Ameen Qudir

Published:
2017-09-05 18:18:29 BdST

রোগী কথনফার্মেসি ম্যান যখন ডাক্তার


 

 


ডা. ছাবিকুন নাহার
____________________________

পারুল, আমার এক পেসেন্ট। ২৪/২৫ বছরের চটপটে তরুণী। তিন তিনটা মেয়ের মা। সর্বশেষটা ১২মাসের।


দারিদ্রতার কষাঘাত তার লাবন্যে চির ধরালেও ঝকঝকে হাসিকে ম্লান করতে পারে নি। যখনি আসবে পলিথিনের কোনায় করে দুটো কঁচি লাউয়ের ডগা অথবা ছোট্ট একটা লাউ তার পাশে থাকবেই। যখন কিছু পায় না তখন নিদেন পক্ষে দু মুঠো হেলেঞ্চা শাঁক হলেও আমার জন্য নিয়ে আসে।


সহকারীরা বলে, সে নাকি ভিজিট না দেয়ার জন্য এটা করে!! আমি কৃতজ্ঞ বোধ করি। টাকার হিসেবে এর দাম মাপার স্পর্ধা আমার হয় না।
একদিন দুঃখ করে বলছিলাম, বাসার কাজের সহকারী দরকার। দুদিন পর দেখি পারুল আমার বাসায় হাজির। সাথে কিছু কু্চো গুড়া মাছ, পাঁচ মিশালি কিছু শাঁক আর সে।
: কি ব্যাপার পারুল, এতসব কেন? বাচ্চারা কই?
: আফা বাছ্ছাগো থুয়াইছি। কইছি আফার খুব লোক দরকার, লোকের ব্যাবস্তা হইলেই আইয়া পরমু।
আমি কিছুক্ষণ স্তব্দ হয়ে থাকলাম!
: আমার লোক লাগবে সত্যি, কিন্তু তোমার বাচ্চাদের তোমাকে লাগবে সেটা আরো বেশি সত্যি।আমি লোক যোগার করতে পারব কিন্তু তুমি একজন মা যোগার করতে পারবে না। তোমাকে আমি রাখতে পারি না। তুমি বাচ্চাদের কাছে ফিরে যাও।


অনেক বুঝিয়ে তাকে ফেরত পাঠিয়ে ছিলাম।
সহকারীদের পারুলকে নিয়ে প্রবল অভিযোগ আমি তাকে প্রশ্রয় দেই। সে নাকি ভিজিট দেয় না কিংবা দিলেও চার ভাগের এক ভাগ দেয়, পরে এসে আগে ঢুকে পরে ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমি না শোনার ভান করি। পারুলের মুখে ডাক্তারের প্রশ্রয়ের আলো খেলা করে। আমি দেখি আর সৃষ্টি কর্তার কাছে শুকরিয়া করি। অন্তত একজনের মুখে প্রশান্তির আলো জ্বালার ক্ষমতা তিনি আমাকে দিয়েছেন। আলহামদুলিল্লাহ।
যখন প্রায় চেম্বার থেকে চলে আসব এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে পারুল হাজির। একটু কাঁচুমাচু। তার স্ফিত উদরের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই সে আরো বিহ্বল। মিনিমাম আটমাস।


: তোমার ছোট মেয়ের বয়স কত
অস্ফুট স্বরে,
: ১২ মাস। আফা বুঝতে পারি নাই।
: আগে আসো নি কেন?
এবার সে একদম চুপ। মনে পরে গেল এর আগে তার তৃতীয় বাচ্চার সময় মৃদু তিরস্কার করেছিলাম। সে জন্য এবার সংকোচে আর আসে নি।
: অন্য কাউকে তো দেখাতে পারতে...
: দেখাইছি তো আফা, ডাক্তর কইছে বাচ্ছা নাই।
সাথে সাথে অন্য রোগীরা শুরু করল,
: এমনি অয়। ডাক্তররা বুজতে ফারে না,
গিবিজি...গিবিজি...
আমি ইতং বিতং বাচিয়ে পারুলকে ভালো করে জিজ্ঞাসা করে যা আবিস্কার করলাম তা হলো,
সাত মাস আগে মেন্সট্রুয়েশান বন্ধ দেখে সে ডাক্তারের( ফার্মেসি ম্যান) কাছে যায়। ডাক্তর( ফার্মেসিম্যান) কইছে বাচ্ছা নাই। অথচ সে এখন আট মাসের পোয়াতি! কত্ব বড় ভুল ডাক্তারের!!!
পারুল তো বিব্রত, অন্য সব অপেক্ষমান রোগীরা ডাক্তারদের নিয়ে পরল। থাক আমি আর সে দিকে না যাই।
আমি চুপচাপ হিসাব মেলাতে লাগলাম, পারুল তার প্রেগনেন্সীর দের মাসের মধ্যে ফার্মেসী ম্যানের কাছে গেছে। সেখানেই স্ট্রিপ দিয়ে প্রেগনেন্সী টেস্ট করিয়েছে। ফলাফল নেগেটিভ। অবশ্য নেগেটিভ আসাই স্বাভাবিক ঐ সময়।
আমার প্রশ্ন, এখানে প্রকৃত ডাক্তারের সম্পৃক্ততা কত টুকু?? কই কেউই তো বল্ল না, ঐ লোক তো ডাক্তারই না, তাকে কেন ডাক্তার বলছে??
আমার প্রশ্রয়ের পারুল যার অন্তত আমার মতো চালচুলোহীন হলেও একজন ছাপোষা ডাক্তারের সাথে সখ্যতা আছে, তার গল্প যদি এমন হয় তো বাকী ৮৫ হাজার গ্রামের কোটি পারুলের কি অবস্থা??
শহরের হিসেব বাদ। বড় বড় শহরে এত ছোট ছোট ঘটনা ধর্তব্য না। আমি আজও হিসাব মিলাতে পারিনি, আপনারা একটু সাহায্য করবেন প্লিজ?

____________________________

 

 

ডা. ছাবিকুন নাহার । সুলেখক।

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়