রার্থীর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে দলীয় প্রধান হিসেবে নির্বাচিত হন। স্বেচ্ছায় অবসরের জন্য তিনি ট্রেনিংসহ সরকারকে তার দেশীয় ৬.২ মিলিয়ন মুদ্রা পরিশোধ করেন।

এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমার যদি দেশকে ভিন্ন আঙিকে সেবা দেয়ার আগ্রহ নাই থাকতো তাহলে আমি আমার পদত্যাগের জন্য এতো বড় অংকের টাকা ব্যয় করতাম না।

১৫ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত প্রথম দফা নির্বাচনে তার নেতৃত্বাধীন ডিএনটি দল জয়লাভ করে চমক সৃষ্টি করেছে। তবে চূড়ান্তভাবে বৃহস্পতিবার (১৮ অক্টোবর) পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় ভুটানবাসীদের। দ্বিতীয় দফায়ও বিশাল ব্যবধানে জয় পেয়ে প্রধানমন্ত্রীর আসনে অধিষ্ঠিত হওয়া নিশ্চিত হয় ডা. লোটে শেরিংয়ের।

 

ভুটানে সাধারণত দুই দফায় ভোট হয়ে থাকে। প্রথম দফায় ভোটাররা রাজনৈতিক দলগুলোকে ভোট দেয়। যে দুই দল প্রথম ও দ্বিতীয় স্থান পায়, তারা পার্লামেন্টের ৪৭টি আসনে প্রার্থী দেয় এবং তখন দ্বিতীয় দফা ভোট হয়। এবারের প্রথম দফার ভোটে চারটি দল অংশ নেয়।


বাংলাদেশি সহপাঠীদের উচ্ছ্বাস

ডা. লোটে শেরিং ভুটানের প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন এমন খবরে বাংলাদেশের মেডিকেল শিক্ষার্থীরা ভার্চুয়াল জগতে ব্যাপক উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন। বিশেষ করে ময়মনসিংহ মেডিকেলে অধ্যয়নরত বর্তমান ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা ব্যাপক আনন্দিত।

এ বিষয়ে ময়মনসিংহ মেডিকেলের সাবেক শিক্ষার্থী ও বর্তমানে বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব হেলথ সায়েন্স হসপিটালের রেজিস্ট্রার ডা. অসিত মজুমদার তার সহপাঠীকে স্বাগত জানিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন।

 

স্ট্যাটাসে ডা. অসিত মজুমদার বলেন, ডা. লোটে শেরিং আমার মেডিকেল কলেজের বন্ধু। ভুটান সরকারের বৃত্তি নিয়ে বাংলাদেশে মেডিকেল কলেজে চিকিৎসা বিজ্ঞান পড়তে এসেছিল। তখন আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তুমি ডাক্তারি পড়ছ কেন?
উত্তরে লোটে শেরিং বলল, ‘আমার মানুষের সেবা করার ইচ্ছা। ভাবলাম MONK হব। পরে দেখলাম ডাক্তার হলে সেবা করার সুযোগ আরও বেড়ে যায়। তাই ডাক্তারি পড়ছি।’

প্রসঙ্গত, ডিএনটি (Druk Nyamrup Tshogpa) দলের সভাপতি ডা. লোটে শেরিং শুধু চিকিৎসকই নন। তিনি তার দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও জড়িত। তিনি ড্রাক গ্রিণ পাওয়ার কর্পোরেশনের ম্যানেজিং ডিরেক্টর।

গত ১৫ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত প্রথম দফা নির্বাচনে কাস্ট হওয়া ২ লাখ ৯১ হাজার ৯৮ ভোটের মধ্যে ডিএনটি ৯২ হাজার ৭২২ ভোট পেয়ে শীর্ষস্থানে রয়েছে। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ড্রাক পোয়েনসাম। তাদের ভোট সংখ্যা ৯০ হাজার ২০। আগামী ১৮ অক্টোবর অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে ডিএনটি ও ডিপিটির মধ্যে চূড়ান্ত লড়াই হবে।

 

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়