Ameen Qudir

Published:
2018-05-25 18:27:37 BdST

'মোটর বাইকে তুমি কি ঐ লোকটাকে জড়িয়ে বসেছিলে? কিভাবে তাল সামলালে তুমি?'


প্রতিকী ছবি

 

 

ডা. তারিক রেজা আলী
________________________________

অফিস শেষ করে দীর্ঘ দেড় ঘন্টা ধরে রাস্তায় হেঁটে বেড়াচ্ছে চন্দনা। শাহবাগে ছাত্র-ছাত্রীরা রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে। পল্টনে নিজের অফিস থেকে বের হয়ে কিছুদূর আসতেই অফিসের গাড়ীর ড্রাইভার দিল ভয়াবহ সংবাদ। সামনে রাস্তা বন্ধ। গাড়ী ঘুরিয়ে অন্য রাস্তায় যাওয়ারও উপায় নেই। অগত্যা অন্য সবার মতো গাড়ী থেকে নেমে পড়লো চন্দনা। হাঁটতে শুরু করলো। আন্দোলনকারী দের দূর থেকে দেখতে দেখতে শাহবাগ পেরিয়ে হেঁটে এলো আরো অনেকটা পথ। ক্লান্তিতে অবসন্ন লাগছে। সকালে নাস্তা করেছে সে একটি মাত্র হাতে বানানো রুটি আর সব্জী। অফিসে এগারোটায় একটি সিঙ্গারা। এখন প্রায় তিনটা বাজে, কিছু খাওয়া হয় নি আর। কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউর দুই পাশে দুটো বড় হাসপাতাল, হাজার হাজার মানুষ পায়ে হেঁটে যাচ্ছে। অনেক রোগীও উপায় না পেয়ে সঙ্গীর হাত ধরে অল্প অল্প এগুচ্ছে। রাস্তার দু' পাশেই সারি বদ্ধ হয়ে স্টার্ট বন্ধ করে বসে আছে সব গাড়ী।

স্মার্ট ফোনের বিভিন্ন এ্যাপস্ দেখার চেষ্টা করলো চন্দনা। উবার ডাকার চেষ্টা করতে লাগলো। একজনকে পেয়েও গেল। ড্রাইভার সাহেব এখন মগবাজার। বিনয়ের সাথে জানিয়ে দিল, ওখান থেকে এখন শাহবাগ আসার কোন উপায় নেই। সে বুদ্ধি দিলো, ম্যাডাম, মোটর সাইকেল ডাকতে পারেন। কখনো এ্যাপস ব্যবহার করে মোটর বাইকে চাপার চিন্তা করে নি চন্দনা। এরকম চিন্তা আসারও কথা না। তবে এ মুহূর্তে বুদ্ধিটা খারাপ লাগলো না। সে ট্যাক্সি বাদ দিয়ে মোটর সাইকেল ডাকার চেষ্টা করতে লাগলো। কাঁধের ব্যাগটা রাস্তার পাশে দেয়ালে হেলান দিয়ে রেখে চেষ্টা চালিয়ে গেলো। ওকে বিস্মিত করে যোগাযোগ করলো এক লোক। আনন্দে যেন আত্মহারা হয়ে গেল চন্দনা। লোকটা রাজি হলো। ও কোথায় আছে জেনে আশ্বস্ত করলো কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসবে সে। এতক্ষণে তার মনে পড়লো বাড়ীতে রেখে আসা দুই সন্তানের কথা। কি করছে তারা? দুপুরে খেয়ে ঘুমিয়েছে কি?

বেশীক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। এক ছেলে একেবারে চন্দনার সামনে এসে ব্রেক করলো তার মোটর সাইকেল। বিনয়ের সাথে বসতে বললো তার পিছনে। জেনে নিলো তার গন্তব্য, উত্তরার কোন সেক্টরে কোথায় যেতে হবে। একটু অস্বস্তি নিয়ে বসলো চন্দনা। নিজের ব্যাগটা রাখলো দুজনের মাঝে। পিছনে ক্যারিয়ারের রডটা ধরে রাখলো শক্ত করে। ড্রাইভার চালানো শুরু করলো। প্রচন্ড জ্যামের ভিতরে সে কিভাবে জায়গা করে নিচ্ছে, অবাক হয়ে দেখতে লাগলো চন্দনা। ফুটপাথের উপর দিয়ে, দুটো গাড়ীর ফাঁক গলে মসৃণ গতিতে এগিয়ে চললো সে। ফার্মগেট, মহাখালী পার হয়ে বনানী পৌঁছে গেল পনেরো-বিশ মিনিটের মধ্যে। মোটর বাইকে চড়ার অভিজ্ঞতা চন্দনার খুব কম। এ জীবনে দুবার চড়েছে সে। একবার যখন সে কিশোরী, মেট্রিক পরীক্ষার পর খালার বাড়ী বেড়াতে গিয়েছিল গ্রামে, খালাতো ভাই তাকে নিয়ে ঘুরিয়ে এনেছিল অনেকটা পথ। আরেকবার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় একবার এক বন্ধুর বাইকে চড়ে গিয়েছিল মীরপুর। তখন সে অন্য মেয়েদের মত বাম পাশে সাইড করে বসেছিল। আজ কিন্তু দু পা দুই দিকে দিয়ে, কোন অসুবিধা হচ্ছে না, যথেষ্ট আত্মবিশ্বাস নিয়েই বসে আছে সে। বাতাসে উড়ছে চুল। ভেসে আসছে সামনের যুবকের শরীরের বডিস্প্রের গন্ধ। অস্বস্তিবোধ চলে গেছে। স্রষ্টা কে ধন্যবাদ দিল, যেভাবেই হোক বাড়ী ফেরার একটা পথ তো তিনি করে দিয়েছেন। অভিমান করার সুযোগ পেলো সে এতক্ষণে। এত সময় গেল, ওর স্বামী বা শ্বশুর-শাশুড়ী কেউ তো খোঁজ নিল না চন্দনা কি করছে, কেন এতক্ষণেও বাড়ী ফিরছে না!

সব উৎকণ্ঠার হলো অবসান। মাত্র একঘন্টায় সকল জ্যাম আর দুঃস্বপ্ন কে পিছনে ফেলে বাড়ী ফিরলো চন্দনা। ড্রইংরুমে বসে আছে তার স্বামী। বাচ্চারা খেলছে। সব ঠিক আছে। কোথাও কোন সমস্যা নেই। স্বামী জিজ্ঞাসা করলো কেন এত দেরী হলো। জবাবে চন্দনা বললো, সে কি জানে না আজ ঢাকায় কি সমস্যা হয়েছে। স্বামীর জানার কথা হয়তো না। তার অফিস উত্তরাতেই, বাড়ীর কাছে। ঢাকা শহরের উৎকট জ্যাম তাকে কোন সমস্যায় ফেলতে পারে না। সব বললো চন্দনা। কিভাবে হেঁটে হেঁটে প্রায় দুই কিলোমিটার রাস্তা পার হয়েছে। কিভাবে বহুকষ্টে একটা বাহন পেয়েছে এতটা পথ পারি দিয়ে বাড়ী ফেরার। সব শুনে কিছুক্ষণ চুপ হয়ে থাকলো চন্দনার স্বামী। তারপর প্রশ্ন করলো, আচ্ছা তুমি যে মোটর বাইকে উঠে এলে, তুমি কি ঐ লোকটাকে জড়িয়ে ধরে বসেছিলে? কিভাবে তাল সামলালে তুমি?

রাগে ক্ষোভে চন্দনার কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেলো। কি জবাব দেবে সে এই প্রশ্নের। মনে পড়ে গেলো বহুদিন আগে আরেকবার সে সন্ধ্যায় প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টি মাথায় করে ঘরে ফিরেছিল। সেবারও এ বাড়ীর সবাই ছিল নির্লিপ্ত। যেন এরকমই হওয়ার কথা, যেহেতু চন্দনা চাকুরী করে, তার সব সমস্যার সমাধান তো তাকেই করতে হবে। আর সবাই জানে সে অত্যন্ত মেধাবী, প্রত্যুৎপন্নমতি। চলার পথে দৈনন্দিন জীবনের সব বাঁধা দূর করা তো তার জন্য কোন কঠিন বিষয় নয়।

স্বামীর চোখে চোখ রেখে শান্ত গলায় জবাব দিল চন্দনা, মোটর বাইকে চড়লে একটু তো জড়িয়ে ধরতেই হবে, তাই না?
___________________________

ডা. তারিক রেজা আলী। সহযোগী অধ্যাপক, রেটিনা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

 

 

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়