Ameen Qudir
Published:2018-05-21 15:56:23 BdST
রবীঠাকুরের শান্তিনিকেতনে কিছুক্ষণ
ডা. ফরিদা ইয়াসমিন, ঢাকা
__________________________
" মহর্ষি যাচ্ছিলেন রায়ের বাজার রাজার বাড়িতে নেমন্তন্নে।পথে গভীর অরন্য, যেখানে ডাকাত হানা দেয় প্রায়ই, এমন এক জায়গায় একটি ছাতিম গাছের নীচে তিনি বিশ্রাম নেন।জায়গাটি খুব পছন্দ হয় তারঁ । নেমন্তন্ন শেষে তিনি রাজাকে বলেন, আপনার ভুবনডাঙার ওই জায়গাটা কিনতে চাই...। ২০ বিঘা জমি মহর্ষির কাছে নামমাত্র দরে ১৬ আনায় বিক্রি করলেন রাজা।
মহর্ষি ভুবনডাঙায় একটি আশ্রম তৈরী করে ছাতিমতলায় বসে নিভৃতে ধ্যান তথা ঈশ্বরচিন্তা করতেন। মাঝে মাঝে শিষ্যদের নিয়ে আলাপ করতেন।
"তিনি আমার মনের আরাম, প্রানের আনন্দ, আত্মার শান্তি"।
কিছুদিন পর তিনি 'শান্তিনিকেতন গৃহ' নাম দিয়ে সেখানে একটি ছোট বাড়ী তৈরী করলেন।পুত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ীর আদলে শান্তিনিকেতন গৃহ নতুন করে নির্মান করেন এবং আশ্রমটিকে বিদ্যালয় করেন,যা আজকের এই বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় । এই ছাতিমতলায় তিনিও ছাত্রদের সাথে বসে কথা বলতেন। এই ছাতিমতলাই বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সূতিকাগার। এই মঞ্চেই ঘোষিত হয়েছিলো কবিগুরুর নোবেল পাওয়ার সংবাদ।এখানেই ছাত্রদের স্নাতক ডিগ্রি দেয়া হয় সাতটি ছাতিম পাতা দিয়ে ( সপ্তপর্ণী) । গুনীজনকে সম্মান দেয়া হয় ছাতিম পাতা দিয়ে....।"
মুগ্ধ হয়ে শুনছি আমাদের অটোচালক কাম গাইড ইন্দ্রের কথা।অটোকে এখানে বলে টোটো। এই এলাকার লোকের বাচনভঙ্গি সম্ভবত খুব মিষ্টি। অতি সাধারন দেখতে এই গাইডের কথা শুনে আমরা বিমোহিত। কি চমৎকার করে কবিগুরুর জীবনের ঘটনাগুলি সন-তারিখসহ বলে দিচ্ছে....
শান্তিনিকেতনে পৌঁছতে প্রায় দুপুর একটা বেজে গেলো।আমাদের কলকাতার ড্রাইভারের বুদ্ধিতে এলাকাটা ঘুরে দেখতে অটোরিকশা নেই। এককাজে দুই কাজ হবে। বাহক কাম গাইড। আমাদের শান্তিনিকেতনের ১৮ টি পয়েন্ট ঘুরে দেখাবে।
"এই জায়গাটা দেখেন। মহর্ষি পথিকের বিশ্রামের জন্য করেছেন। এই অরন্যের মধ্য দিয়ে যে সকল পথচারী যেতেন, তাদের বসিয়ে ছোলা, গুড় আর জল খাওয়ানো হত। তাই এই জায়গাটার নাম দেন তিনি 'পান্থশালা'।"
"এই বিশাল বট গাছের নীচে কবি যখন শিশু ছিলেন, দুই বছর সাত মাস মাত্র বয়স, একদিন মাটি দিয়ে খেলতে খেলতে তিনি তিনটে ধাপ বানিয়ে ফেলেন। তাই মহর্ষি এই গাছের গোড়া তিন ধাপে বাঁধিয়ে দেন এবং নাম দেন 'তিন পাহাড়'।"
"এই বটগাছটা একদিন থাকবে না, বুড়ো হয়ে মরে যাবে, তাই নন্দলাল বসু গাছটিকে বাঁচিয়ে রাখতে বটগাছটির ছবি আঁকেন এবং ছবিটিকে 'সহজপাঠে'র প্রচ্ছদ করেন।"
"পাশের মাঠটিতে পৌষমেলা হত! প্রতিবছর ৭ ই পৌষ এই মেলা হয়।এই মাঠটিতে এখন স্থান সংকুলান হয় না।কবির 'হাট' কবিতাটি এই হাট নিয়েই লেখা।" প্রথম চার লাইন... বলে ইন্দ্র আবৃত্তি করে..., পরের চার লাইন লিখেছিলেন শিলাইদহে গিয়ে.... আবার আবৃত্তি!!
(আমি বাসায় ফিরে সঞ্চয়িতায় ' হাট' নামে কোন কবিতা খুঁজে পাইনি!কেউ কবিতাটি পেলে জানানোর অনুরোধ রইলো)
"এটি মৃণালিনীর ঘর।খুলনার মেয়ে ভবতারিণী ঠাকুরবাড়ির বৌ হয়ে মৃণালিনী হয়ে গেলেন।এখানে তিনি শিশুদের জন্য বিদ্যালয় তৈরী করেন... ' আনন্দপাঠ'! এই বাড়ীতেই তিনি মারা জান। 'গোরা' উপন্যাস এই বাড়ী তে বসেই লিখেছেন কবি।"
আমরা মূল ক্যাম্পাসে ঢুকতেই কিছু ছাত্রছাত্রীকে পেয়ে যাই। গেরুয়া রঙের স্কুলের পোষাক পরিবেশের সাথে খুব মিশে গেছে। ক্লাস এইট - নাইনের ছাত্র-ছাত্রী। কিছুক্ষন আলাপ করি ওদের সাথে, ছবি তুলি।
প্রকৃতি প্রেমিক সুকন্যা ঐশী Subah Tarannum বিশ্বভারতী ক্যাম্পাসে ঢুকে মুগ্ধ- আবিষ্ট! এই অসাধারন পরিবেশে পড়াশুনার সুযোগ পেলে সে বর্তে যেত মনে হয়। আমাকে বলে, আম্মু, হুমায়ুন আহমেদ হিমুর হলুদ পাঞ্জাবীর ধারনা কি শান্তিনিকেতনের এই পোষাক থেকেই পেয়েছেন?
পান্থশালা থেকে শুরু করে ঘুরতে ঘুরতে ছাতিমতলায় যাই।পাশেই শান্তিনিকেতন গৃহ।
গৃহের সামনে একটি ভাস্কর্য, বিখ্যাত ভাস্কর রামকিঙ্কর বাজের। গাইড ইন্দ্র জানায়, ভাস্কর্য টির বিশেষত্ব হল এর ছায়ায়। এটির নাম বিশ্বমাতা।মাটিতে ছায়া পড়লে বোঝা যায়, মায়ের কোলে শিশু। এখানে মা হচ্ছে বিশ্ব,আর শান্তিনিকেতন তার শিশু।
মনে মনে চিন্তা করি, গাইডের কথা সত্যি হলে, বিশ্বমাতার চারিদিকে এভাবে কেয়ারী করে গাছ না লাগিয়ে ফাঁকা রাখলেই ভালো হত,তবে ছায়া পড়লে দেখা যেত।
এখানে কৌতুহলী চোখে এক ভদ্রলোক আমাদের দেখছিলেন, বললেন, আপনারা দেখতে এসেছেন। আমাদের অফিসিয়াল গাইড আছে। আপনাদের খুব ভালোভাবে পুরো এলাকা ঘুরিয়ে দেখাবে এবং বুঝিয়ে দেবে।বললাম, আমাদের গাইড আছে। ভদ্রলোক কিছুটা দূরে দাঁড়ানো আমাদের গাইডের দিকে দৃকপাত করে হেসে ফেলেন, " ও টোটোওয়ালা"! একটু অপ্রস্তুত হই। নিজেদের অজ্ঞতা বুঝতে পারি। গম্ভীর মুখে কিছুটা দূরে হেঁটে এসে দুইবোন বকুল- আকুল পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলি। আমরা টোটোওয়ালা গাইডেই মুগ্ধ।
আরো কিছদুর এগুনোর পর দুজন ইউনিফর্ম পড়া সিকিউরিটি ধরনের লোক আমাদের 'টোটোওয়ালা' গাইডকে দেখে হেসে ফেলে( আবার!!!!), বেশ বেশ!! তোদের জন্য আমাদের পেছার ( প্রেসার)একটু কম পরে!!
বুঝতে পারি টোটোওয়ালা গাইডদের এরা সবাই চিনে। এই সকল স্বল্পশিক্ষিত স্থানীয় টোটোওয়ালারা কবিগুরুর জীবনী মুখস্থ করে ফেলেছে জীবীকার তাগিদে। এভাবে দুটোপয়সা আয় হলে মন্দ কি?
আইসক্রিমওয়ালা দেখে বুঝতে পারি গলা শুকিয়ে গেছে সবার। সবাই যারযার পছন্দমতো আইসক্রিম নিচ্ছে। আমার পছন্দ সবচেয়ে কমদামী ললি। আইসক্রিম খেয়ে জিভ কটকটে সবুজ বা কমলা করে ফেলায় আমার ছেলেমানুষি আনন্দ। আইসক্রিম ওয়ালা আমাদের প্রত্যেকের আইসক্রিম খুলে দিয়ে প্যাকেটগুলি আইসক্রিম গাড়ীর সাথে ঝুলতে থাকা একটা আলাদা পলিথিনে রাখলেন।বুঝতে পারি,এলাকাটা কেন এত ঝকঝকে পরিষ্কার! শান্তিনিকেতন পলিথিনমুক্ত।
সামনে এগিয়ে যাই। বনবিভাগ। গাছপালা দিয়ে চমৎকার গেইট বানানো, ছোট্ট একটা বিল্ডিং। জগদীশ চন্দ্র ভবন। ক্যাম্পাসে ঢোকার মুখে দেখেছি
" জীবক মেডিকেল সেন্টার"!
এখানে প্রতিটা জিনিষই অর্থপূর্ণ। ইতিহাস- ঐতিহ্য কে ধারন করে আছে।
আম্রকুঞ্জে প্রতিটা আমগাছই একটা ক্লাসরুম।গাছের নীচে বসার জন্য একটা ছোট সিমেন্ট দিয়ে তৈরী বেদী,যেখানে শিক্ষক বসবেন।
আসন ঘিরে চারিদিকে বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গা তিন- চার ইঞ্চি উচ্চতার ঘের দেয়া, কিছুটা ডি বক্সের মত। খোলা আকাশের নীচে ক্লাসরুম!! কি অসাধারন ধারনা!! সক্রেটিস এভাবে খোলা আকাশের নীচে ক্লাস নিতেন!!
ঘন্টাতলা,সিংহভবন... প্রত্যেকেরই আছে একটি করে গল্প। দেখতে দেখতে এগিয়ে যাই।
রঙিন কাঁচঘেরা সাদা দৃষ্টিনন্দন ঘরটি উপাসনা গৃহ।প্রতি বুধবার সকাল ছয়টায় এখানে প্রার্থনা হয়। যে কোন ধর্মের লোক অংশগ্রহণ করতে পারে। শুধু সাদা পোষাকে, খালি পায়ে আসতে হবে।
তালধ্বজ!! একটি তালগাছকে কেন্দ্র করে গোলাকার খড়ের ছাউনির একটি মাটির ঘর। ইন্দ্র জানালো, এই তালগাছ দেখেই কবিগুরু লিখেছিলেন... তালগাছ একপায়ে দাঁড়িয়ে....!! আমার মুগ্ধ হওয়ার ক্ষমতা অসীম। হা করে তাকিয়ে থাকি।আকাশমুখী তালগাছটাকে মনে হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে সৌভাগ্যবান সুখী তালগাছ।হঠাৎ মনে প্রশ্ন জাগে,তালগাছ কতদিন বাঁচে!!
পরে শুনেছি, শান্তিনিকেতন এর নিয়ম হচ্ছে,কোন গাছ মারা গেলে সেখানে সেইগাছের আরেকটি; চারা রোপন করা হয়। সেজন্যেইতো ছাতিমতলায় এখনো ছাতিম গাছ আছে।
বিখ্যাত প্রকৃতিবিদ শিক্ষক তেজেসচন্দ্র সেন তালধব্জে বাস করতেন
টিকেট কেটে ঢুকি সেই অংশে যেখানে কবি তার জীবনের একটা বড় অংশ কাটিয়েছেন। কবিভবন- উত্তরায়ণ! রবীন্দ্রভবন এখন মিউজিয়াম।ছোটবেলা থেকে জানি মিউজিয়াম এর বাংলা জাদুঘর। এখানে দেখলাম নতুন শব্দ ; পরিদর্শশালা আরো দুটি বাংলা শব্দ দেখলাম অবেক্ষক;অভিলেখাগার! এই শব্দদুটির ইংরেজী পড়ে বলব।ছোটবেলায় অপ্রচলিত বাংলা শব্দ শিখলে ভাইবোনরা একে অপরের কাছে গিয়ে পান্ডিত্য জাহির করতাম, বলতো টেবিল বাংলা কি! চেয়ার বাংলা কি!!থিসিস বাংলা কি!!!অনেকদিন পর সেই সুযোগ জুটলো..!!
পরিদর্শশালায় ঢুকে একটি ঘন্টা কোনদিক দিয়ে চলে গেলো টের পেলাম না। দোতলায় ঢোকার মুখেই কাঁচের শোকেসে একটি রুদ্রবীণা রাখা! রুদ্রবীণার ঝংকারেতে....;হেমন্তের গান শুনে ভেবেছি বীণা বুঝি রুদ্র সুরে বাজছে। অনেক পরে জেনেছি যে রুদ্রবীণা আসলে একটি মিউজিকাল ইন্সট্রমেন্ট... বীণার আরেক রূপ।মিউজিয়ামে কয়েকবছর যাবত নতুন যোগ হয়েছে নোবেল পুরষ্কার সংক্রান্ত বিভাগ গীতাঞ্জলী গ্যালারী । গীতাঞ্জলী বা সং অফারিংস এ মোট ১৫৭ টি কবিতা আছে, যার ৮৪ টি গীত হিসাবে গাওয়া হয়.., দেয়াল জুড়ে ছবি- লেখা... রবিময়!!! মৃদুমন্দ লয়ে রবীন্দ্রসংগীত এর সুরে সুরে ঘুরে ঘুরে সময়টা যেন মুহুর্তেই শেষ হয়ে গেল।
শান্তিনিকেতনে আসব শুনে রোজী ভাবী বলে দিয়েছিলো,আকুল,তুমি আমার হয়ে শ্যামলী ছুঁয়ে এসো।বাংলার ছাত্রী,লেখিকা ভাবীর আবেগটা বুঝতে পারি। এখানে পা দিয়ে গাইডকে প্রথমেই জিজ্ঞাসা করেছি, শ্যামলী কোথায়!!
উত্তরায়ন অংশটি পাঁচটি বাড়ীর সমন্বয়।উদয়ন,কোনার্ক,শ্যামলী,পুনশ্চ,উদীচী ।
উদয়ন থেকে শুরু করে বামদিক থেকে কিছুটা অর্ধবৃত্তাকারে ঘুরে আসলে এই ধারাবাহিকতা থাকবে। বাড়ীগুলো খুব বড় নয়। বাংলোবাড়ী ধরনের। কিন্তু প্রতিটি বাড়ীর ডিজাইনে ভিন্নতা আছে, আছে শিল্পের ছোয়াঁ। প্রকৃতি ছুঁয়ে থাকা এই প্রতিটি বাড়ীতে কবিগুরু জীবনের একটা বড় সময় থেকেছেন।
উদয়ন প্রথমেই। সবচেয়ে বড়,দোতলা।বাড়ীটির স্থাপত্য-ডিজাইনে কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথের পরীক্ষানিরীক্ষা আছে।জাপানী স্থপতিদের সহায়তা নিয়েছিলেন তিনি। দোতলার কামরা গুলি নাকি সব বিভিন্ন সমতলে অবস্থিত ! এখন ভিতরে ঢুকতে দেয়না! আফসোস!!দেখতে পেলাম না। বাড়ীটির সামনে একতলায় কয়েকধাপ প্রশস্ত সিঁড়ি পার হয়ে ছোট বারান্দা! তারপর দরজা মাঝখানে, দুইপাশে বড় দুটি জানালা। দরজা বন্ধ, জানালা খোলা। একজন সিকিউরিটি গার্ড বসে আছে বারান্দায়। বারান্দায় উঠতেই সতর্ক করল, ছবি তোলা নিষেধ। জানালা দিয়ে ঘরের মধ্যে তাকাতেই একরাশ মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ে দেহমনে।
????
একটি পরিপাটি গোছানো বসার ঘর...। একপাশে একটি গ্রান্ড পিয়ানো। সাধারন সামগ্রী দিয়ে এমন অনবদ্য সুন্দর করে সাজানো বসার ঘর দেখার সৌভাগ্য আমার আগে কখনো হয়নি। অপূর্ব নান্দনিকতার ছোঁয়া, রুচী আর শিল্পের দুর্লভ যুগলবন্দী!! কল্পনায় পিছনে ফিরে যাই।সেখানে কবিগুরু বসে আছেন সামনের সোফাটিতে। বাঙালি রেনেসাঁ র কুশীলবরা তাকে সংগ দিচ্ছেন ।ঘরটির মাঝামাঝি অবস্থানে , বিছানা ও কুশন দিয়ে সাজানো নিচু ডিভানটিতে বসে সংগীত পরিবেশন করছেন কোন বিখ্যাত শিল্পী।প্রতিমা দেবী জলখাবারের দায়িত্বে..
ঐশী দূরে গাছপালার ছবি তোলায় ব্যস্ত। ডেকে আনি, দ্যাখ... ড্রইংরুম!! ও মুগ্ধকন্ঠে বলে... এত সুদিং.. আম্মু!!!
কোনার্ক উত্তরায়নের প্রথম বাড়ী।আসলে এটাই আদি উত্তরায়ন। এই বাড়ীটির সামনের অংশে একটি রুমের মত,যার উপরে ছাদ,চারপাশে পিলার। কোন দেয়াল নেই।কবিগুরু এখানে বসে যখন লিখতেন, তখন তার দৃষ্টিসীমায় থাকত অসীম আকাশ আর অবারিত প্রকৃতি।
তারপর বহুকাংখিত শ্যামলী। শ্যামলী সম্পূর্ণ মাটির তৈরী ঘর। এই ঘরটির স্থাপত্যশৈলী তে কবি নিজে পরীক্ষানিরীক্ষা করেছেন।ভিতরের একটি ঘরের ছাঁদে মাটির কলসি ঝুলানো হয়েছে, ঘর শীতল করার জন্য।ঘরের দেয়াল ও প্রবেশপথে রামকিঙ্কর বাজের সাঁওতালদের নিয়ে তৈরী রিলিফ দিয়ে সজ্জিত। এসবই পরে জেনেছি। এই মাটির ঘরই শ্যামলী ই হবে মর্ত্যলোকে তাঁর শেষ আশ্রয়, কবি সেরকম ইচ্ছা পোষন করলেও, বাস্তবে তা হয়নি। কবির শেষদিনগুলি কেটেছে উদয়নে।
শ্যামলীর কাছে গিয়ে হতাশ হই। সংস্কারের কাজ চলছে। তাই প্রবেশ নিষেধ।বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘিরে রাখা বাড়ীটিকে উঁকিঝুঁকি দিয়ে
দেখার চেষ্টা করি। ভাবীকে দেয়া কথা রাখতে পারলাম না।
শ্যামলীর পরে যখন আরো একটি বাড়ী তৈরী করা হলো, কবি সেটার নামকরন করলেন ' পুনশ্চ '! ছোট্ট একতলা বাড়ী। সামনে খোলা বারান্দা। ভিতরে প্রবেশ করা যায় এই বাড়ী গুলোতে। কবির ব্যবহৃত কিছু পুরানো আসবাবপত্র আছে কক্ষগুলোতে।
উদীচীর নাম প্রথমে রাখা হয়েছিলো সেঁজুতি। পরে পূর্বদিকে অবস্থিত বলে নাম বদলে উদীচী রাখা হয়। এই বাড়ীটিও দোতলা। তবে দোতলায় উঠার সিঁড়ি টি বাড়ীর বাইরের দিকে।
কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথের চিত্রভানু ও গুহাঘর, প্রতিমা দেবীর পম্পা সরোবর!! কবি ও তাঁর পরিবারের স্মৃতিধন্য এদিকটা পুরোই দর্শনার্থীদের জন্য সংরক্ষিত। বিশ্ববিদ্যালয় মূল কার্যক্রম ক্যাম্পাসের অন্যদিকে।
এখানে আসা অবদি দেখছি মেয়েরা দিব্যি সাইকেল চড়ে ঘুরছে। শাড়ী, সালোয়ার কামিজ, ফতুয়া, হিজাব.. পোশাক যাই হোক, কুছ পরোয়া নেহি। কোন জড়তা নেই। সব ক্যাম্পাসেই যদি মেয়েরা এভাবে সাইকেল চালাতে পারতো!!
বিশ্বভারতী :
ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠার পুরোধা ব্যক্তিত্ব মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬৩ সালে বীরভূম জেলার বোলপুরে একটি জায়গা কিনে উপাসনার জন্য আশ্রম তৈরী করেন। পাশেই বসবাসের জন্য 'শান্তিনিকেতন গৃহ 'নামে একটি বাড়ী তৈরী করেন তিনি। বীরভূমের রুক্ষ লাল কাঁকর মাটিকে উর্বরা করার জন্য তিনি বাড়ীর চারিদিকে বিশাল বিশাল গর্ত করে, উর্বর পলিমাটি এনে গর্তপূরন করে গাছ লাগান। এভাবে তিনি বাড়ীর চারিদিকে ফল ও ছায়াবৃক্ষের এক বাগান গড়ে তোলেন। ধীরে ধীরে এলাকাটির নাম শান্তিনিকেতন হয়ে যায়।বাবার সাথে ছোটবেলা থেকেই রবি এখানে এসে থাকতেন। ১৮৮৮ সালে মহর্ষি পুত্রকে 'ব্রহ্মচর্যাশ্রম' নামের প্রথাবিরোধী বিদ্যালয় স্থাপনের জন্য জায়গাটি দান করেন।বিদ্যালয়টি ছিল তদানীন্তন ভারতে ব্রিটিশদের প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি কবির সচেতন বর্জন এবং প্রাচীন শিক্ষাপদ্ধতিকে পুনঃ স্থাপনের পরীক্ষা- নিরীক্ষা। ইটপাথরের শ্রেনিকক্ষে বসে মোটা মোটা বই পড়ে শিক্ষিত হওয়াকে তিনি অসম্পূর্ণ শিক্ষা মনে করতেন।
১৯০১ সালের ডিসেম্বরে এই বিদ্যালয়টি আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে।
১৯২৫ সালে বিদ্যালয়টি 'আনন্দপাঠ' নামে পরিচিত হয় এবং পরে এই ছোট বিদ্যালয়টি বর্তমানের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিনত হয়।আদর্শবানী ( motto) হিসাবে কবি পছন্দ করেন সংস্কৃতি শ্লোক " যত্র বিশ্ব ভবতিকা নীদম", যার অর্থ, " সমগ্র বিশ্ব যেথা মেলে এক নীড়ে "!
এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে,সরলতা- সহজতা এবং প্রকৃতির খুব কাছে থেকে শিক্ষা! খোলা আকাশের নীচে ক্লাশ সম্ভবত কবিগুরুর সবচেয়ে বড় সাহসী প্রথাবিরোধী অভিক্রিয়া!
শান্তিনিকেতনের রুক্ষ লাল কাঁকর ভূমি এখন অজুত- নিযুত বিচিত্র বৃক্ষ রোপণের ফলে সবুজ- সতেজ - বর্ণিল ।প্রতিটি ঋতুর আগমন ও প্রস্থানের বৈচিত্র্য সুস্পষ্টভাবে প্রত্যক্ষ করা যায় এখানে।
বিকেল হয়ে গেছে। এবার ফেরার পালা।স্বল্প সময়ের জন্য এসে অনেক কিছু দেখা বাকী রয়ে গেলো...!!
সুপ্রিয় বন্ধু দম্পতি রাজীব- রুনা ঠিক করেছে শান্তিনিকেতনে একটি বাড়ী বানাবে। আমি সেখানে আগাম একটা কামরা বুকিং দিয়েছি।
আমাকে যে আবার আসতে হবে । নিজেকে কথা দিয়েছি।এখানে রয়েছে মনের আরাম, প্রানের আনন্দ, আত্মার শান্তি।
পুনশ্চ :
কিউরেটর -- অবেক্ষক
আর্কাইভ ---অভিলেখাগার
___________________________
ডা. ফরিদা ইয়াসমিন । সুলেখক।
Asstt. Professor at Dhaka Dental College & Hospital
Studied MBBS. at Chittagong Medical College
আপনার মতামত দিন: