Ameen Qudir

Published:
2018-07-19 16:04:07 BdST

সিজারিয়ান সেকশন, অসুস্থতার আর এক লড়াই,আর এক প্যারাডক্স !




 


ডা. এম সজীব উদ্দীন স্বাধীন
________________________________

আমি একটা কেস স্টাডি করেছি। আমার কাছে রেগুলার গর্ভকালীন সেবা নিতে আসা ১০ জন খুব কাছের কাপলের উপর। যারা আমার কথায় আস্থা রাখে। আমি প্রতিবার সাক্ষাতে তাদের অনেক সময় দিছি, গল্প করেছি। সিজারের সিদ্ধান্ত না নিয়ে নরমাল ডেলেভারির জন্য উৎসাহিত করেছি , মটিভেট করেছি। ৯ মাস ২৪ ঘন্টা তাদের জন্য আমার ফোন সার্ভিস প্রোভাইড করেছি। নরমাল ডেলেভারির সকল লজিস্টিক, যেমন রাত্রে ব্যাথা উঠলে এম্বুলেন্স বাসা থেকে নিয়ে আসবে। সরকারী হাসপাতালে পৌছালে নরমাল ডেলেভারির জন্য স্কিলড ম্যান পাওয়ার আন্তরিকভাবে কাজ করবে।

আমি ডেলেভারির এক্সপেক্টেড ডেটের ১৫ দিন আগে লাস্টবার সকল স্ট্যাটাস চেক করে ২/৩ সপ্তাহ অপেক্ষা করার পরামর্শ দিছি। শেষবারের মতো একশন প্ল্যান বুঝিয়ে দিছি। এম্বুলেন্সের নাম্বার টা চেক করে দিছি। যেমন যদি, ব্যাথা উঠে তাহলে গাংনী উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে আসবে। যদি রাত বা অন্য কোন কারনে যানবহন না পাই তাহলে এম্বুলেন্সে ফোন দিবে। লেবার ইউনিটে এসে আমার প্রি ন্যাটাল চেকাপের কাগজ দেখালেই ওখানে কর্মরত সিস্টার ও অন্যান্য স্টাফ নরমাল ডেলেভারির জন্য সর্বোচ্চ ট্রাই দিবে সেটা আমি জানি। ব্লাড রেডি থাকবে, যদি নরমাল ডেলেভারি ব্যার্থ হয় তাহলে ৩০ মিনিটের মধ্যে সিজারিয়ান সেকশনের ব্যাকাপ রেডি থাকবে।

এই দশজন এর অধিকাংশই আমার বন্ধু বা আত্নীয় কিংবা বন্ধুর মতো। ১০ জনের ৮ জন মাস্টার্স পাশ একজন আমার প্রাইভেট চেম্বারের রেডিওলিজি এসিস্টেন্ট। ও সম্ভবত মেট্রিক পাশ করে নি।

১০ জনের মধ্যে একজন আমার বাল্যবন্ধু Yarian Eron সিজার করার সিদ্ধান্ত নেয়, আমি তাতে সম্মতি জানায়। কারন মাদারের ব্রেইনে বিজারি কিছু খিঁচুনির প্রিভিয়াস হিস্ট্রি ছিল। এইটা এপিলেপ্সি কি না তার ক্লেয়ার ডায়েগনসিস ছিল না, আবার এটা এক্সক্লুড করাও যাচ্ছিলো না। একটা উপজেলায় খুব লিমিটেড রিসোর্স এ ঝুকি নেওয়াটা ওয়াইজ মনে হয় নি। তাই সেটা টারশিয়ালি লেভেল হাসপাতালে সিজারিয়ান সেকশন করা হয়।

৯ জনের মধ্যে ৭ জন সিজারিয়ান সেকশন করিয়েছে কিছু প্রাইভেট ক্লিনিকে। মজার ব্যাপার হলো আমি তাদের অলমোস্ট হাউজ ফিজিসিয়ান হওয়া সত্ত্বেও, নয় মাস নিরবিচ্ছিন্ন সেবা দেওয়া সত্ত্বেও ৭ জনের ৬ জনই আমাকে সিজারের আগের মুহুর্তে একবার ও ইনফর্ম করেনি। সামান্য প্রয়োজন বোধ করেনি পরামর্শ নেবার। তারা কেন এমনটি করেছে তার প্রত্যেকটি এক একটা স্টাডি পেপার। সামান্য একটু টাচ দিচ্ছি।

৬ জনের একজন আমার মাস্টার্স পাশ বন্ধু,। সিজার পর্রবতী জটিলতায় বাচ্চা নিয়ে সমস্যায় পড়ে যখন আমার কাছে আসে আমি খুব মন খারাপ করে জিজ্ঞাসা করেছিলাম সিজার করার কারন। সে যখন সিজারের সিদ্ধান্তে বাবা মা আর স্বশুর শ্বাশুরী ও আত্নীয় স্বজনদের চাপের কথা জানায়। প্রচন্ড রাগ ও হতাশায় আধাঘণ্টা ধরে তাকে গালিয়ে ছিলাম। আমার এতদিনের কেয়ার, ইডুকেশন, সাপোর্ট এর কোন মুল্য নাই!! স্কুল লাইফে সব চেয়ে শক্তিশালী ফুটবলারের এরকম ব্যাক্তিত্বহীন, দুব্বল মেরুদন্ডের চেহারা দেখে ধ্বজভঙ্গ বলে খিস্তি দিছি। আমি তাকে ছবি একে, থ্রিডি পিকচার দিয়ে এটাও বুঝিয়েছিলাম একটা ২০/২৫ বছরের তরুনীর পেটের উপর ছুরির আচড় এখানকার স্ট্রাকচার ও মাসল স্ট্রেন্থ এর কি পরিমান ক্ষতির কারন হয়। এটা ফিজিক্যাল ও সেক্সুয়াল হেলথের উপর কতবড় হুমকি। কোন মন্ত্রই এই সাত কাপলের পরিবারের সিজারিয়ান সেকশনের সিদ্ধান্ত বদলাতে পারে নি। হয়তো কাপলের পাশাপাশি তাদের বাবা মাদের ও কাউন্সিলিং এর আন্ডারে নিয়ে আসলে ভালো ফল দিতো।

 

যাই হোক, ১০ জন সাবজেক্টের একজনকে সিজারের জন্য রেফার্ড করি। ৭ জন নিজেরা সিজারের সিদ্ধান্ত নিছে। আমার তিনবছরের মুল্যবান সময় নস্টের জন্য আফসোস লাগছে। ১০ জনের মাত্র দুইজন নরমাল ডেলেভারির সিদ্ধান্ত নিছে। একজন আমার চেম্বারের এসিস্টেন্ট। শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত আমার পরামর্শে আস্থা রাখায় আমি খুব খুশি হই, এমনকি ডেলেভারি ১ ঘন্টা আগের স্ক্যান ও আমি করি। আর একজন এক সাহসী পিতা ও সাহসী হাজবেন্ড, ছোট ভাই নতুন ডাক্তার Turin Khan, যে অসংখ্য প্রতিবন্ধকতা অগ্রাহ্য করে, ঢাকা থেকে তার ওয়াইফকে ম্যাটার্রনিটি পিরিয়িডে উপজেলা পর্যায়ে নিয়ে আসে শুধু নরমাল ডেলেভারির
জন্য। সে একটি রাজকন্যার মতো কন্যা সন্তানের জনক হয়ছে। যদি ও তার ওয়াইফ কে প্রসব পরবর্তী মাল্টিড্রাগ রেজিসটেন্স এক খতরনাক ইনফেকশনের শিকার হতে হয়। যা আমাদের সবার কয়েক সপ্তাহের ঘুম হারাম করে দিছিলো। দেশের সরকারি হাসপাতাল গুলোর লেবার ইউনিট স্টেরিলাইজেশনে মনোযোগ না দিলে বড় বিপদ আসবে সারা দেশে। মাল্টি ড্রাগ রেজিস্টেন্স ব্যাক্টেরিয়া চারাপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

সিজারিয়ান সেকশন সম্পর্কিত আমার এই স্টাডি আমাকে প্রচন্ড রাগান্বিত করে, হতাশ করে। প্রায় এক বছর কাউকে নরমাল ডেলেভারির জন্য কাউন্সিলিং করার উৎসাহ পাইনি। চিন্তারের গভীরে গিয়ে বুঝেছি সিস্টেম এই দেশে আসলে ওভাবে কাজ করে না। রাজা রামমোহন রায়, ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরদের সময়কার বাংগালী মেন্টাল সেট আপ আজো খুব বেশি পাল্টায়নি। সারাদেশের কথা জানি না, আমার কর্মরত উপজেলায় এই মাস থেকে সকল ক্লিনিকের সিজারিয়ান সেকশন মনিটরিং এর আন্ডারে নিয়ে আনতে যাচ্ছি। অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ান সেকশন একটি মানবতাবিরোধী অপরাধ। সার্জন, ক্লিনিক মালিক থেকে স্বয়ং হাজবেন্ড কিংবা বাবা মা ও কোন না কোনভাবে এই অপরাধের ফুয়েল যোগাচ্ছে।

আমি জানি, যুদ্ধ টা সহজ না। আমি অনেক ব্লাড রিলেটিভস কেও সিজারিয়ান কেস ম্যানেজ করে কমিশন খেতে দেখেছি। বিশ্বাস করুন, যদ্ধটা অনেক ঝুঁকিপূর্ণ, বাট আই হ্যাভ টু স্টার্ট, আই হ্যাভ টু ডু।

পিকঃ Few deta from Natinal Demographic and Health Survey.

________________________________

লেখক ডা. এম সজীব উদ্দীন স্বাধীন
সুলেখক । সমাজ সচেতক।

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়