Ameen Qudir

Published:
2018-03-17 17:38:11 BdST

বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন আজ


 

ডা.কামরুল হাসান সোহেল
_______________________________

১৭ ই মার্চ ১৯২০ সালে ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জে তাঁর জন্ম । বাবা শেখ লুৎফর রহমান এবং মাতা সায়েরা খাতুন সহ ছয় ভাই-বোন এর মধ্যে তিনি ছিলেন বাবা-মায়ের তৃতীয় সন্তান। ১৯২৭ সালে শেখ মুজিব গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু করেন যখন তার বয়স সাত বছর। নয় বছর বয়সে গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে ভর্তি হন । তার শিক্ষাজীবন কৃতীত্বপূর্ণ না হলেও ছোট বেলা থেকেই তার মানবীক গুণাবলীর প্রকাশ লক্ষ্য করেন তার আশেপাশের সবাই । ১৯৩৮ সালে অর্থাৎ মাত্র আঠারো বছর বয়সে তার সাথে বেগম ফজিলাতুন্নেসার বিয়ে হয়।

ছোটবেলা থেকেই পরিবারে তার নাম ছিলো খোকা। খোকা বলে সবার কাছে যে পরিচিত ছিলো একদিন সেই খোকাই জাতির পিতা কিংবা বঙ্গবন্ধু হিসেবে দেশবাসীর কাছে পরিচিত হবে তা স্বয়ং শেখ মুজিবও হয়তো কল্পনা করতে পারেন নি।১৯৩৯ সালে মিশনারি স্কুলে পড়ার সময় বাঙালি মুসলিম নেতা হুসেইন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সান্নিধ্যে এসে তিনি রাজনীতিতে যোগদান করেন। ১৯৪৩ সালে তিনি বেঙ্গল মুসলিম লীগে যোগ দেন তিনি। তিনি ১৯৪৩ সালে বঙ্গীয় মুসলিম লীগের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন।

মুজিব কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইসলামিয়া কলেজ থেকে বিএ পড়াকালীন সময়ে দেশ বিভাগ হয় এবং এরপরেই দেশে দ্বি-জাতিত্বের কারণে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা শুরু হয়। পরবর্তীতে তিনি তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানে ফিরে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে পুনরায় পড়াশোনা শুরু করেন। ১৯৪৮ সালের জানুয়ারি ৪ তারিখে প্রতিষ্ঠা করেন পুর্ব-পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। যার দ্বারা তিনি অন্যতম একজন ছাত্র নেতা হিসেবে রূপান্তরিত হন।

দেশ ভাগের পরবর্তী সময়েই পশ্চিমা শাসকগণ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে খ্যাতি দিতে বিরূপ মনোভাব প্রদর্শন করেন। যখন ১৯৪৮ সনের ফেব্রুয়ারি ২৩ তারিখে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন গণ-পরিষদের অধিবেশনে বলেন যে, ‘উর্দূই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’। তখন ছাত্র নেতা মুজিব সহ অন্যান্য ছাত্রগণ আন্দোলনে লিপ্ত হলে শেখ মুজিবসহ আরও কয়েকজন রাজনৈতিক কর্মীকে সচিবালয় ভবনের সামনে থেকে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু ছাত্রসমাজের তীব্র প্রতিবাদের মুখে ১৫ মার্চ শেখ মুজিব এবং অন্য ছাত্র নেতাদেরকে মুক্তি দেয়া হয়।

শেখ মুজিব খুব দ্রুততার সাথে খ্যাতি অর্জন করতে থাকেন। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দিন ঘোষণা করেন, উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে। এ ঘোষণার পর জেলে থাকা সত্ত্বেও মুজিব প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ আয়োজনে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। জেল থেকে নির্দেশনা দেয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদকে পরিচালনায় তিনি ভূমিকা রাখেন। এরপরই ২১ ফেব্রুয়ারিকে রাষ্ট্রভাষার দাবী আদায়ের দিবস হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। একই সময়ে শেখ মুজিব জেলে থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে অনশন পালনের সিদ্ধান্ত নেন। তার এই অনশন ১৩ দিন কার্যকর ছিল। ২৬ ফেব্রুয়ারি তাকে জেল থেকে মুক্তি দেয়া হয়।

১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের ৯ জুলাই তিনি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনের শেষে দলের মহাসচিব নির্বাচিত হন। ১৪ নভেম্বর সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য অন্যান্য দল নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১৯৫৪ সালের ১০ মার্চ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট ২৩৭ টি আসনের মধ্যে ২২৩ টিতে বিপুল ব্যবধানে বিজয় অর্জন করে যার মধ্যে ১৪৩ টি আসনই আওয়ামী লীগ লাভ করেছিল। শেখ মুজিব গোপালগঞ্জে আসনে ১৩,০০০ ভোটের ব্যবধানে বিজয় লাভ করেন। সেখানে তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল শক্তিশালী মুসলিম লীগ নেতা ওয়াহিদুজ্জামান। ১৫ মে তাকে কৃষি ও বন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়। ২৯ মে কেন্দ্রীয় সরকার যুক্তফ্রন্ট ভেঙে দেয়।

শেখ মুজিব তার জীবনের প্রায় অর্ধেকটা সময় কাটান জেল-খানায় বন্দি জীবন যাপন করে। তবুও তিনি এই দেশের মানুষের মঙ্গল কামনা থেকে তিনি তার জীবনকালে বিরত থাকেন নি। সবসময়ই তিনি বাংলার মানুষের অধিকার আদায়ের জন্যে লড়াই করে গেছেন।

তেমনি, ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে বিরোধী দলসমূহের একটি জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনেই শেখ মুজিব তার ঐতিহাসিক ‘ছয় দফা দাবী’ পেশ করেন যাতে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্ত্বশাসনের পরিপূর্ণ রূপরেখা উল্লেখিত হয়েছিল। শেখ মুজিব এই দাবীকে “আমাদের বাঁচার দাবী” শিরোনামে প্রচার করেছিলেন। এই দাবীর মূল বিষয় ছিল একটি দুর্বল কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে পরিচালিত পাকিস্তানী ফেডারেশনে পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্ত্বশাসন। এই দাবী সম্মেলনের উদ্যোক্তারা প্রত্যাখান করেন এবং শেখ মুজিবকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে চিহ্নিত করেন। এ কারণে তিনি উক্ত সম্মেলন বর্জন করে পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে আসেন। মার্চ মাসের এক তারিখে শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। এই নির্বাচনের পর তিনি ছয় দফার পক্ষে সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে দেশব্যাপী অভিযান পরিচালনা করেন। এবং একই সালে তাকে সেনাবাহিনী কারাবন্দী করে রাখেন।

দুই বছর জেলে থাকার পর, ১৯৬৮ সালে যখন তিনি জেল থেকে মুক্তি পেলেন তখন, শেখ মুজিবসহ আরো অনেকে পাকিস্তানের মূখ্য ব্যাক্তিত্বদের উপর কমান্ডো পদ্ধতিতে হামলা চালিয়ে তাদের হত্যা করে পূর্ব-পাকিস্তানকে স্বাধীন করার পরিকল্পনা করেন। যা পরবর্তী সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানের মাথারা জানতে পেরে মুজিবসহ আরো ৩৪জন রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্বের নামে মামলা দায়ের করেন। যা ইতিহাসের পাতায় ‘আগোরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ নামে বিখ্যাত। কিন্তু এদেশের মানুষের তীব্র আন্দোলনে পরবর্তী সময়ে এই মামলা প্রত্যাখ্যান করতে বাধ্য হন শাষকগণ।

১৯৬৯ সালের জানুয়ারি ৫ তারিখে কেন্দ্রিয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ তাদের এগার দফা দাবী পেশ করে যার মধ্যে শেখ মুজিবের ছয় দফার সবগুলোই দফাই অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই পরিষদের সিদ্ধান্তক্রমে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের দাবীতে দেশব্যাপী ছাত্র আন্দোলনের প্রস্তুতি গৃহীত হয়। এই সংগ্রাম এক সময় গণ আন্দোলনে রূপ নেয়। এই গণ আন্দোলনই ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান নামে পরিচিত।

১৯৬৯ সালে সংঘটিত আন্দোলনে প্রভাবিত হয়ে দেশের তৎকালীন কেন্দ্রিয় সরকার সাধারণ নির্বাচন দেতে বাধ্য হয়। এবং ১৯৭০ সালে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে জানান সরকার। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ প্রাদেশিক আইনসভায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। পূর্ব পাকিস্তানের কোটার ২ টি আসন ছাড়া বাকি সবগুলোতে জয়ী হওয়ার জন্য জাতীয় সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠতাও অর্জন করে আওয়ামী লীগ। নির্বাচনের ফলাফল পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে মেরুকরণ সৃষ্টি করে। পশ্চিম পাকিস্তানের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের নেতা জুলফিকার আলি ভুট্টো, মুজিবের স্বায়ত্বশাসনের নীতির প্রবল বিরোধিতা করেন। ভুট্টো এ্যাসেম্বলি বয়কট করার হুমকি দিয়ে ঘোষণা দেন যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান মুজিবকে সরকার গঠনের জন্য আহ্বান জানালে তিনি সে সরকারকে মেনে নেবেন না। রাজনৈতিক অস্থিশীলতার মধ্যে ইয়াহিয়া খান সংসদ ডাকতে দেরি করছিলেন। বাঙালিরা এতে বুঝে ফেলে যে, মুজিবের দলকে সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও সরকার গঠন করতে দেয়া হবে না।

অবশেষে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিব দেশের মানুষকে স্বাধীনতার আহ্বান জানান। তিনি দেশকে স্বাধীন হিসেবে বর্ণনা করেন। এবং ভবিষ্যৎ দেশের নামও তিনি এইদিন ঠিক করেন। যা আজকের এই সময়ে বাংলাদেশ বলে পরিচিত। তিনি বলেন, “তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। মনে রাখবা, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম”। তিনি এই কথার দ্বারা দেশের মানুষকে সরাসরি স্বাধীনতা আন্দোলনে যুক্ত হবার আহ্বান জানান। ৭ই মার্চের এই ভাষণকে অনেক সাহিত্যিকই কবির অমূল্য বাণী বলে প্রকাশ করেছেন। এখানে কবি হলেন শেখ মুজিব।

অপর প্রান্তে ইয়াহিয়া খান অপারেশান সার্চলাইটের পরিকল্পনা নিয়ে ব্যাস্ত ছিলেন তখন। ২৫শে মার্চ তিনি পূর্ব বাংলার মানুষের উপর আক্রমণ নিয়ে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের শেষধাপ যখন প্রায় সম্পন্ন করেছেন তখনই পশ্চিম পাকিস্তানের মিলিটারি আমাদের সাধারণ-নিরীহ মানুষের উপর ঝাপিয়ে পড়ে তাদের নির্মম হত্যা করে। এমন সময় ২৫শে মার্চ শেষ প্রহরে শেখ মুজিব ওয়্যারলেস যোগে স্বাধীনতার শেষ ঘোষণা দিয়ে দেশের মানুষকে যুদ্ধে লিপ্ত হতে আহ্বান জানান। সেদিন রাতেই মুজিবকে আটক করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয় এবং ফয়সালাবাদের একটি জেলে কড়া নিরাপত্তায় রাখা হয়।

জেলে থাকাকালীন সময়েই তার নেতৃত্বে দেশের মানুষের মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়। যা স্বাধীনতা আন্দোলনকে পরিপূর্ণ রূপদান করার জন্যে বিশ্বের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করতে ছড়িয়ে পড়ে। এই সরকারের রাষ্ট্রপতির পদ দেয়া হয় স্বয়ং শেখ মুজিবুর রহমানকে। এবং এরই দ্বারা তিনি হয়ে ওঠেন দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি।

১১ জানুয়ারী ১৯৭২ লাখো মানুষ ঢাকা এয়ারপোর্ট স্টেডিয়ামে বঙ্গবন্ধুর আবেগঘন বক্তব্য শোনার জন্য উপস্থিত হয়েছিলেন।

দেশের মানুষের অসামান্য আত্মত্যাগের দ্বারা বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয় তখন চারদিকে চরম দূর্ভোগ সৃষ্টি হয়। ১৯৭২ সালের ১০জানুয়ারি মুজিব দেশে ফিরে আসলে তাকে দেশের জনগণ বঙ্গবন্ধু খেতাবে ভূষিত করেন। এবং দেশে ফিরেই তিনি দেশের এই বেহাল দশা কাটিয়ে উঠতে দেশে সরকার গঠন করেন। এবং মুজিব সরকার ১০ মাসের মাথায় খসড়া সংবিধান প্রণয়ন করেন। দেশের স্বার্বিক উন্নয়ন দ্রুত সম্পন্ন হতে থাকে। বঙ্গবন্ধুর এই কাজকর্মদ্বারা তিনি দেশের মানুষের কাছে জাতির পিতা হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট তারিখে কিছু সংখ্যক সেনা সদস্য মুজিবের ধানমন্ডির বাড়িতে ঢুকে নির্মমভাবে সপরিবারে হত্যা করে। এবং এরই দ্বারা জীবনাবসান হয় মুজিব, জাতির পিতা, বঙ্গবন্ধু নামধারী এই মানুষের। যিনি বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা। এবং আমরা সেই দুস্কৃতিকারী যারা নিজের হাতে দেশের জন্মদাতাকে হত্যা করেছি।
____________________________

ডা.কামরুল হাসান সোহেল
আজীবন সদস্য, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ , কুমিল্লা জেলা।
কার্যকরী সদস্য স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ
আজীবন সদস্য,বিএমএ কুমিল্লা।
সেন্ট্রাল কাউন্সিলর, বিএমএ কুমিল্লা

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়