Ameen Qudir

Published:
2017-06-20 15:36:19 BdST

তারপর কাঁপা হাতে লিখল, "পৃথিবীতে এত মানুষ এত পাপ করে, আমার সাথে কেন হল?"


 

 


সায়ন্তন ভট্টাচার্য
______________________

১.
আজ থেকে পাঁচ বছর আগের কথা, সবে পি.এইচ.ডি করতে চিত্তরঞ্জন ন্যাশনাল ক্যান্সার ইনস্টিটিউটে ঢুকেছি। থরের হাতুড়ির মত মনোবল, তেজী ঘোড়ার মত এনার্জি! কাজের প্রথম সপ্তাহেই বুঝে গেলাম ভাটনাগর পেতে চলেছি যে, দ্বিতীয় সপ্তাহে কনফার্মড হয়ে গেলাম নোবেল পাওয়া নিয়ে। হোঁচট খেলাম তৃতীয় সপ্তাহে যেদিন গাইড জানালেন এরপর থেকে হসপিটাল ওয়ার্ডে গিয়ে পেশেন্টদের অ্যাডিকশনের হিস্ট্রি ডকুমেন্ট করতে হবে। আমার গবেষণার বিষয় থ্রোট ক্যান্সার, যাতে পেশেন্টরা বোবা হয়ে যায়। তার উপর হসপিটাল ওয়ার্ডে গিয়ে মৃত্যুপথগামী পেশেন্টদের সাথে কথা বলার অভিজ্ঞতা আমার তখনো নেই, কারই বা থাকে! যাই হোক, সেদিন সকাল সকাল খাতা- পেন নিয়ে পৌঁছে গেলাম নির্দিষ্ট জায়গায়। প্রথম পেশেন্ট একটা ছেলে, আমারি বয়েসী। গায়ে কমলা ফতুয়া আর ধুতি, মাথা কামানো, চোখ- মুখ উজ্জ্বল। বেডের পাশে বসে কথা বলা শুরু করলাম, পেশেন্টের পরেরদিন সার্জারী, গোটা ভোকাল কর্ড কেটে উড়িয়ে দিতে হবে। ছেলেটার গলা ফ্যাসফ্যাসে, কথা বলতে রীতিমত কষ্ট হচ্ছে। অল্প আলাপে যা বুঝলাম তা হল সে রামকৃষ্ণ মিশনের একজন সন্ন্যাসী, জীবনে কোনোদিন কোনোরকম নেশা করেনি, 'পাপ' করেনি, ঈশ্বরের ভাবনায় মোটামুটি ছেলেবেলা থেকেই নিজেকে উৎসর্গ করে দিয়েছে। একমাথা চিন্তা নিয়ে ফিরে এলাম- ল্যারিঞ্জিয়াল বা থ্রোট ক্যান্সারের মুখ্য কজেটিভ এজেন্ট হল সিগারেট, বিড়ি আর গাঁজা যাদের কোনোটাই আমার সন্ন্যাসীর অভ্যেসে নেই। তবে হল কীভাবে? প্রশ্নটার উত্তর খুঁজে পেতে আমার অনেক সময় চলে গেছিল, পেশেন্টটাকেও বেমালুম ভুলে গেছিলাম, শুধু মনে ছিল দুদিন পরে বোবা ছেলেটার সাথে আমার কথোপকথন। আজীবন মনে থাকবে। তখন বিকেল, আমি ভয়ে ভয়ে বেডের দিকে এগিয়ে এলাম, ছেলেটার গলায় ব্যান্ডেজ বাঁধা, মুখে সেই হাসিটা নেই। আমাকে দেখেই সে ইশারা করে খাতা পেনটা চাইল, তারপর কাঁপা হাতে লিখল, "পৃথিবীতে এত মানুষ এত পাপ করে, আমার সাথে কেন হল?"

 

২.
পৃথিবীর মধ্যে ভারতবর্ষে হেড অ্যান্ড নেক ক্যান্সারের হার সর্বাধিক এবং তার পেছনের কারণটাও স্পষ্ট। ভারতে গুটকা পাওয়া যায়, গুড়াকু পাওয়া যায়, জর্দা পান পাওয়া যায়। স্টাডি থেকে দেখা গেছে চিউয়িং টোব্যাকো মানে এই গুটকা জাতীয় দ্রব্য সেবনের সাথে ওরাল ক্যান্সার হওয়ার রিস্ক সাংঘাতিক ভাবে জড়িয়ে। ঠিক যেমন সিগারেট, বিড়ি ও গাঁজা সেবনের সাথে সরাসরি প্রোপর্শনাল থ্রোট আর লাঙ ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা। কিন্তু আমি এখানে এদের কারো কথা বলব না, ভারত সরকারের সুবিবেচনায় আজ সমস্ত তামাকজাত দ্রব্যের প্যাকেটে ছবিসহ নোটিফিকেশন দেওয়া থাকে তামাকের অপকারিতা নিয়ে। সিনেমাতেও স্মোকিং সিন এলে তলায় আজকাল জ্বলজ্বল করতে থাকে "স্মোকিং ইজ ইনজুরিয়াস টু হেলথ"। এসবে কতদুর লাভ হয় জানিনা তবে চেষ্টার ত্রুটি নেই একথা সত্যি। কিন্তু যার কথা কেউ কখনো ভাবেনি? যে আমাদের প্রত্যেকের ঘরে ঘরে শান্তিতে বিরাজ করলেও কোনোদিন কেউ তার সাইড এফেক্ট নিয়ে বদার্ড হয়নি? যে শয়তানের জন্যই সম্ভবত আমার সেই সন্ন্যাসীকে বোবা হয়ে যেতে হয়েছিল? আর ভণিতা না করে বলেই দেই- কালপ্রিটটি হল ধুপকাঠি।

৩.
ভারত হোক বা জাপান, হিন্দু হোক বা বৌদ্ধ, পূজো হোক বা শ্রাদ্ধ- সমস্ত ধুপকাঠির মুখ্য উপাদান চারকোল এবং বাঁশের শন যারা পুড়লে কার্বন মনোক্সাইড, নাইট্রোজেন ও সালফার অক্সাইড, বেঞ্জোপাইরিন এবং বিষাক্ত মেটাল নির্গত হয়। গোদা বাংলায় বললে সিগারেটের সাথে কাঠকয়লা পোড়ানোর আগে তার উপরে আতর ছিটিয়ে দিলে যা হবে। দুহাজার সাল নাগাদ ব্রিটিশ লাঙ ফাউন্ডেশন এবং জাপানের একদল বৈজ্ঞানিক গবেষণা করে দেখেন ধুপকাঠির ধোঁয়া মিউটাজেনিক মালপত্রে ভর্তি যারা আমাদের ফুসফুস এবং শ্বাসনালীর ইরিটেশনের সাথে সাথে ক্যান্সার বাঁধিয়ে দেওয়ারও ক্ষমতা রাখে। জাপানের দলটি পরীক্ষা করে দেখে কিছু ধুপকাঠির কার্সিনোজেনিসিটি বা ক্যান্সার করানোর ক্ষমতা সিগারেটের চেয়েও বেশি! ২০০৮ সালে চীনের এক স্টাডি বলছে ধুপকাঠির ধোঁয়ায় অ্যারোডাইজেস্টিভ ট্র‍্যাক্টের ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় দশগুণ বাড়িয়ে দেয়! ২০১৩ সালের নর্থ ক্যারোলাইনা ইনস্টিটিউটের বৈজ্ঞানিকদের শেষ সার্ভে বলছে নিয়মিত ধুপকাঠি জ্বালানো আর ধুমপানের মধ্যে বিশেষ কোনো ফারাকই নেই। গোদের উপর বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়ায় এটির ব্যবহার- বেশিরভাগ মন্দির বা আমাদের স্মল স্কেলের ঠাকুরঘর আবদ্ধ জায়গায় তৈরী হওয়ার ফলে ধোঁয়াগুলো বাইরে বেরোতে পারেনা, ফলে আশেপাশের মানুষদের উপরেও এর এফেক্ট হয় মারাত্মক...এসব নিয়ে পড়াশোনা করতে করতেই ভাবছিলাম যেসব মহিলারা রাস্তায় সিগারেট খাওয়া মেয়েদের দেখে "অপসংস্কৃতি" আওয়াজ দিয়ে সন্ধ্যারতিতে বসলেন, ঈশ্বর তাদের মঙ্গল করবেন কি?

৪.
আমায় অনেক স্টুডেন্ট এমনকি বন্ধুরাও প্রায়ই বলে, "আমার চেনা অমুক দাদু ৮০ বছর বয়স অবধি দিব্যি ফুঁকে চলেছেন, কই ক্যান্সার তো হয়না!" ঠিক, আসলে আমাদের শরীর অসম্ভব দক্ষ ফাইটার! মানবদেহের প্রত্যেকটা কোষে ক্যান্সার জাতীয় জেনেটিক মিউটেশনঘটিত রোগ প্রতিরোধের জন্যে রিপেয়ার সিস্টেম থাকে, ইনফেকশনদের লাথ মেরে ভাগানোর জন্যে যেমন থাকে ইমিউনিটি! কিন্তু তবু কেন হয় জানেন? না, সিগারেট বা ধুপকাঠির ধোঁয়া সরাসরি ক্যান্সার করেনা, রিস্ক বা সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। বৈজ্ঞানিকমহলে একটা ফ্রেজ খুব জনপ্রিয়- "ক্যান্সার ইজ আ ম্যানমেড ডিজিজ ট্রিগার্ড বাই ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশন"। আমরা যত শিক্ষিত হয়েছি, উন্নত হয়েছি ততই পরিবেশে ছড়িয়ে দিয়েছি বিষাক্ত কার্সিনোজেন ভর্তি ধোঁয়া, ফাস্ট ফুডের সাথে গিলে চলেছি এমন সব কেমিক্যাল যারা কোষের বারোটা বাজিয়ে দেয়। আমার বন্ধুর বলা সেই ৮০ বছরের দাদু আজও স্মোক করতে পারেন কারণ তিনি শুধু ওই কার্সিনোজেনটুকুই পেয়েছেন, আজকের ২০১৭ সালের পলিউটেড হাওয়া পাননি, রঙ করা সবজি খাননি, স্মার্টফোন দেখেননি। ব্যাপারটা অনেকটা বিন্দুতে সিন্ধুর মত। আমি এতকিছু লেখার পরেও বলব না ধুপকাঠির ধোঁয়া নাকে ঢুকলেই ক্যান্সার অবধারিত, তবে আপনি যখন সূচভর্তি ঘরের মধ্য দিয়ে একটা বেলুন ডান হাতে নিয়ে হাঁটছেন, বাঁ হাতে আরেকটা আলপিন নাই বা নিলেন!

_______________________

সায়ন্তন ভট্টাচার্য, সুলেখক

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়