Ameen Qudir

Published:
2018-10-14 22:17:30 BdST

রোগী কথনব্রেষ্ট ক্যান্সারঃ নারীর নীরব ঘাতক




১৩ অক্টোবরে চীনে No bra day উপলক্ষে জনসচেতনতা প্রচারণার ছবি।

ডা. ছাবিকুন নাহার
______________________________________

 

আমার বর্তমান যে অবস্থা, ফরজ কাজ ছাড়া সবকিছু হারাম হওয়া উচিৎ। তারপরও ফেবুতে ঢুকি, টুক করে দু একটা লেখা পোষ্ট করে আবার টুক করে কেটে পড়ি।

কত কত প্রিয় লেখা দেখি! করুণ চোখে তাকাই। ভাবি, একদিন আমার ও নিশ্চয় সময় হবে। গোগ্রাসে প্রিয় সব লেখা পড়ব, মতামত জানাব।
কবে সে সময় আসবে কে জানে! তারপরও আশায় বাঁধি ঘর...

আমার কথা বাদ। আজকে আমরা কথা বলব ব্রেষ্ট ক্যান্সার নিয়ে। এ রোগের সচেতনতার জন্য একটি ডে পালন করা হয়, 'নো ব্রা ডে।' অনেকে আবার পিংক ব্যাজ ধারণ করেন, বলেন, 'থিংক পিংক।' আসল কথা হচ্ছে সচেতনতা তৈরী। সেটা যেভাবেই হোক না কেন।

মূল গল্পে চলুন:

দয়িতা। পঁচিশ/ ছাব্বিশ বছরের তরুনী। শরতের আকাশের মতো ঝকঝকে। কিন্তু চোখ দুটো ভয়ার্ত, বিষন্ন! যেনো মহাবিপর্যের কার্নিশে দাঁড়িয়ে! অপেক্ষা শুধু ধ্বসে পড়া। আমার চেম্বারের রোগী।

- বসো। কি করো?
- অনার্স শেষ, মাস্টার্স করছি।
- বিয়ে করেছো?
- হুম একটা বাচ্চা আছে, তিন বছর।
- সাথে কে এসেছে?
- আম্মু।

মায়ের চোখে মুখে উৎকন্ঠা দ্বিগুন।
- আচ্ছা মা কি হয়েছে বলেন তো শুনি?
- আপা আমার মেয়ের বুকে চাকা না কি যেনো।
- আপা...
কথা শেষ করতে পারে না, চোখ ভরে যায় জলে।

মা, মেয়েকে আশ্বস্ত করলাম। যা শুনলাম, মূল কথা হচ্ছে ওর ব্রেষ্টে চাকা অনুভব করছে কিছুদিন যাবৎ। সাথে স্কিন চেঞ্জ। মাঝে মাঝে রেড কালার নিপল ডিসচার্জ! আগে খেয়াল করেনি।

এর সবগুলো লক্ষণই ব্রেষ্ট ক্যান্সারের দিকে যায়। ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা করে আরো বেশি নিশ্চিত হলাম। তারপরও কনফার্ম করা হলো ল্যাব পরীক্ষা করে। অনেকটা ছড়িয়েছে। অথচ একটু সচেতন হলেই এই মরনব্যাধি আর্লি ডায়াগনোসিস করা সম্ভব হতো।

- আগে আসনি কেন?
- ম্যাম ভেবেছিলাম তেমন কিছু না। তাছাড়া ব্যাথাও তেমন নাই। তাই ভাবলাম সিরিয়াস কিছু না।

আহারে মেয়ে! তুমি যদি জানতে পৃথিবীর সমস্ত ঘাতকরা এমন নীরবেই হানা দেয়! ঢোল পিটিয়ে আসলেতো তাদের মিশন সফল হবে না।

আসলে ব্যাথা বেদনা না থাকলে আমরা রোগীরা সাধারনত ডাক্তারখানা যেতে চাই না। আর ক্যান্সারগুলি এমন হারমী! চারদিকে না ছড়ানো পর্যন্ত এক ফোঁটা ব্যাথা দিবেনা। যেনো মনিবের প্রতি তার দয়া অসীম!

দয়িতার পরের কোশ্চেন,
'ম্যাম আমি বাঁচব তো? আমার এক খালার এমন হয়েছিলো, তার ব্রেষ্ট কেটে ফেলতে হয়েছে, আমারও কি তাই হবে?'
দয়িতার টলটলে চোখের দিকে তাকিয়ে কি বলেছিলাম? আসুন আরেকটু জানি এ মরন ব্যাধি সম্বন্ধে। আসলে নারী পুরুষ নির্বিশেষে সবাই চাইলে এর ভয়াবহতা কিছুটা হলেও কমবে।

* কত জনের হয়?
প্রতি আটজন মহিলার মধ্যে একজনের হওয়ার সম্ভাবনা আছে। সারা বিশ্বে যতগুলো ক্যান্সারজনিত মহিলাদের মৃত্যু হয় তার মধ্যে এটা দ্বিতীয়, প্রথম কারণ ফুসফুস ক্যান্সার।

* কেন হয়?
অনেকগুলো রিস্ক ফ্যাকটর আছে। তার মধ্যেে
- জেনেটিক,
- ফ্যামিলি হিস্ট্রি,
- এইচআরটি(হরমোন),
- আগে মাসিক হওয়া,
- পরে মাসিক বন্ধ হওয়া,
- দেরীতে বাচ্চা নেওয়া এবং
-বাচ্চাকে বুকের দুধ না খাওয়ানো।

বুকের দুধ খাওয়ানোর অনেকগুলো উপকারিতার মধ্যে এটা একটা দারুণ ব্যাপার।

* কিভাবে বুঝব অর্থাৎ ব্রেষ্ট ক্যান্সারের লক্ষণ সমূহ:
- ব্রেষ্টে চাকা,
- বগলের নিচে চাকা,
- চামড়া কমলার খোঁসার মতো হয়ে যাওয়া,
- নিপল দিয়ে লালচে রক্ত বা পু্ঁজ পড়া,
- নিপল দেবে যাওয়া ইত্যাদি।

* স্ক্রিনিং করব কিভাবে?
সেল্ফ ব্রেষ্ট এক্সামিনেশন- অর্থাৎ প্রতিটা মেয়ে বা মহিলা প্রতি মাসে মাসিক শেষ হওয়ার পর নিজে নিজের ব্রেষ্ট পরীক্ষা করে দেখবে কোন চাকা বা অস্বাভাবিকতা আছে কিনা। থাকলে সাথে সাথে ডাক্তার কনসালটেশন করবে। আর
ক্লিনিক্যাল ব্রেষ্ট এক্সামিনেশন- প্রতি তিন বছর পরপর ডাক্তারের কাছে গিয়ে পরীক্ষা করাবে।

* কখন থেকে?
বিশ বছর বয়স থেকে পয়ষট্টি বছর পর্যন্ত।

* ডায়াগনোসিস:
ক্লিনিক্যাল, আল্ট্রাসনোগ্রাফি, ম্যামোগ্রাফি ও বায়োপসি।

* চিকিৎসাঃ

প্রিভেনটিভ:
যথেচ্ছা হরমোন না নেওয়া, বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানো, রেগুলার সেল্ফ ব্রেষ্ট এক্সামিনেশ করা এবং ডাক্তার দিয়ে ক্লিনিক্যাল ব্রেষ্ট এক্সামিন করানো।

আর্লি স্টেজ:
সার্জারি হচ্ছে মেইন ট্রিটমেন্ট। মাস্টেকটমি অর্থাৎ এফেক্টেড ব্রেষ্ট কেটে ফলা।

এডভান্সড স্টেজ:
রেডিওথেরাপি অর্থাৎ সেঁক বা রেডিয়েশন দিয়ে ক্যান্সার সেলকে ডেস্ট্রয় করা। অনেক ক্ষেত্রে সার্জারির পরেও রেডিয়েশন এবং কেমোথেরাপি দিতে হয়।

* প্রগনোসিস:
খুব একটা ভালো না। যতগুলো রোগীর হয় তার প্রায় অর্ধেকই মারা যান। আর্লি ডায়াগনোসিস, সঠিক চিকিৎসা রেগুলার ফলো আপ এবং প্রবল জীবনীশক্তি এ রোগ থেকে জীবন ছিনিয়ে আনে।

* কোথায় চিকিৎসা হয়?
জাতীয় ক্যান্সার হাসপাতাল, বড় বড় মেডিকেল কলেজ এবং কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে।

নারীরা সাধারণত স্বামী, সন্তান, সংসারের দায়িত্ব নিতে নিতে নিজের কথা ভুলে যান। নিজেকে আলাদা সময় দেন না। নিজের অসুস্থ্যতাকে গুরুত্ব দিতে চান না। ফলে যে রোগগ সহজেই নিরাময়যোগ্য তা অনিরাময়যোগ্য হয়ে পরে।

মা, নিজের যত্ন নিন। নিজেকে ভালোবাসুন আপনি না থাকলে আপনার প্রিয় মানুষদের কী হবে? আপনার ভালোবাসার সংসারেরই বা কি হবে? আর পুরুষদের বলছি, প্রতিটি মেয়েই বাবার রাজকন্যা, আবার কারো না কারো মা। নারীদের অনেকগুলো পরিচয়ের মধ্যে এ দুটো পরিচয় অনন্য, অন্তত আমার তাই মনে হয়। আসুন বাবার রাজকন্যার জন্য আর সন্তানের মায়ের জন্য কিছু করি।
______________________________

 

ডা. ছাবিকুন নাহার
মেডিকেল অফিসার
ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ঢাকা

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়