Ameen Qudir

Published:
2018-10-10 22:37:49 BdST

বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস সবিশেষশিশুদের বিকাশে নজর দেব: মানসিক স্বাস্থ্য দিবসে এ হোক সকলের প্রতিজ্ঞা




 


অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল,
বাংলাদেশের অপ্রতিদ্বন্ধী জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক
________________________________

মানুষের ব্যক্তিত্বের বুনিয়াদ গড়ে ওঠে শিশুকাল থেকে। পাঁচ বছরের কাদা মাটির বয়সের মধ্যে গেড়ে বসে মানবজীবনের নানা ধরনের বৈশিষ্ট্য। আনন্দময় শৈশবই তাই উপহার দিতে পারে সুন্দর ভবিষ্যৎ। কিন্তু এই শাশ্বত কথার আড়াল দিয়েও শিশুর জীবনে ঢুকে যেতে পারে নানা চাপ। বাড়তে থাকা শিশুরা যখন বয়ঃসন্ধিকালে পা দেয়, সে চাপ ও নিজের দেহের ক্ষরিত হরমোনের নানামুখী ক্রিয়া-বিক্রিয়ায় কিশোর-কিশোরীরা দিশেহারা হতে থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে, সব মানসিক অসুস্থতার অর্ধেকই শুরু হয়ে যায় ১৪ বছর বয়সে। আরও দেখা গেছে, এসব অসুস্থতার বেশিরভাগই অবহেলিত বা অগোচরে থেকে যায়। এর পরিণতিতে দেখা যাচ্ছে, ১৫ থেকে ২৯ বছরে শিশু ও উঠতি বয়সী তরুণের মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ সুইসাইড বা আত্মহত্যা। বিশ্বজুড়ে প্রতি ১০ মিনিটে একজন কিশোরী সহিংসতার কারণে মৃত্যুবরণ করছে। আর ৮৩ শতাংশ মৌখিক উত্ত্যক্ততা বা বুলিংয়ের শিকার হচ্ছে। মানসিক স্বাস্থ্যের ত্রুটিপূর্ণ বুনিয়াদ নিয়ে এরা বড় হয়। এক জরিপে দেখা গেছে, এ ধরনের উঠতি বয়সী তরুণের প্রতি পাঁচজনে একজন অর্থাৎ বিশ্বজনগোষ্ঠীর ২০ শতাংশ মানসিক রোগে ভোগে। সমসাময়িক সমস্যা প্রাধান্য দিয়ে প্রতি বছর বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসে একটি প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়। এসব কারণে 'দি ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ফর মেন্টাল হেলথ' বিশ্বব্যাপী সাম্প্রতিকতম বার্নিং ইস্যু 'পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য' বিষয়কে এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে। উল্লেখ্য, শিশু নিপীড়ন-নির্যাতন ও শিশুর প্রতি ভায়োলেন্সকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ২০০২ সালেও দিবসটি পালন করা হয়েছিল।

শিশু-কিশোরের প্রতি নির্যাতন ও সহিংসতার প্রভাবকে মাথায় রেখে বলা হচ্ছে- শিশুরা ঘরে নির্যাতিত হচ্ছে, বাইরেও নির্যাতিত হচ্ছে। সমাজের বিভিন্ন স্তরে বিশ্বব্যাপী নির্যাতনের হার উদ্বেগজনকভাবে বেড়েই চলেছে। যুদ্ধের দামামায় শিশুরা যেমন দগ্ধ হচ্ছে, তেমনি ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে রিফিউজি ক্যাম্পে। দারিদ্র্যে জর্জরিত শিশুরা যেমন অমানবিক শিশুশ্রম দিতে বাধ্য হচ্ছে, তেমনি বিত্তবৈভবে থেকেও শিশু-কিশোররা বিভিন্ন ধরনের নিপীড়নের চাপে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার স্ট্ক্রিনে চোখ বুলালে আমরা থমকে যাই, চমকে উঠি। পত্রিকার পাতা উল্টালে বেদনার্ত হই, শিউরে উঠি। কারণ, বিশ্বব্যাপী দেখতে পাই ভীতসন্ত্রস্ত, ভয়ে জড়সড়, কিংকর্তব্যবিমূঢ় কিংবা যন্ত্রণাবিদ্ধ শিশুর কান্নাভেজা চাহনি। মুষ্টিবদ্ধ শিশুর ক্রোধের অভিব্যক্তিও গুরুত্বের সঙ্গে ইদানীং প্রাধান্য পায় মিডিয়া কাভারেজের কল্যাণে। পত্রিকার পাতায় প্রকাশিত শিশুর ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ কেড়ে নেয় আমাদের ঘুম। এত অভিব্যক্তি ও চিত্রে প্রতিফলিত হয় শিশু নির্যাতন-নিপীড়ন ও শিশুর প্রতি ভায়োলেন্স।

'বাংলাদেশ জার্নাল অব সাইকিয়াট্রি'তে প্রকাশিত মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের এক গবেষণা রিপোর্ট থেকে দেখা যায়, ভর্তিকৃত ৯৯২ জন মানসিক রোগীর ৭২ শতাংশ শৈশবে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ৬৬ শতাংশ আবেগীয় নিপীড়ন এবং ৬০ শতাংশ যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। বর্তমান সময়ে সাইবার বুলিংও শিশু-কিশোর-তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য বিপর্যয়ের একটা বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের গবেষণার ফল থেকে দেখা যায়, গৃহপরিচারিকার ৩৩ দশমিক ৬ শতাংশের বয়স ৫-১৪ বছরের মধ্যে। এদের ২৯ দশমিক ৬ শতাংশ প্রতিনিয়ত দৈহিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়, সহিংসতা ভোগ করে। ব্যক্তিগত, পারস্পরিক সম্পর্ক, কমিউনিটি বা সামাজিক কারণেও ভায়োলেন্স সংঘটিত হতে পারে। রাজনৈতিক কারণেও ভায়োলেন্সের হার উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে বিশ্বব্যাপী। ট্রমা ও ভায়োলেন্সের রয়েছে বিভিন্ন রূপ ও ধরন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা ক্রিমিনাল ভায়োলেন্স এককভাবে একটি ট্রমা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। আবার ট্রমা হতে পারে দীর্ঘমেয়াদি, লাগাতার। দীর্ঘমেয়াদি ট্রমার কারণে শিশুর নিরাপত্তাবোধ ধ্বংস হয়ে যায়।

 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ১৫ বছরের নিচে ৪ কোটি শিশু প্রতি বছর নির্যাতন ভোগ করে। তারা অবহেলার মাধ্যমে নিপীড়িত ও নিগৃহীত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের আরেকটি গবেষণা থেকে দেখা যায়, ৩০-৬০ শতাংশের ক্ষেত্রে শিশুরা পারিবারিক ভায়োলেন্সের শিকার হয়; ৪ লাখ টিনএজ ভয়াবহ শারীরিক জখম ভোগ করে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভায়োলেন্সের হার ছিল বেশি। ইতিহাস কী শিক্ষা দেয়? সমস্যা কি কমেছে? মানবাধিকার কি রক্ষা হচ্ছে? কেন লঙ্ঘিত হচ্ছে শিশুর মৌলিক অধিকার? ওপরের পরিসংখ্যানের ভয়াবহ ব্যাপ্তি ছাড়াও আমাদের সময়ে খোলা চোখে আমরা দেখেছি সাম্প্রতিক বিশ্বের ধ্বংসলীলা, দেখেছি আধুনিকতম স্থাপত্যের ধ্বংস, টুইন টাওয়ারের দাবানলে হাজার হাজার মানুষের নির্মম মৃত্যু। দেখেছি আফগানিস্তানে কার্পেট বোমা, বৃষ্টি বোমার তাণ্ডব। দেখেছি ফিলিস্তিনে বর্বরতম ধ্বংসযজ্ঞ। সিরিয়া, ইরাকে শিশুদের আহাজারিও দেখেছি আমরা।

এ ছাড়া কিশোর-কিশোরীকে নতুন স্কুলে যেতে হয়; শিক্ষার্থীদের নতুন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করতে হয়। তারপর তারুণ্যের সিঁড়ি মাড়িয়ে তাদের ঢুকতে হয় কর্মজীবনে। প্রতিটি ধাপেই আছে সংকট। কেউ সে সংকট টপকাতে পারে, কেউ পারে না। ব্যর্থরা মানসিক সমস্যার জালে জড়িয়ে যায়, জড়িয়ে যেতে পারে। এ জন্য প্রয়োজন জয় ছিনিয়ে আনার জন্য নিজের যোগ্যতাকে শানিত ও ব্যর্থতাকে বরণ করার শক্তি সঞ্চয় করা। এই শক্তি মানসিক রোগ প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এ জন্যই শিশুকাল থেকে ব্যক্তিকে গড়ে তুলতে হয়; গড়ে উঠতে হয় আত্মবিশ্বাস নিয়ে, আত্মবিশ্বাসী হয়ে।

তাই আন্তর্জাতিকভাবে, রাষ্ট্রীয় অবস্থান থেকে, সামাজিক কিংবা পারিবারিক পটভূমি থেকে ভায়োলেন্স প্রতিরোধের জন্য সততার সঙ্গে আন্তরিক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। আন্তর্জাতিক ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের পাশাপাশি রয়েছে পারিবারিক ও সামাজিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা। ঘর থেকেই শিশু নির্যাতন রোধে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে প্রথম। নির্যাতিত শিশুর সঙ্গে কী ধরনের আচরণ করা উচিত, এ ব্যাপারে যথেষ্ট ভূমিকা পালন করতে হবে পরিবার থেকে।

মূলকথা, এ জন্য প্রয়োজন প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা :সাইবার ক্রাইম প্রতিরোধে আমাদের দেশে বর্তমানে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও এ বিষয়ে নিয়োজিত সরকারি সংস্থাগুলো প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখছে। তারপরও ক্রাইম সংঘটিত হচ্ছে। তাই সাইবার বুলিং কী, তা বাবা-মাকেই বুঝতে হবে প্রথম। সতর্ক পর্যবেক্ষণ থাকতে হবে শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণীদের প্রযুক্তি ব্যবহারের যোগ্যতা আছে কি-না তা বোঝার। এ জন্য পাসওয়ার্ড যাতে শিশুরা না পায়, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। যদি কেউ জেনেও যায়, তবে পাসওয়ার্ড পরিবর্তন করতে হবে। অপরিচিত বা প্রমাণবিহীন কোনো সূত্র থেকে প্রেরিত কোনো বার্তা (ই-মেইল, টেক্সট মেসেজ, ফেসবুক মেসেজ) যেন তারা না খোলে এবং নিজেদের ছবি পোস্ট না করে, সে শিক্ষা দেওয়া। এ জন্য প্রচার চালাতে হবে, ক্লাব করতে হবে, যাতে সাইবার বুলিং বিষয়ে সচেতনতা বাড়ে। নানা কারণে কোনো কোনো শিশু-কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী অনিয়ন্ত্রিত আচরণ করতে পারে। ভায়োলেন্স কিংবা অ্যাগ্রেসিভ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে যেতে পারে।

 

দুরন্ত ও বেপরোয়া শিশুদের আমরা অনেক সময় শাস্তি দিই। মনে রাখা জরুরি, শারীরিক শাস্তি শিশুকে আরও বেশি মারমুখী ও বেপরোয়া করে তুলতে পারে। যিনি শাস্তি দিচ্ছেন, তার প্রতিও 'নেগেটিভ অ্যাটিচ্যুড'-এর বীজ রোপিত হয়ে যেতে পারে। ভবিষ্যতে ভায়োলেন্সের মাধ্যমে তার ভয়াবহ প্রকাশ ঘটতে পারে। আরও মনে রাখা জরুরি, যারা শৈশবে নির্যাতনের শিকার হয়, ভায়োলেন্সের কারণে দৈহিক কিংবা মনস্তাত্ত্বিক ট্রমা ভোগ করে, তারাই আবার নির্যাতনকারী হয়ে উঠতে পারে; অপরাধী হয়ে যেতে পারে। এসব কারণে সমস্যা প্রতিরোধে সামাজিক স্তর থেকে শিশুদের হতাশা দূর করতে হবে। দ্বন্দ্ব লাঘব করতে হবে। আত্মবিশ্বাস বাড়াতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। ভায়োলেন্সের সঙ্গে সঙ্গেই শিশুটির মানসিক স্বাস্থ্য মূল্যায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। চিকিৎসার মাধ্যমে দুরন্ত, অবাধ্য ও দুর্ধর্ষ আচরণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

পছন্দনীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে না পারলে, পরীক্ষায় আশানুরূপ ফল অর্জনে ব্যর্থ হলে, শিক্ষাজীবন শেষ করে উপযুক্ত সময়ে চাকরি না পেলে হতাশায় তলিয়ে যেতে থাকে তারা। হতাশা থেকে আসে বিষণ্ণতার রোগ, ভুল পথে নেমে যাওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায় তখন। এসব ক্ষেত্রে বাবা-মা, বন্ধু বা স্বজনদের সাপোর্ট দিতে হবে। এভাবে আমরা কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ভূমিকা রাখতে পারি। নজর রাখতে হবে শিশু বয়স থেকে বেড়ে ওঠার কাল থেকে। আনন্দময় শৈশবই পারে মেধাবী ও দক্ষ কৈশোর এবং তারুণ্যময় সময় উপহার দিতে।
_________________________________
অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল,
বাংলাদেশের অপ্রতিদ্বন্ধী জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক
অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট শেরেবাংলা নগর, ঢাকা

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়