Ameen Qudir

Published:
2017-08-20 17:34:01 BdST

পানিতে আর্সেনিক নিয়ে গবেষণা ও চিকিৎসার অগ্রনী ডা. মুজিবুল হক স্যারের স্বীকৃতি চাই


 

 

 

ডা. বিধান সরকার

____________________________

পানিতে আর্সেনিক নিয়ে গবেষণা ও চিকিৎসার অগ্রনী ডা. মুজিবুল হক স্যারের স্বীকৃতি চাই;

 

গুণীজনের মূল্যায়ন করতে অামরা জানি না। বরং গুনীজনের কিভাবে অবমূল্যায়ণ , তুচ্ছ করা যায় সেটা আমরা ভাল জানি।
কেউ গুনীদের জন্য সম্মান চাইলে অন্যরা চেচিয়ে উঠি , যেন সম্মান দেয়া না হয়।

এই চিত্র ডাক্তার সমাজে প্রবল। হাতে গোনা কিছু সম্মান পেয়েই অামরা ধন্য। অথচ দেশের সার্বিক উন্নয়নে ডাক্তারদের বিশাল অবদান রয়েছে ; মানুষকে বাঁচাতে , মানুষকে সুস্বাস্থ্যদানে। অথচ আমাদেরই অনৈক্যর কারণে সারা দেশের নিরক্ষর মানুষও এখন ডাক্তারদের গায়ে হাত তোলে।

এটার কারণ আমাদের ডাক্তার সমাজের সম্মান অসচেতনতা।

যাই হোক , এই লেখা আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক অধ্যাপক ডা. এম মুজিবুল হককে নিয়ে । রাজশাহী মেডিকেলে স্যারের ছাত্র ছিলাম আমি। তিনি মানুষ হিসেবে নমস্য জন।

সম্প্রতি ডাক্তার প্রতিদিনে স্যারের আর্সেনিক গবেষণায় বিশিষ্ট অবদানের কথা জানলাম আবার। আমরা তো স্যারের সেই কীর্তি ভুলেই গিয়েছিলাম। এই হচ্ছে সব ভুলে যাওয়া বাংগালী জাতি আমরা।

দেশের চিকিৎসা শাস্ত্রে ও ক্ষেত্রে স্যারের মূল্যবান অবদান সর্বদা স্মরনীয় থাকবে।

অামি স্যারের একজন গুনমুগ্ধ ছাত্র হিসেবে দেশের কর্তা ব্যাক্তিদের কাছে স্যারে জন্য উচ্চ সম্মাননা দাবি করি।

অামরা ডাক্তার রা ভাল লিখতে পারি না। নিজেদের দাবি জানাতেও পারি না , এটাই দু:খ।

এখানে স্যারের লেখাটাও পূণ:মুদ্রনের জন্য ডাক্তার প্রতিদিনকে অনুরোধ জানাই।

_________________________

ডা. বিধান সরকার , প্রাক্তন শিক্ষার্থী , রাজশাহী মেডিকেল কলেজ । বর্তমানে ইউএসএ প্রবাসী ।

ডা. বিধানের অনুরোধে লেখাটা নিচে দেয়া হল।
_______________________________


পানিতে আর্সেনিক, তরলে গরল

 

অধ্যাপক ডা. এম মুজিবুল হক

________________________________


সম্প্রতি বাংলাদেশে আর্সেনিকের ভয়াবহ উপস্থিতি নিয়ে অত্যন্ত সুলিখিত লেখা উপস্থাপিত হয়েছে। প্রবন্ধটিতে চাপাই নবাবগঞ্জের অাবদুল মতিনকে দেশে চিহ্ণিত প্রথম আর্সেনিক রোগী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রায় এক যুগ আগে আমিই তাকে প্রথম শনাক্ত করি।

 


আমি রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের চর্ম ও যৌন রোগ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কাজ করছিলাম।

শনাক্তিকরণের সময় ত্বকে আর্সেনিকের সব আলামতের সঙ্গে তার হাতে একটি ক্ষত থাকায় বায়োপসি করে তাতে ক্যান্সারের আলামত পাওয়া যায়। এরপরে আমার বিভাগের সব চিকিৎসকদের নিয়ে আমরা তার গ্রামের বাড়িতে যাই।

 

 


নয় ভাই বোনের তৃতীয় আব্দুল মতিনের আরো তিন ভাইবোনের শরীরে তখন আর্সেনিকের লক্ষ্মণ পরিস্ফুট হচ্ছিল। চার বোনের বিয়ে আর্সেনিক মুক্ত হওয়ায় তারা ভাল আছেন বলে মতিন জানান।


১৯৯৪ সালে মতিনের গ্রামে রাজারামপুরে শত শত মানুষকে জিজ্ঞেস করে আর্সেনিকের নাম কেউ শুনেছেন , পাই নি।


প্রথম শনাক্তি করণের বারো বছর পর সেদিন মতিনের সঙ্গে দেখা আমার ঢাকার চেম্বারে। তাকে দেখে আমি চমকে উঠি।


সৌম্য কান্তি স্বাস্থ্য উজ্জল সেদিনের তরুণকে চেনাই কষ্টকর হচ্ছিল। শরীরের নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে ক্যানসার।


এগুলো এস্কুমাস সেল জাতীয় ক্যানসার হওয়ায় জীবন সংহার করে না। কিন্তু জীবনের সব রস জীবনী শক্তি শুষে নেয়। অটি অক্সিডেন্ট , স্পিরিলুনা, সেলিনিয়াম সমৃদ্ধ ভিটামিন , রেডিও থেরাপি কোন কিছুই এই মৃত্যুদূতকে অবদমিত করতে পারছে না। সামান্য হয় তো সহায়ক হয়েছে।


জীবন নির্বাহের তাগিদে মতিন আগের মতই চাপাই নবাবগঞ্জর বাসস্টান্ডে টাইম কিপারের কাজ করে চলেছেন।

 

 


আবদুল মতিন তার বাড়ির উঠানে কোনায় সযত্নে লাগানো নলকুপের পানি নিশ্চিন্তে পান করেছেন বছরের পর বছর। সুপেয় স্বচ্ছ এই পানি তে কখন যে অদৃশ্য মৃত্যুদূত গোপনে প্রবেশ করেছে, তার ইতিহাস আমাদের কারুরই জানা নেই। তবে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ পরীক্ষা করে দেখেছে, ওই পানি তে স্বাভাবিকের তুলনায় ৪ গুন বেশী আর্সেনিক রয়েছে।

 

খুব আক্ষেপ হয় আমাদের । এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। সেই প্রাচীন কাল থেকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলা ভুমি ছিল নিরাপদ পানির সম্পদের জন্য বহুল পরিচিত। এখানকার পুকুর নদী নাল খাল পাতকুয়া ছিল সুপেয় খাবার পানির অফুরন্ত উৎস।


যুগের পর যুগ পানি বাহিত তেমন কোন রোগ বালাইয়ের কথা তেদমন কোথাও শোনাও যায় নি।
নলকুপ ব্যবহার শুরুর পূর্বে নদী হ্রদ আর খালে র মত প্রাকৃতিক উৎস ; তৈরী পুকুর , দিঘী অার পাত কুয়া র মত উৎস ব্যবহার করে গেছে মানুষেরা। তবে এসব পানি পরবর্তীতে মানুষ সৃষ্ট কলুষ মুক্ত না থাকায় বেশ কিছু পানি বাহিত রোগ বিশেষত কলেরা ডায়রিয়ায় প্রচুর মানুষের জীবন হানি ঘটতে থাকে। পানির দূষণের কারণে পেটের পীড়ার মারা যেতে থাকে প্রধানত শিশুরা।
পানিবাহিত এসব রোগ থেকে রক্ষা পেতে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারে র সিদ্ধান্ত হয়।

 

এই প্রেক্ষিতে সরকারি উদ্যোগ, দেশী বিদেশী উদ্যোগ বিশেষত ইউনিসেফের ব্যবস্থাপনায় নলকুপ বসানো শুরু হতে থাকে। গত শতাদ্বীর শেষে ৯৫ ভাগ মানুষ নলকুপের মাধ্যমে প্রাপ্ত সুপেয় পানির আওতায় চলে আসে।


পানি বাহিত রোগ বালাই একদম কমে যায়। শিশু মৃত্যুর হারকমে যায়। নানা প্রতিকূলতায় বিপর্যস্ত এদেশের মানুষের জন্য এ ছিল পরম পাওয়া।

 

 

 


কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের এই সুখ দীর্ঘস্থায়ী হয় নি। ১৯৯৩ সালের দিকে আমাদের অগভীর নলকুপেরপানিতে আর্সেনিকের মত মারাত্মক বিষ ধরা পড়ে। চমকে ওঠার মত কথা। আর্সেনিক হল বিষের রাজা। পারদের চেয়েও কয়েক গুন বিষাক্ত। এর বিষক্রিয়ায় আসেনোকোসিস নামের রোগের প্রকোপ দেখা দেয় ত্বকের ওপর কালো কালো ছোপ ছোপ দাগ দিয়ে। ধীরে ধীরে তা কিডনি লিভার স্নায়ু সব বিকল করে ক্যান্সারে দিকে গড়িয়ে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায় আক্রান্ত মানুষ টিকে।


এ অামাদের বড় বিষাদের পালা। ছায়া ঢাকা পাখি ডাকা এই শান্তির নীড়ে চুপি চুপি সিঁদ কেটে ঢুকে পড়েছে মৃত্যুদূত।

 

মিশে গেছে জীবনের সবচাইতে জরুরি প্রয়োজন খাবার পানিতে। সারাদেশ জুড়ে ৬১ জেলার খাবার পানিতে পাওয়া গেছে আর্সেনিক। এখন আমাদের নিরাপদ পানি খোঁজার পালা। এ আমাদে র বড় আক্ষেপ।


মাত্র ক বছর আগেও আমরা নিশ্চিন্তে মৃত্যুপথযাত্রীর মুখে তুলে দিয়েছি নিরাপদ আঁজলা ভরা পানি। জিয়ন কাঠির মত তা ফিরিয়ে দিয়েছে সুস্থতা। নিরাপদ পানির সন্ধানে ও ব্যবস্থাপনায় যত শ্রম ও মূল্য দিতে হবে; তাতে ‘পানির দরে ’পাওয়া বাগধারার অর্থ পাল্টাতে হবে বলে মনে হচ্ছে।

আমরা এখন জেনেছি স্বচ্ছ পানি মানেই নিরাপদ পানি নয়। নিরাপদ পানি কি ! নিরাপদ পানি হতে হলে পানি হতে হবে রোগ জীবানুমুক্ত । তাতে থাকতে হবে নিয়ন্ত্রিত মাত্রায় খনিজ পদার্থ। পানিতে বিভিন্ন খনিজ পদার্থও মাত্রা থাকার বিষয়টি বিশ্ব ¯স্বাস্থ্য সংস্থা পৃথিবীর একাধিক বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন গবেষনার ভিত্তিতে বৈজ্ঞানিকভাবে সুপারিশ করে। গ্রহণযোগ্য মাত্রা বলতে একটি নির্দিষ্ট পরিমানকে বোঝায়, যা সারা জীবন গ্রহণ করলেও ¯স্বাস্থ্য সমস্যা বা ঝুঁকির কারণ হবে না। ১৯৮৪ সালে বিশ্বস্বাস্থ্য পানিতে আর্সেনিকের গ্রহণযোগ্য মাত্রা নির্ধারণ করেছিল ০.০৫/লিটার।


কিন্তু পরেদেখা গেল, এই মাত্রা গ্রহণ করলে ত্বকে ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা থাকে। পওে তা কমিয়ে লিটারে ০.০১ মাত্রায় আনা হয়।


এই মাত্রা সারা জীবন খেলে ১০০০ জনে গড়ে ৫ জনের ত্বকে ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা থাকে। বাংলাদেশের ৬১ জেলার নলকুপেই গড়ে লিটারে ০.০৫ মাত্রার আর্সেনিক থাকার প্রমান পাওয়া গেছে।


রক্ষণশীল হিসেবে ৩ কোটির বেশী মানুষ আর্সেনিক সংক্রান্ত ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। কোথা থেকে এসে এই নীরব আততায়ী আমাদের সুপেয় পানিতে গোপনে প্রবেশ করল। এ বিষয়ে নানা মত। আমি নিজেও তথ্যবহুল বই লিখেছি।

 

ভুতত্ত্ববিদরা মনে করেন , বাংলাদেশ নামক ভুখন্ডের জন্ম হয়েছে কয়েক লক্ষ বছর আগে। এর আগে এটা গভীর সমুদ্রে নিমজ্জিত ছিল। ভুমি খন্ডের নানা চাপে ও নানা সংঘর্ষে হিমালয় পর্বতমালার উথ্থান ঘটে। এসময় পার্বত্য নদী নালাও বেগবান হয়। নদী দিয়ে বেয়ে আসা শিলা খন্ডের ভগ্নাংশ পলল নদীর অববাহিকায় সমুদ্র গর্ভে পড়ে স্তরে স্তরে জমে এই ভুখন্ডে।


শেষদিকে যে পলল জমে তাতে থাকা আর্সেনিক বিষ সমৃদ্ধ খনিজ অসেনোপাইরাইটেই মিশে আছে মৃত্যুদূত। নলকুপে কিভাবে এলো আর্সেনিক। নানা কিছুকে দায়ী করা হয়েছে। জমিতে দেয়া কীটনাশক, সার, শিল্প কারখানার বর্জ্য ,পল্লী বিদ্যুতের খুঁটিতে ব্যাবহৃত ক্রমাটেড আর্সেনিক; ভুগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত মাত্রায় উত্তোলন।


এ সবের উৎস খুঁতে গলদঘর্ম হচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। তবে মনে হচ্ছে ২০ থেকে ৮০ মিটার ভুগর্ভস্থ ভুস্তরের ফাকে ফাকে রয়েছে ক্ষতিকর অসেনোপাইরাইট আর্সেনিক। অগভীর নলকুপের মাধ্যমে অক্সিজেন ঢুকে তা খনিজ আর্সেনিককে পানিতে ঠেলে দিচ্ছে। অঅরও মতামত আছে গুনীজনদের। বাংলাদে শে আর্সেনিক দূষণ পরিস্থিতিকে চেরনোবিল দুর্ঘটনার চাইতেও ভয়াবহ উল্লেখ করা হয়েছে। এ ব্যাপাওে উদ্যোগী হয়ে নানা মুখী জনকল্যানী গবেষনা দরকার। উদ্যোগ দরকার। অবহেলার কোন সুযোগ নাই। অঅরও লাগসই বিধি ব্যবস্থা ও কার্যকর ওষুধ আবিস্কার প্রয়োজন।

নানা প্রতিকুলতায় এসব কাজ খুবই অপ্রতুল। তবে আমরা নিরাশাবাদী নই। ঝড়ঝঞ্ঝা বন্যা , প্রাকৃতিক নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে বেঁচে থাকার অভিজ্ঞতা এদেশের সাহসী মানুষের। আমাদের গভীর প্রত্যয় ও ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় এই বিপদসঙকুল পরিস্থিতি আমরাও কাটিয়ে উঠতে পারব। এবং অদুর ভবিষ্যতেই অাবদুল মতিনের মত অঅর্সেনিক আক্রান্তদেও সুস্থ করে তোলার সুসংবাদ শোনাতে পারব।

 

_____________________________

লেখক অধ্যাপক ডা. মুজিবুল হক । দেশের প্রখ্যাত লোকসেবী চিকিৎসক। সুলেখক ।
FCPS FRCP(uk)DDV(austria)
Skin & Sexul medicine specialist
Popular Dhanmondi 2

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়