Ameen Qudir

Published:
2017-12-09 18:00:47 BdST

নারীর নিরাপত্তাঃ কোন অন্ধকারের পথে প্রিয় স্বদেশ?


 

 

 

 

 

 

 

 

 

ডা. রাজীব দে সরকার, ঢাকা।
_____________________________

 

 

"রান্ধি বাড়ি যেবা নারী, পুরুষের আগে খায়,
ভরা কলসীর জল তার তরাসে শুকায়"

নাহ, সেই বাংলাদেশে আজ আর আমরা দাঁড়িয়ে নেই।

​বাংলাদেশের গত ৪৬ বছরের ইতিহাসে প্রায় সকল ক্ষেত্রেই নারীরা সফলতার স্বাক্ষর রেখেছেন। আরো গুছিয়ে বললে বলতে হয়ে 'ছাড়িয়ে গেছেন পুরুষদের'। ভাই এর সঙ্গে বোন, প্রেমিকের সঙ্গে প্রেমিকা, নেতার সঙ্গে নেত্রী, অভিনেতার সঙ্গে অভিনেত্রী, গায়কের সঙ্গে গায়িকা, নায়কের সঙ্গে নায়িকা আজ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছেন।


ভোটাধিকারে সাম্য আছে নারীর। সংসদের সংরক্ষিত আসন থেকে রাজপথ সর্বত্রই নারীদের জয়যাত্রা সুস্পষ্ট। বিশ্বের ১৯৫টি স্বাধীন রাষ্ট্রের মাত্র ১৭টি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান নারী। সেই ১৭টি দেশের একটির নাম বাংলাদেশ। ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী শ্রমশক্তির প্রতি ১০০ জন বাংলাদেশীর মধ্যে ৪৭ জন পুরুষ এবং ৫৩ জন নারী। সারা বিশ্বের সকল দেশের সংসদ সদস্যদের মধ্যে মাত্র ২০ ভাগ নারী সংসদ সদস্য। সেদিক থেকে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে নারীদের উপস্থিতি ঈর্ষণীয় ও অনুকরণীয়। অনেক দূর এগিয়ে গেছে প্রিয় মাতৃভূমি।

অথচ সেই অনুকরণীয় দৃষ্টান্তের দেশের পত্রিকায় সেদিনও পড়লাম চট্টগ্রামে গণপরিবহনে ২৪ বছর বয়সী এক গার্মেন্টস কর্মী তরুণীর গণধর্ষনের খবর। কিছুদিন আগেই পড়লাম টাঙ্গাইলের রূপার কথা।

কোন সড়কে ছুটছে আমাদের সভ্যতা কিংবা সভ্যতাকে আমরা কোন গন্তব্যে নিয়ে যাচ্ছি?

আমরা তো অকার্যকর রাষ্ট্র পাকিস্তান নই। প্রায় সকল সেকটরে সফল হওয়া একটি রাষ্ট্রের আজো কেন নারীর নিরাপত্তা ইস্যুতে মুখ লুকাতে হবে? গণপরিবহনগুলো আজো কেন নারীদের জন্য নিরাপদ হতে পারছে না? অথচ নারীদের কর্মযজ্ঞে রাষ্ট্র পড়ছে সাফল্যের মুকুট।

টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলা অতিক্রমের সময় রাত ১০টার দিকে বাসের হেলপাররা মিলে চলন্ত বাসে রূপা নামের একটি স্বপ্নকে শেষ করে দিলো অবলীলায়। ন্যাশনাল জিওগ্রাফি চ্যানেলে যেভাবে ঘাড় মটকে সিংহ হরিণ শাবককে হত্যা করে, ধর্ষণের পর তেমনি ঘাড় মটকে রূপার গল্পের সমাপ্তি ঘটান এই বাংলাদেশেরই কিছু পশু। যতোটুকু ক্ষতি রূপার হলো, তার চেয়েও ঢের বেশী সর্বনাশ হলো একটি দেশের, একটি সমাজের, একটি প্রজন্মের, একটি ইতিহাসের। নারীর ক্ষমতায়নের এই সুপ্রশস্ত জোয়ারে রূপা হয়ে থাকলো আমাদের জন্য একটি তৃষ্ণার্ত এক মরুভূমির গল্প।

এই দেশে কোটিপতির মেয়ে ধর্ষিত হয়েছে, গরীবের মেয়েও ধর্ষিত হয়েছে। ছিন্নমূল অভাবী নারী থেকে সন্তানের জননী নারী - এই ধর্ষণ মহোৎসব থেকে বাদ যায় নি কেউ। অথচ আমরা সভ্য হয়েছি। পকেটে আমাদের অ্যান্ড্রয়েড মুঠোফোন, কন্ঠে আমাদের জগৎ ভোলানো ইংরেজী উচ্চারণ, চোখে আমাদের ব্র্যান্ডের গগলস, অথচ মনে সেই নোংরা-স্যাঁতস্যাঁতে গহীণ অন্ধকার অরণ্য।

অন্ধকারে যেমন বোঝা যায় না, ঘুমিয়ে আছি না জেগে আছি, আমরা কী তেমন কোন অন্ধকারে ক্রমশঃ অন্তরীন হচ্ছি?

নারী নিরাপত্তার এই ক্রান্তিলগ্নে আমাদের প্রতিবাদের মুখগুলো কেন যেন ফেসবুকেই আটকে যাচ্ছে। আমরা ইভেন্ট খুলি, রিঅ্যাকশন দেই, লাইক দেই, শেয়ার করি, উহু আহা করেই বুঝিয়ে দেই আমরা প্রতিবাদী। অথচ আমরা পরিবর্তনে অংশ নেই না। শিক্ষা নেই না। ইতিহাসকে স্মরণ করি না।

সোশ্যাল মিডিয়ার দুষ্টচক্রে আড়ষ্ট হয়ে ক্রমাগত নিজেদের দায় এড়িয়ে চলছি। এই সিম্পটমটির ফলাফল ভয়াবহ ও সুদূরপ্রসারী। সাপকে না মেরে শুধু সাপের মাথায় বাড়ি দিয়ে সাপের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া কতোটুকু বুদ্ধিমানের কাজ?

এক গভীর তমাল তমশার দিকে গোটা জাতি ছুটছে। গতি মন্থর হবার কোন সম্ভাবনা কী দেখছে রাষ্ট্র নিজে?

ঈশপের একটা গল্প দিয়ে শেষ করি।

অন্ধদের ঘ্রাণ শক্তি বা স্পর্শ একটু প্রখর হয়। তো এরকম একজন অন্ধ মানুষ ছিলো। তার একটা বিশেষ গুণ ছিল। যে কোন প্রাণীর গায়ে হাত বুলিয়ে সে বলে দিত পারত সেটি কোন প্রাণী।

এ কথা জানার পরে একজন একদিন একটা নেকড়ের ছানা এনে তার হাতে দিল। একটা পরীক্ষা নেবেন ঐ আগন্তুক। প্রাণীটার গায়ে হাত বুলিয়ে ঐ অন্ধকে বলে দিতে হবে ঠিক কোন জানোয়ার বাচ্চা সেটা।

অন্ধ লোকটি প্রাণীটির গায়ে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে পরীক্ষা করলো। অনেক্ষণ পরীক্ষা করলো।

পুরোপুরি নিশ্চিত হতে না পেরে ঐ অন্ধ বললেন, “বুঝতে পারছি না ঠিক কোন জন্তুর বাচ্চা এটা – শিয়ালের না নেকড়ের। কিন্তু এই ব্যাপারটায় আমার কোন সন্দেহ নেই যে, এটাকে ভেড়ার পালের মধ্যে ছেড়ে দিলে ভেড়াগুলোর বিপদ হয়ে যাবে।"

প্রিয় বাংলাদেশ,
নেকড়ে গুলোকে চেনার সময় হয়েছে। নিজেদেরকে সচেতন করে প্রতিটি নারীর নিরাপত্তার দায়িত্ব হাতে নেবার সময় হয়েছে।

নচেৎ সমস্ত রাষ্ট্রজুড়ে নেমে আসবে "মাটির নিচের গাঢ় তমাল তমশা"

আমরা কী সেই অন্ধকারের অপেক্ষায় আছি?

 

________________________________

 

ডা. রাজীব দে সরকার


___________________________

​চিত্র কৃতজ্ঞতাঃ শুভাশিস দে সরকার​

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়