Ameen Qudir

Published:
2018-08-04 17:02:10 BdST

অনন্ত অশ্রুধারার যবনিকাপাত: আর একটি প্রাণও যেনো সড়ক দুর্ঘটনায় নিভে না যায়



ডা. জামান অ্যালেক্স
___________________________________

 

১....

২০০৮-২০০৯ সালের কোন এক রোদেলা দুপুর। স্থান--কেরানীগঞ্জের ইকুরিয়া BRTA. একটি জায়গায় কিছু মানুষের জটলা, ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়ার প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা চলছে, আঁকাবাঁকা পথে গাড়ী চালিয়ে সামনে নিয়ে আবার ঐ পথেই পেছনে যেতে হবে। এই চলন্ত অবস্থায় বিভিন্ন বাঁকে খাম্বা সদৃশ বস্তু দাঁড় করানো আছে, গাড়ী চালাতে গিয়ে সেগুলোতে লাগলেই আর ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে হবে না...

অবস্থা দেখে আমার ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ার অবস্থা, চুইংগাম চিবুচ্ছিলাম, স্পষ্ট মনে আছে গাছতলায় দাঁড়িয়ে এই কঠিন পরীক্ষা দর্শনে সেই চুইংগাম কোঁৎ করে গিলে ফেলেছিলাম। এই প্র্যাকটিকেল পরীক্ষা পাশ করা আমার কম্ম না....

আমাকে অবশ্য এত কষ্ট করতে হয় নাই, আমাকে জানানো হলো এখানে নানা রকমের সিস্টেম আছে। আমাকে নাকি অলরেডী সেই সিস্টেমেও ঢোকানো হয়ে গিয়েছে। However, আমার ড্রাইভিং লাইসেন্স ইস্যু হলো। অবাক হয়ে লাইসেন্সটা উল্টেপাল্টে দেখলাম-- A licence to kill....

আমি ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ারও এক দেড় বছর একা একা কখনো গাড়ী চালাই নাই, আমি বুঝতাম--মানুষের জীবনের দাম আছে, শখের বশে এ জীবন নিয়ে হেলাফেলা করা যায় না....

২.....

ইকুরিয়ার BRTA এর সিস্টেম তো শুনলেন, এবার মিরপুরের BRTA এর ঘটনা শুনেন...

দু'বছর আগে নিজের গাড়ীর ফিটনেস চেক করাতে মিরপুর BRTA তে গিয়েছি। লম্বা লাইন। ফিটনেস এক্সামিনেশন শেষ হয়েছে, ফিটনেস সংক্রান্ত পেপারের জন্য ওয়েট করছি। হাঁটতে হাঁটতে এক চিপায় গেলাম, দেখি কিছু লোকের জটলা। আমার সাথে আমার কাজগুলোর হেল্পের জন্য এক পুলিশ আঙ্কেল গিয়েছিলেন। উনাকে জিজ্ঞেস করলাম, 'আঙ্কেল, এখানে বিষয়টা কি, জটলাটা কিসের?' পুলিশ আঙ্কেল হেসে উত্তর দিলেন--'এইটা গাড়ী ছাড়া ফিটনেসের জায়গা, গাড়ী না আইনাও ফিটনেস হইয়া যায়, এক্সট্রা ২০০০ টাকা লাগে....'

গাড়ী না দেখেই গাড়ীর ফিটনেস! বিষয়টা খারাপ না। উন্নত বাংলাদেশের উন্নত সব ব্যাপারস্যাপার, আমার এইসব না বুঝলেও চলে.....

৩....

ড্রাইভিং লাইসেন্স এর সিস্টেম এর কথা জানালাম, ফিটনেস পেপার কিভাবে তৈরি করা যায়-সেটাও তো শুনলেন। এবার এসব পেপার যারা রাস্তায় চেক করেন-তাদের কথা শোনেন....

গুলিস্তান ক্রস করছি। সার্জেন্ট সাহেব গাড়ী আটকালেন। শার্লক হোমসের মত পেপার চেক করে জানালেন গাড়ীর ভেতর-বাহিরও দেখতে চান। সব দেখা শেষ করে জানালেন গাড়ীর ফ্ল্যাগস্ট্যান্ড আছে, কাজেই মামলা হবে, ৪০০০ হাজার টাকার মামলা....

গাড়ীর ফ্ল্যাগস্ট্যান্ড আছে ২০০৭ সাল থেকে, কোন পুলিশ ধরলো না, তিনি ধরলেন। এটা নাকি মেজর অপরাধ, ড্রাইভারকে নিয়ে তিনি একটু দূরে চলে গেলেন....

আমি বিরক্ত হয়ে গাড়ীতে বসে আছি। কিছুক্ষণ পর ড্রাইভার এসে স্টার্ট দিয়ে গাড়ী চালানো শুরু করলো। জিজ্ঞেস করলাম-' কত বড় টাকার ফাইন করেছে?' ড্রাইভার বললো-'মামলা করে নাই স্যার, ২০০ ট্যাকা বখশিশ চাইছে, মিস্টি খাইবো কয়, দিয়া দিছি....'

সার্জেন্ট সাহেবের আমার গাড়ীর ফ্ল্যাগস্ট্যান্ড চোখে পড়লো, অথচ তার চারপাশে কয়েকটা লেগুনা উনার চোখে পড়লো না- যেগুলোর হেডলাইট নাই, রিয়ার ভিউ মিরর নাই, দরজা খুলে খুলে পড়ছে, বেপরোয়াভাবে চালাচ্ছে কিশোর বয়সী ছেলেগুলো। নাকি এখানেও কোন সিস্টেম আছে?

পিছনে ফিরে দেখি এবার এক হোন্ডাওয়ালাকে ধরেছে, আবারো বোধহয় মিস্টি খাবে....

৪....

একটা কৌতুক বোধ হয় সবারই জানা....

মৃত্যুর পর বেহেশতে এক পাদ্রীকে এক বাস ড্রাইভারের তুলনায় নিম্নমর্যাদা দান করা হলো।পাদ্রী গোস্বা করলেন, গডের কাছে এর কারণ জানতে চাইলে গড বললোঃ"যখন তুমি চার্চে বয়ান করতে তখন তুমিই একমাত্র আমাকে ডাকতে, বাকীরা ঘুমাতো। আর ঐ ড্রাইভার যখন দূরন্ত গতিতে গাড়ী চালাতো তখন যাত্রীরা সবাই আমাকে স্মরণ করতো, তাই এই ব্যবস্থা, বুঝই তো... "

তবে এই কৌতুক যে কতটা প্র্যাকটিক্যাল সেইটা বুঝলাম এক ঈদের ছুটির শুরুতে। মানুষজন সমানে ঢাকা ছাড়ছে। আমাকে বাসে করে যেতে হবে ঢাকার বাইরের কর্মস্থলে। ৬০ টাকার ভাড়া ২০০ টাকায় রফা করে বাসে উঠলাম, একদম পেছনের দিকে একটা সীটও পেলাম। নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হলো, নইলে ঈদের যাত্রায় বাসে সীট!!!

বাস চলা শুরু করার পর বুঝলাম আমার ভাগ্য গণনা সঠিক না, সকালে কোন বদের মুখ প্রথমে দেখলাম--সেটা মনে করার চেষ্টা করলাম। যে ব্যাটা বাস চালাচ্ছে সে নির্ঘাত Fast and Furious মুভির ফ্যান।পাশের লোক পান চিবুতে চিবুতে বললেনঃ " ভাইজান, খোদারে স্মরণ করেন। এইবার বাঁইচা ফিরলে ঈদে আর দেশের বাড়ী যামু না...."--এই বলে তিনি নিজেই খোদা নাম জপ করা শুরু করলেন....

ভয় সংক্রামক, বাস যাত্রীদের ভয়ার্ত আর্তনাদ আমার মাঝেও সংক্রমিত হলো। আমি বাসের হেল্পারকে ডেকে বাস থামিয়ে মাঝ রাস্তায় নেমে গেলাম। হেল্পার সাহেব আমাকে নামিয়ে আরেক যাত্রীকে উঠিয়ে আমার দিকে তাচ্ছ্যিলের হাসি দিয়ে বাসের গায়ে থাপ্পড় দিয়ে বাস চলানো শুরু করলো....

বাস চলে যাচ্ছে, বাসের পিছনে দেখলাম লেখাঃ"সড়কপথে বিমানের ছোঁয়া....."--লেখাটা আগে চোখে পড়লে ভালো হতো.....

৫.....

আচ্ছা, যারা আইন প্রণেতা তারা কি করেন?

কোন এক আইন প্রণেতা কোন এক সময় নাকি বলেছেন--গরু,ছাগল চিনলেই নাকি ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়া যায়, হোক সে অশিক্ষিত। কোন সুস্থ মস্তিষ্কের একজন মানুষ কি একথা বলতে পারে? আমার বিশ্বাস করতে কিন্তু কষ্ট হয়....

তবে দেশের দুইজন ছাত্রছাত্রী যখন বাস চাপায় মারা গেলো, তখন এক আইন প্রণেতাকে এর ব্যাখ্যা দিতে ভারতের মহারাষ্ট্রের দুর্ঘটনাকে তুলনা হিসেবে দাঁড় করাতে দেখেছি, সেটাও আবার হাসিমুখে। নিঃসন্দেহে এ দিনটির জন্য এ জাতির সদস্য হিসেবে আমি লজ্জিত, দুঃখিত এবং ব্যথিত.....

Jokes apart, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলে বাস চালকের সর্বোচ্চ শাস্তি মাত্র ০৩ বছর। আমাদের আইন প্রণেতাদেরও লজ্জা হওয়া উচিত....

৬....

আপনারা কতটুকু বুঝলেন জানি না, উপরের উদাহরণগুলোর সাক্ষী আমি নিজে, এ সেক্টরের প্রতিটি ধাপে ধাপে বিশৃঙ্খলা। এ দেশে সড়ক পরিবহন ব্যবস্থার যে নৈরাজ্য সেটা একদিনে গড়ে ওঠেনি। আমাদেরও গাফিলতি আছে বৈ কি! আমরা এ বিষয়গুলোতে গা করিনি। ফলাফল শুভ হয়নি, Undoubtedly, this sector is now rotten from top to bottom....

বাংলা সিনেমার স্বর্ণযুগের এক নায়কের নাম ইলিয়াস কাঞ্চন। তবে আমি মনে করি উনি আসলে রূপালী পর্দার নায়কই শুধু নন, উনি বাস্তব জীবনেরও নায়ক। প্রায় দুই দশক ধরে এই লোকটিকে আমি একা একা এই পরিবহন সেক্টরের নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে দেখেছি, আমরা এই বিচক্ষণ লোকটিকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারি নাই, আমরা অবশ্য সঠিক লোককে চিনতে সবসময়ই ভুল করি। দেশের ছাত্রসমাজের আজ এই যে জেগে উঠা, সেটা নিশ্চিতভাবেই লোকটির অশান্ত মনকে শান্ত করবে....

পরিবহন সেক্টরের মন্ত্রিত্ব এই লোকটার হাতে দিলে কেমন হয়?

৭....

লেখাটা শেষ করি....

মিডিয়ার কল্যাণে ভিডিওতে দেখলাম- গত কয়েকদিন আগে যে মেয়েটি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছে, তার বাবা পরদিন সকালে দুর্ঘটনাস্থলে গিয়ে রাস্তায় পড়ে থাকা তার মেয়ের স্যান্ডেল এবং রক্তমিশ্রিত ছাতাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন। এই জনমে মেয়েকে আর ফিরে পাবেন না, এ সত্য তার জানা হয়ে গিয়েছে। তাই ঐ যে তার মেয়ের রক্তে রঞ্জিত ঐ রাজপথ, ঐ যে এক পাটি স্যান্ডেল, ঐ যে রক্তমিশ্রিত ঐ ছাতা-সেসবের মাঝেই তিনি তার মেয়েকে খুঁজে ফেরেন। আমি নিশ্চিত-তার বাকী জীবনে তিনি ঐ এক পাটি স্যান্ডেল আর ঐ ছাতাটিকে কখনোই হাতছাড়া করবেন না....

কি ভয়ঙ্কর কষ্ট আমরা ঐ পিতাটিকে দিয়েছি তা কি আমরা বুঝতে পারছি? পার্থিব জীবনের কোন কিছুর বিনিময়ে পিতার এই শোককে কি আমরা মুছে দিতে পারবো? অবশ্যই না, কিছু কিছু ক্ষতি তো অপূরণীয়, অলঙ্ঘনীয় .....

তবে আমরা এই শোককে কাজে লাগাতে পারি, শোককে শক্তিতে রুপান্তরিত করতে পারি, শোকের দ্রোহে সড়কপথের নৈরাজ্যকে বিদায় করতে পারি। আমাদের শপথ হোক--আর একটি প্রাণও যেনো সড়ক দুর্ঘটনায় নিভে না যায়। তবেই হয়তো সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত আত্মাগুলো শান্তি পাবে, তবেই হয়তো তাদের আপনজনদের চোখের অনন্ত অশ্রুধারার যবনিকাপাত হবে।
________________________________

ডা. জামান অ্যালেক্স। সুলেখক।

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়