Ameen Qudir

Published:
2017-05-11 18:28:22 BdST

স্বাস্থ্য অ-ব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে সর্বাগ্রে আইন প্রণয়ন করুন


 

 

 

 

ডা. বাহারুল আলম
___________________________________

বাংলাদেশ সরকারের আইন কমিশনের সদস্যদের প্রতি --

“জনস্বার্থে রাষ্ট্রের স্বাস্থ্য অ-ব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে সর্বাগ্রে আইন প্রণয়ন হওয়া প্রয়োজন”

...................চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী জনগণের প্রতিপক্ষ নয়.................. .......

চিকিৎসা পেশা ঝুঁকিপূর্ণ বিধায় রোগীর মৃত্যু বা চিকিৎসার ক্ষেত্রে অবহেলার কথা বলে চিকিৎসককে লাঞ্ছিত করার ঘটনা-- বাংলাদেশে এখন একটি নৈমিত্তিক ব্যাপার।
এছাড়াও রোগী মৃত্যুর ঘটনায় চিকিৎসককে আসামী করে থানায় ফৌজদারি ও হত্যা মামলা দায়ের করে চিকিৎসককে জেলখানায় পাঠানোর ঘটনা অহরহ ঘটছে।
এ বিষয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ‘আইন কমিশন’ আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে।

প্রথমত, এ উদ্যোগ সমর্থন বা সহযোগিতার কোন দাবী রাখে না। কারণ তাদের উদ্যোগের মধ্যেই বিশাল গলদ ও বৈষম্য বিদ্যমান। উদ্যোগের শুরুতেই চিকিৎসক ও জনগণকে মুখোমুখি দাঁড় করানো হয়েছে এবং পূর্বাহ্ণেই আইন কমিশনের সদস্যগণ চিকিৎসকরা অপরাধী বা অপরাধ করেন এরূপ ধারনা-প্রসূত প্রশ্নপত্র তৈরি করেছেন। এটি সঠিক নয়। চিকিৎসকরা চিকিৎসা করতে গিয়ে অপরাধ করেন – এরকম মনস্তাত্ত্বিক ধারনা ও বিশ্বাস কমিশনের সদস্যদের মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে। জনগণের চিকিৎসা পাওয়ার সংকট এবং চিকিৎসকের চিকিৎসা দেওয়ার সংকট- দুটি ভিন্ন বিষয়। আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে, চিকিৎসক-রোগী পারস্পরিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সংকট সৃষ্টি হয়। সঠিকভাবে চিকিৎসকের চিকিৎসা দেওয়ার সংকট সমাধানকল্পে ধারাবাহিকভাবে বিবেচিত হওয়া প্রয়োজন।

দ্বিতীয়ত, চিকিৎসা রাষ্ট্রায়ত্ব, চিকিৎসা ব্যবস্থাপনাও রাষ্ট্রায়ত্ব। এই রাষ্ট্রায়ত্ব চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় প্রধান ৪টি উপকরণ—অবকাঠামো, জনবল, প্রযুক্তি ও উপকরণ। এর কোন একটির অনুপস্থিতে চিকিৎসায় ঝুঁকি বাড়ে। জনগণ ক্ষুব্ধ হয় ,অভিযোগ করে চিকিৎসকের অবহেলার এবং চিকিৎসক আক্রান্ত হয়।

আইন কমিশনের সম্মানিত সদস্যদের উচিৎ এই আইন প্রণয়ন করা যেন- ‘রাষ্ট্র চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় কোন ঝুঁকি সৃষ্টি না করে’।

অপরদিকে নাগরিকদের জানা নাই, চিকিৎসা দেওয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রের , চিকিৎসক সেই ব্যবস্থাপনার ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। নাগরিকের যে কোন অভিযোগ রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে হওয়াটাই সমীচীন, চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মীর বিরুদ্ধে নয়।
আইন কমিশনের সদস্যদের জানা উচিৎ, রাষ্ট্রের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা শতভাগ পূর্ণ থাকলে বা ব্যবস্থাপনায় কোন ঘাটতি না থাকলে কেবলমাত্র তখনই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হতে পারে। তাঁরা নিশ্চয়ই জানেন, নাগরিকের চিকিৎসা দেওয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। নিয়োগকৃত চিকিৎসকরা সহায়ক শক্তি মাত্র। রাষ্ট্রের স্বাস্থ্য প্রশাসনের নির্বাহী বিভাগে প্রচলিত আইনে আছে, চিকিৎসক অবহেলা করলে তাকে শাস্তি দেওয়া। বাস্তবে সকল চিকিৎসা অবহেলার সাথে রাষ্ট্রের ৪টি (অবকাঠামো, জনবল, প্রযুক্তি ও উপকরণ)মৌলিক ব্যবস্থাপনার অভাব বা ঘাটতি বিদ্যমান। ফলে শাস্তি দেওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না।

আইন কমিশনের বিজ্ঞ সদস্যদের এখন স্পষ্ট হতে বাকি রইল না যে, দু’ একটি ব্যতিক্রম ঘটনা ছাড়া প্রায় সকল ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে আইন প্রণয়ন হওয়া উচিৎ। যেমন , নাগরিকের পুনর্বাসন , ক্ষতিপূরণ ইত্যাদি। একইভাবে চিকিৎসকের বিষয়ে অপরাধ প্রমাণিত হলে শাস্তি প্রয়োগে আইন থাকা উচিৎ, তবে সে আইন বিদ্যমান আছে, নূতন করে প্রণয়নের প্রয়োজন নাই।

আইন কমিশনের বিজ্ঞ সদস্যদের বলছি, বাংলাদেশ রাষ্ট্রে ঝুঁকিপূর্ণ কাজের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ‘ইনডেমনিটি’ বা ‘দায়মুক্তি’ আইন ভোগ করে থাকেন। বিজ্ঞ বিচারকরা এ আইন সম্পূর্ণরূপে ভোগ করে থাকেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ঝুঁকি সর্বোচ্চ । তাই চিকিৎসা ঝুঁকির দুর্ঘটনার দায়মুক্তি আইন সর্বাগ্রে প্রণীত হওয়া প্রয়োজন। আপনাদের জাগ্রত বিবেকের কাছে প্রশ্ন , চিকিৎসা ঝুঁকির দায় অকারণে চিকিৎসকের উপর বলবৎ করে তাকে জেলহাজতে পাঠানো কতটা অনুচিত এবং যৌক্তিক?

আইন কমিশনের বিজ্ঞ সদস্যগণের বিবেচনায় আসা সঙ্গত, বিচারালয় থেকে আরম্ভ করে রাষ্ট্রের বহু কার্যালয় নিরাপত্তা প্রহরী পরিবেষ্টিত থাকে। কেবল থাকে না, নাগরিকদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ‘হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটার ও জরুরি বিভাগ সহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ’।

আইন কমিশনের বিজ্ঞ সদস্যদের আরও ভাবা উচিৎ, প্রতিদিন মন্ত্রী মহোদয় থেকে আরম্ভ করে অনেক সু-স্বাস্থ্যের অধিকারী নাদুস নুদুস কর্তাব্যক্তিরা রাস্তায় চলাচল ও নদী পার হওয়ার সময় বিশাল প্রটোকল পেয়ে থাকেন। কেবল প্রটোকল পান না ‘মুমূর্ষু রোগী বহনকারী এম্বুলেন্স’। আপনারা নিশ্চয়ই লজ্জা পাবেন, হাসপাতালে পৌঁছানোর পূর্বেই এম্বুলেন্সে রোগী মারা যায় এবং এম্বুলেন্সেই প্রসব বেদনায় কাতর প্রসূতি তার বাচ্চা প্রসব করে।

আপনাদের বিবেক নিশ্চয়ই জাগ্রত হবে, “রোগীর এই অধিকার হীনতার” বিরুদ্ধে কঠোর আইন হওয়ার পক্ষে।

কমিশনের বিজ্ঞ সদস্য-গন আপনারা জানেন ও দেখেছেন, অপারেশন থিয়েটারে অপারেশন চলাকালীন জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে বিনা নোটিশে বিদ্যুৎ বন্ধ হয়ে যায়। তখন শহরের কর্তাব্যক্তিদের বাড়িতে যথাযথ ভাবে বিদ্যুৎ সচল থাকে।

‘এ অমানবিক ঘটনার বিরুদ্ধে, নাগরিকদের স্বার্থে কঠোর আইন হওয়া প্রয়োজন’।

বিজ্ঞ আইন কমিশনের সদস্যগণের দৃষ্টি এড়িয়ে যায় নি যে হাসপাতালের বহির্বিভাগে এক একজন চিকিৎসক প্রতিদিন শতাধিক রেওগির চিকিৎসা দিয়ে থাকেন এবং ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে রোগী থাকেন ৭০০ বা তারও বেশী। চিকিৎসা করার ক্ষমতার চেয়েও কয়েকগুণ বেশী রোগী থাকায় মানহীন চিকিৎসা সৃষ্টি হয় ।যা গুরুতর অপরাধ।তাই শয্যার অতিরিক্ত রোগী ভর্তি করা ও মানহীন চিকিৎসার বিরুদ্ধে কঠোর আইন হওয়া প্রয়োজন।

বিজ্ঞ সদস্যগণ আরও জানেন, একজন চিকিৎসকের রোগী চিকিৎসা করার সংখ্যা এবং সেবিকার সেবা দেওয়ার সংখ্যা আন্তর্জাতিকভাবে নির্ধারিত। বাংলাদেশে কোন রাস্ট্রায়ত্ব হাসপাতালে এ নিয়ম পালিত হচ্ছে না। এর প্রতিরোধকল্পে কঠোর আইন প্রণয়ন করা প্রয়োজন।

বিজ্ঞ সদস্যগণ নিশ্চয়ই জানেন,হাসপাতালে পরীক্ষা নিরীক্ষার 'ফী' নির্ধারিত। এই ফী দেওয়ার ক্ষমতা নাই এরকম নাগরিকের সংখ্যাও অনেক। তারা চিকিৎসা ছাড়াই মৃত্যু
বরণ করেন। এ অমানবিকতার বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন প্রয়োজন।

এ ছাড়াও বিজ্ঞ সদস্যবৃন্দের চিকিৎসা-ব্যবস্থা, চিকিৎসক, জনগণ, চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের অন্যান্য বিভাগ, দেশের প্রচলিত আইন ও সর্বোপরি চিকিৎসা বিজ্ঞান সম্পর্কে ব্যাপক ধারণা না নিয়ে আইন প্রণয়নের উদ্যোগ ফলপ্রসূ হবে না।
(১১ মে ২০১৬ তে লেখা, আজও পরিস্থিতি পাল্টায় নি।)
_________________________

ডা. বাহারুল আলম । লোকসেবী চিকিৎসক ও পেশাজীবী নেতা।

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়