Ameen Qudir

Published:
2018-10-08 23:34:01 BdST

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দেশের সম্মান বৃদ্ধির কৃতিত্বের প্রধান দাবীদার চিকিৎসকরা


 

 

বাংলাদেশের তরুণ উদ্যমী চিকিৎসকদের একাংশ। ছবি: ডা. কামরুল হাসান সোহেল ।

 

 

ডা. বাহারুল আলম
____________________________

গণভবনে চিকিৎসক সম্মিলনী– প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির এক দ্বান্দ্বিক প্রেক্ষাপট ।
....................................
গণভবনে চিকিৎসক সম্মিলনের এইদিনে কিছুক্ষণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রটোকল থেকে মুক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধুর কন্যা হিসাবে চিকিৎসকদের আপন হয়ে উঠতে পারার মধ্য দিয়ে সম্মিলনের সফলতা নির্ভর করে । নিশ্চয়ই তিনি বঙ্গবন্ধুর ন্যায় চিকিৎসক সহ পেশাজীবীদের ধারণ করবেন। ঔপনিবেশিক আমলাতন্ত্রের প্রটোকল পেশাজীবীদের কথা সরকার প্রধানের কাছে পৌঁছাতে দেয় না।
সীমিত সম্পদের এ রাষ্ট্রে চিকিৎসকরা ১৮ কোটি মানুষের স্বাস্থ্য প্রতিরক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত এবং হাজারো প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করছে রোগ বালাইয়ের বিরুদ্ধে। এর মধ্যে সফলতা এসেছে ব্যাপক , ব্যর্থতার গ্লানিও কম নয় । জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যে সকল অর্জন বাংলাদেশের সম্মান বৃদ্ধি করেছে, তারমধ্যে প্রধানতম কৃতিত্বের দাবীদার স্বাস্থ্যব্যবস্থার অগণিত চিকিৎসক সহ স্বাস্থ্যকর্মী।

এ সম্মিলনীতে চিকিৎসকদের কষ্টের কথা উপলব্ধিতে না আনলে তাদের দীর্ঘদিনের অন্তরজ্বালা প্রশমিত হবে না। বঞ্চিত ও অমর্যাদায় থেকে চিকিৎসকরা কখনও সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারে না। সমগ্র বাংলাদেশে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার প্রতিকূল অবস্থার খন্ডচিত্র এ সম্মিলনীতে উপস্থাপিত ও আলোচিত হওয়া প্রয়োজন ;-

# ক্যাডার সার্ভিসের আন্তঃক্যাডার বৈষম্য চিকিৎসক সহ সকল পেশাজীবীদের অধিকার নিরাপত্তা ও মর্যাদা বৈষম্যের কারণে সংক্ষুব্ধতায় রেখেছে। সচিব সভায় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও এ বৈষম্যের অবসান হয়নি।

এ সম্মিলনীতে পেশাজীবীরা আন্তঃক্যাডার বৈষম্যের অবসানের ঘোষণা চায় ।
# ত্রুটিপূর্ণ অকার্যকর স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় ঝুঁকি নিয়ে প্রতিনিয়ত চিকিৎসকদের কাজ করতে হয় । জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে হাসপাতাল ও তার শয্যাসংখ্যা যেমন অপ্রতুল, তেমনি রোগী ও চিকিৎসকের আনুপাতিক হারের বিশাল ব্যবধান । যে কারণে হাসপাতাল সমূহের সক্ষমতা ও ধারণ ক্ষমতার বাইরে রোগীদের তীব্র চাপ।

# অপরদিকে অবকাঠামো, লোকবল , রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার আধুনিক যন্ত্রপাতি , ঔষধসহ চিকিৎসার উপকরণের অভাবের কারণে রোগী – চিকিৎসক সম্পর্ক আস্থাহীনতায় রূপ নিয়েছে। কেন্দ্রের চেয়েও তৃণমূলে এ সংকট প্রকট।
# বেশকিছু চিকিৎসক ও নার্স নিয়োগ হলেও (যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম)৩য় ও ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগ দীর্ঘদিন বন্ধ রয়েছে । হাসপাতালে ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারী আউট সোর্সিং থেকে নিয়োগ হওয়ায়, অদক্ষতা ও অনভ্যস্ততায় চিকিৎসা সেবা দারুণভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এ সম্মিলনীতে এ সকল জটিল সংকটের সমাধানের ঘোষণা আসা প্রয়োজন।

# চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার ত্রুটির কারণে রোগীর মৃত্যু হলে শারীরিকভাবে চিকিৎসক লাঞ্ছিত হওয়া ও হাসপাতাল ভাংচুর করে আতংক সৃষ্টি করা - এখন বাংলাদেশে নিয়মে পরিণত হয়েছে । লাঞ্ছনা থেকে নারী চিকিৎসকও বাদ পড়ে না।

## সর্বাগ্রে প্রয়োজন চিকিৎসকদের কর্মস্থলের নিরাপত্তা। হাসপাতালে যা কিছুই ঘটে তার জন্য চিকিৎসক নয়, ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ দায়ী। অথচ সর্বক্ষেত্রে চিকিৎসককেই দায়ী করা হয়।

চিকিৎসকদের চেয়ে কম ঝুঁকিপূর্ণ পেশার দায়িত্বে থেকে প্রজাতন্ত্রের অনেক কর্মচারী রাষ্ট্রের নিরাপত্তার সুযোগ ভোগ করে থাকে। অবশ্যই এ বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে- এ সম্মিলনীতে সুস্পষ্টভাবে চিকিৎসকদের কর্মস্থলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ঘোষণা আসা প্রয়োজন।

# কোন একটি ক্যাডার অপরাপর সকল ক্যাডারের উপর খবরদারি করবে – মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে ন্যায়বিচার ও সাম্যতার দৃষ্টিতে এ বৈষম্য মৌলিক অধিকার পরিপন্থী। একটি ক্যাডার, সৃষ্ট পদের অধিক পদন্নোতি পেতে পেতে পদায়নের জট সৃষ্টি করেছে। অপরদিকে চিকিৎসক সহ অপরাপর ক্যাডার সদস্যরা গ্রেড বৈষম্যের অপমান ও কষ্টের পাশাপাশি শূন্য পদেও পদন্নোতি পাচ্ছে না। রাষ্ট্র প্রদত্ত সুবিধা ও মর্যাদা সকল ক্যাডারের জন্য অভিন্ন হওয়া উচিত। বঙ্গবন্ধুর কন্যা সরকার প্রধান থাকাকালীন এরূপ বৈষম্য অনাকাঙ্ক্ষিত।

# চিকিৎসা শিক্ষার মান ক্রমান্বয়ে অধঃপতিত হচ্ছে । জেলায় জেলায় এক বা একাধিক মেডিকেল কলেজ স্থাপনের অনুমতি পাওয়ায় প্রয়োজনীয় শিক্ষক ও হাসপাতালের অভাবে মানসম্মত চিকিৎসক গড়ে উঠছে না।

# এ সময়ে বাংলাদেশে ৩৬টি সরকারি ও ৬৯টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে শিক্ষকের সংখ্যা ৯৪০৩ জন , অথচ বিএমডিসি-র নিয়ম অনুসারে এতগুলো মেডিকেল কলেজে শিক্ষক প্রয়োজন ২৫৩০০ জন। ৬৩% শিক্ষক ঘাটতি নিয়ে মেডিকেল শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছে কলেজগুলো। বেসরকারি মেডিকেল কলেজে শিক্ষার্থীর তুলনায় শিক্ষকের সংখ্যা আরও কম । জনস্বার্থে ও জনস্বাস্থ্যে , ব্যাঙ্গের ছাতার মত এ সকল মেডিকেল কলেজ বন্ধ ও অনুমোদন না দিতে – এ সম্মিলনে ঘোষণা আসা প্রয়োজন।

# স্বাস্থ্যখাতে বাজেট প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশে বলা আছে, যেকোনো দেশের জিডিপির ৫% স্বাস্থ্যবাজেট হওয়া বাঞ্ছনীয়। ২০১৮/১৯ সালের বিশাল বাজেটে স্বাস্থ্যখাতে ২৩০৮৩ কোটি টাকা বরাদ্দ, যা জিডিপির ০.৯৪ শতাংশ (১ শতাংশের চেয়েও কম)। এর মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা খাতে ১৮১৫৯ কোটি টাকা এবং স্বাস্থ্যশিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগে ৫২২৪ কোটি টাকা। শুভঙ্করের ফাঁকি এখানেও কাজ করেছে। বাজেটে বরাদ্দকৃত টাকার পরিমাণ বেশী হলেও শতাংশ হিসাবে কম। এ অপ্রতুল স্বাস্থ্য বাজেটে বিশাল জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যপ্রতিরক্ষা দুঃসাধ্য ।

অবাক হওয়ার মত ঘটনা, জনপ্রশাসন ক্যাডারের কেবলমাত্র বাৎসরিক প্রণোদনা বাজেট, বাংলাদেশের ২০১৮/১৯-এর জাতীয় স্বাস্থ্য বাজেটের প্রায় কাছাকাছি - ১৯ হাজার ৬০১ কোটি টাকা। অথচ এ দেশের নাগরিকদের মাথাপিছু বাৎসরিক স্বাস্থ্যবাজেট মাত্র ১৪১৭ টাকা। নাগরিকদের এ লজ্জাজনক অবস্থা থেকে মুক্তি দেওয়ার অঙ্গীকারের ঘোষণা আসতে হবে এ সম্মিলনে।

বঙ্গবন্ধু , মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ একসূত্রে গাঁথা। বঙ্গবন্ধুর আজীবন সংগ্রামই ছিল পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক আমলাতন্ত্র ও তাদের শোষণের বিরুদ্ধে । যা বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বর্ণিত আছে। সেই চেতনার সন্তান হয়ে আমরা কখনই ঔপনিবেশিক আমলাতন্ত্র ও উপনিবেশিকতার ধারক-বাহক হতে পারি না । এ কারণেই চাই – “কৃত্য পেশাভিত্তিক মন্ত্রণালয়”- অর্থাৎ ‘ক্যাডার যার মন্ত্রণালয় তার’ ।
_________________________________

 

ডা. বাহারুল আলম। দেশের প্রথিতযশ লোকসেবী ডাক্তার এবং পেশাজীবী নেতা।

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়