Ameen Qudir

Published:
2018-09-19 15:34:17 BdST

"বাবা, আমার স্বামী ম্যাডিকেলে ভর্তি, পেটের নাড়ি ফুটা হইছে: পারফোরেশন"


 

লেখকের ছবি

ডা. রাজীব দে সরকার
_________________________

অ্যাপোলো হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। একজন মাঝবয়সী মহিলা হাসপাতালের ঠিক গেটে দাঁড়িয়েই ভিক্ষা করছেন।

ভিক্ষার প্যাটার্ন পুরাতন হলেও শব্দ চয়নে আছে নতুনত্ব।

"বাবা, আমার স্বামী ম্যাডিকেলে ভর্তি। পেটের নাড়ি ফুটা হইছে। পারফোরেশন। ডাক্তার বলছে অপারেশন লাগবে, জরুরী। অপারেশন না অইলে বাঁচানো যাবে না উনারে। আমারে কিছু সাহায্য করেন। হাসপাতালের খরচ দিতে দিতে সব বেঁচছি। সুরাহার্দী ম্যাডিকেলে আইজ ৫ দিন দইরা ভর্তি"

সাহায্য প্রার্থী মহিলা প্রায় এক নিঃশ্বাসে বলে গেলেন কথাগুলো।

তার সাথে আমাকে পেট ফুলে ওঠা এক বয়স্ক লোকের ৫আর সাইজের ছবি। কয়েকটা রক্ত পরীক্ষার কাগজ। একটা এক্সরে!

ভিক্ষার আয়োজনে আপাতঃ দৃষ্টিতে কোন খুঁত নেই।

পেটের নাড়ি ফুটো হয়ে যাওয়া বা পারফোরেশন অব হলো ভিসকাস, একটি মারাত্নক সার্জিকাল ইমারজেন্সী। রোগীকে পরীক্ষা করে এবং হিস্ট্রি নিয়েই আমরা সার্জনরা এ রোগ নির্ণয় করতে পারি।

আমরা এ ধরনের রোগীদের পেটের এক্সরে করতে দেই পারফোরেশন শিওর হবার জন্য। সাথে অ্যানেসথেটিক ফিটনেস এর জন্য আর ২/১ টি পরীক্ষা। সুতরাং হলফ করে অর্ধশিক্ষিত মহিলার প্রকাশিত তথ্যগুলোকে সঠিক ধরে নেওয়া যেতেই পারে।

আমার নজর কাড়লো যে ব্যাপারগুলোঃ

১. রোগী সুরাহার্দী ম্যাডিকেলে মানে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি, যেটি আমার বর্তমান কর্মস্থল। আর এখানে পারফোরেশন এর রোগী ৫ দিন ফেলে রাখার সুযোগ নেই কোন। পারফোরেশন এর রোগী কপালের জোরেও ৫ দিন ভালো থাকার কথা না।

২. এক্সরে হাতে নিলাম। সেখানে ক্লিয়ার বোঝা যাচ্ছে এটা পারফোরেশন এর কেইস। কিন্তু রক্তের নানা রিপোর্টে নানান জনের নাম লেখা। কোথাও আমিনুল, কোথাও মাসুদ।

৩. এই সামান্য এক্সরে এবং রক্ত পরীক্ষা করে কারো নিঃস্ব হয়ে যাবার সুযোগ খুবই কম। আর প্রকৃতই হতদরিদ্র রোগীদের জন্য আমরা চিকিৎসকরা সকল পরীক্ষা বিনা খরচে করার ব্যবস্থা করে দেই (এটা তখনই আমরা করি যখন আমরা বুঝতে পারি রোগী সত্যি নিঃস্ব। কীভাবে বুঝি? মহাগরিব, সত্যি গরীব, মডারেট গরীব, স্বভাবে গরীবে, ফ্যাশনে গরীব, মোডিফাইড গরীব, রাজনৈতিক গরীব ইত্যাদি নিয়েই আমরা থাকি!!)

আমি মৌনতা ভাঙলাম।

বললাম, উনি কতো নম্বর ওয়ার্ডে, কতো নম্বর বেডে ভর্তি? কলেজ গেটের উলটোদিকের সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে যদি আপনার রোগী ভর্তি থাকে, তবে আসুন, আপনার রোগীর অপারেশন আজই হবে। আমিই করবো। আপনার কোন টাকা পয়সা লাগবে না। একটা কিচ্ছু কিনতে হবে না।
(প্রকৃতপক্ষে আমাদের হাসপাতালে দামী অ্যান্টিবায়োটিক মেরোপেনাম থেকে স্যালাইন সবই সরকার সরবরাহ করে এবং স্বাস্থ্যখাতে আমাদের দেশের সাফল্য অন্যান্য সেকটরের বিচারে ঈর্ষণীয়)

ফিরে আসি গল্পে। (বয়সের কারনে ইদানিং আউ ফাউ বক বক বেশী করি। আমার ছাত্র ছাত্রীরাও বোধ করি বিরক্ত হয়।)

মহিলা আমার কথাগুলো খুব মন দিয়ে শুনলেন। শুনে বললেন, "ডাক্তাররা টাকা ছাড়া কোন ট্রিটমেন দেয় না বাবা।"

আমি দ্রুত পকেট থেকে আনার ভিজিটিং কার্ড বের করে দিলাম। তাকে আশ্বস্ত করে বললাম, তার স্বামীর চিকিৎসার দায়িত্ব আমার। আমি দায়িত্ব নিলাম।

উনি আমাকে কেন যেন ভরসা করতে পারছেন না। আমি তাকে বার বার আশ্বস্ত করছি। আশে পাশে মানুষ জমে গেছে। তারাও আমার সাথে কন্ঠ মেলাচ্ছেন।

অবশেষে মহিলা রাজী হলেন। তিনি বললেন, তিনি একটু পরেই হাসপাতালে গিয়ে আমাকে রোগীর ওয়ার্ড নাম্বার বেড নাম্বার জানাবেন।

আমিও চলে এলাম।

-

আজ প্রায় চার মাস হতে চললো। মহিলা আসেন নি আমার কাছে। আমাকে ফোনও দেনি নি। আমারও অপারেশনটা করা হয় নি।

"কেউ কথা রাখে নি, কেউ কথা রাখে না"
চার মাস!

**

তবে আমার মন বলছে, রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে কোন না কোন দিন ঐ অ্যাবডোমেন এর এক্সরে প্লেটটার সাথে আমার দেখা হয়ে যাবে। টিপিকাল ক্রিসেনট্রিক এয়ার শ্যাডো জাস্ট বিলো দ্যা রাইট ডোম অব ডায়াফ্রাম।

অজস্র পারফোরেশনের রোগীর স্বজনদের মাঝে ঐ মহিলাকে আজো খুব করে খুঁজি। ফিল করি।

অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি কী?

একটা গল্প বলিঃ
বনের রাজা একবার ঠিক করলো, গাধাদের বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ ঘটানোর জন্য একটা প্রজেক্ট হাতে নিবেন। প্রজেক্টের হেড করলেন একটা গাধাকে।

গল্প শেষ।


========

ডা. রাজীব দে সরকার

রেজিস্ট্রার, সার্জারী বিভাগ
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
অনলাইন সদস্য, সিএসসি শাখা, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর
আহবায়ক, সুহৃদ সমাবেশ, গোয়ালন্দ, রাজবাড়ী
প্রচার ও জনসংযোগ সম্পাদক, বিএমএ, রাজবাড়ী জেলা শাখা।

 

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়