Ameen Qudir

Published:
2017-04-24 16:19:33 BdST

৯০ বছরের সাইকেল জীবনদাত্রী জহিরনকে স্বাধীনতা পদক দিন


 

 

 

 


জহিরন বেওয়া। বয়স ৯০ বছর। গরিবের সংসারের বিধবা বৃদ্ধা। গ্রামের নারীরা বিনা চিকিৎসায় যেন মারা না যায় এ তার ব্রত। সে লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন ৪৫ বছর ধরে স্বেচ্ছাশ্রমে। লালমনিরহাট জেলার আদিতমারীর তালু দুলালী গ্রামের জহিরন বেওয়া নারী সেবার এক উদার সাদা মনের নারী। গ্রামের পর গ্রাম ছুটে সেবা দেন এ বৃদ্ধা। গ্রামের কোনো নারী অসুখে ভুগলে তাকে হাসপাতাল বা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়াই তার একমাত্র কাজ।


বৃদ্ধা জহিরন ৯০ বছরের হওয়ায় সর্বত্র তাকে উপাধী দিয়েছে বাংলার নানী। বৃদ্ধা নানীর কাছে অসুখে পড়লে ছুটে আসে গ্রামের নারীরা। গ্রামের নারীরা অনেকে চেনে না পথ ঘাট। তাদের পক্ষে রয়েছেন জহিরন। এভাবে বিনা শ্রমে স্বেচ্ছায় কাজ করতে করতে কখন যে পেরিয়েছে এত বছর বুঝে উঠতে পারেননি বৃদ্ধ জহিরন। জহিরনের সেবা দিতে ছুটে চলার একমাত্র বাহন বাইসাইকেল। এ বাইসাইকেল একটি রয়েছে তাও অনেক সময় হয়ে যায় নষ্ট। জহিরন বেওয়া গ্রামীণ নারীদের স্বাস্থ্য সেবা দিতে তার ইতিমধ্যে ৫টি বাইসাইকেল শেষ হয়েছে তবুও থেমে থাকেন নি তার উদার মনোভাব। তার একমাত্র সম্বল বাইসাইকেল তাও নষ্ট।

নতুন বাইসাইকেল কেনার নেই সামর্থ্য। মনের উদ্যমতা, সাহসিকতা, কর্মের দক্ষতা-সখ্য কমেনি এখনো। তাই এ বয়সেও বাইসাইকেল চালিয়ে প্রতিদিন সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত গ্রামে গ্রামে ঘুরে। অসুস্থ দরিদ্র মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে আসছেন জহিরন বেওয়া। সীমান্তঘেঁষা লালমনিরহাট জেলার আদিতমারী উপজেলার ভেলাবাড়ী ইউনিয়নের গ্রাম তালুক দুলালী। ভারতীয় কাঁটাতারের বেড়াঘেঁষা দুলালী গ্রাম বাড়ি জহিরনের। স্বামী সায়েদ আলী। মারা যাওয়ার পর ৯০ বছরের জহিরন বেওয়া এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে বাইসাইকেল চালিয়ে মহিলাদের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে সাদামনা হয়ে স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে আসছেন। নারী হয়েও বাইসাইকেল চালিয়ে কখনো পিছপা হননি এ নারী। গ্রামের কোনো নারী বিনা চিকিসৎসায় যেন অসুখে না ভুগেন সে লক্ষ্যে দীর্ঘ ৪৫ বছরের তার এ সংগ্রাম। মহান মুক্তিযুদ্ধের চার বছর আগে স্বামীর মুত্যৃতে ভেঙ্গে পড়া এই সংগ্রামী নারী তিন ছেলে আর দুই মেয়েকে নিয়ে সংসার সংগ্রামে ব্রতী হয়ে ওঠেন। গ্রামের কোনো নরী অসুস্থ হলেই ছুটে যান জহিরন। বিভিন্ন হাসপাতালে গিয়ে সরকারি ওষুধ নিয়ে এসে গ্রামের মানুষের মাঝে বিলিয়ে সুস্থ করে তোলেন। ফ্রী দেন ওষুধ।

অশিক্ষিত হলেও কারো অসুখের খবর পেলে বাড়িতে থাকেন না জহিরন বেওয়া। রোগীকে হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়াই তার একমাত্র কাজ। বিনিময়ে নেন না কোনো পারিশ্রমিক। গ্রামে কোনো নারী অসুখে পড়লে তাকে সুস্থ না করা পর্যন্ত জহিরন ছাড়বেন না তার পিছ। প্রতিদিন ওই রোগীর বাড়ি যাবেন বাইসাইকেলে। শুধু তালুক দুলালী একটা গ্রাম না আদিতমারী উপজেলা জুড়ে গ্রামের পর গ্রাম বাইসাইকেল চালিয়ে নিরলস ছুটছেন তিনি। মানুষের সেবা করায় ৯০ বছরের জহিরন বেওয়াকে বাংলার নানী উপাধি দিয়েছে সবাই। দেশ স্বাধীন হয়েছে কিন্তু সংসারে অভাব-অনটন ছিল প্রতিক্ষণের চিন্তা। সমাজের কথা উপেক্ষা করে ১৯৭৩ সালে জহিরন পরিবার পরিকল্পনার অধীন স্বাস্থ্য সেবা ও পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে ৬ মাস প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।

চুক্তিভিত্তিক মসিক ২শ’ টাকা মজুরিতে যোগ দেন। সে সময় থেকে নিজ গ্রামসহ আশপাশের গ্রামগুলোতে বাইসাইকেল চালিয়ে গ্রামবাসীদের স্বাস্থ্য সেবা দেন। বাইসাইকেল চালিয়ে ২শ’ টাকা থেকে ৩শ’ টাকা এমনকি ৫শ’ টাকা বেতনে চাকরি করে অফিসিয়াল অবসর নিলেও বাস্তবে চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁর ফ্রি স্বাস্থ্য সেবা। চাকরি বাদ দিয়েছেন কিন্তু অর্জিত অভিজ্ঞতা বাদ দেননি। বাড়িতে বসে না থেকে গ্রামবাসীর স্বাস্থ্যসেবায় মনোযোগী জহিরন কাজ করছেন ৪৫ বছর ধরে হাসিমুখে। জহিরন সকাল হলেই বাড়ি থেকে বাইসাইকেল নিয়ে একাই এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়ি ছুটে বেড়ান। কেউ অসুখে পড়লেই তাকে নিয়ে চলে যান চিকিৎসকের কাছে।

দুলালী গ্রামের রহিমা বেগম জানান, স্বামী বাড়িতে না থাকলে কোনো মহিলা অসুখে পড়লে জহিরন নানী খবর পেলেই তাকে হাসপাতালে পৌঁছে সুস্থ করিয়ে ছাড়েন। তবে কোনো পারিশ্রমিক নেন না। ভেলাবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী জানান, সেচ্ছা শ্রমের ভিত্তিতে কোনো অর্থ নেন না জহিরন। এভাবে গ্রামের পর গ্রাম সেবা পৌঁছে দিচ্ছেন এই সংগ্রামী নারী। আদিতমারী উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মো. আইয়ুব আলী জানান, গ্রামের কারো ওষুধ প্রয়োজন হলেই বাইসাইকেল চালিয়ে শহর থেকে ওষুধ এনে দেন জহিরন। ফ্রি সেবা দেন। হাজিগঞ্জের সুফিয়া বেগম জানান, গ্রামের বাড়ি বাড়ি নেন খোঁজ। অন্যর সেবা করতে করতে ৫০ বছর ধরে তার নেই কোনো রোগ। আকলিমা বেগম জানান, সেবা দেওয়ার একমাত্র বাহন বাইসাইলেটি কখনো কখনো নষ্ট হলে গ্রামের লোকজনেই তাকে রিকশায় করে পৌঁছে দেয় বাড়িতে। জহিরন বেওয়া জানান, গ্রামের যেন কোনো নারী বিনা চিকিৎসায় মারা না যান সেজন্য ৪৫ বছর ধরে দিন নাই রাত নাই গ্রামে গ্রামে ছুটছি। এভাবে ৫/৬টি বাইসাইকেল শেষ হয়েছে। সেবা কাজে নতুন বাইসেকেল কেনার নেই সমর্থ। সরকারের কাছে জহিরনের দাবি গ্রামের নারীরা বিনা চিকিৎসায় যেন মারা না যান সেজন্য সবাই দেখবেন।

গ্রামের পর গ্রাম সেবা নারী সমাজে জনপ্রিয় হয়ে উঠে জহিরন জানালেন আদিতমারী উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা গোলাম নবী। জহিরনের সেবামূলক কার্যক্রমে খুশি আদিতমারী পরিবার পরিকল্পনার সবাই। জহিরনের সেবামূলক এ কাজ দেখে সম্মান জানান সবাই জানালেন জেলা প্রশাসক আবুল ফয়েজ মোহাম্মদ আলী উদ্দিন খান। তিনি আরো জানান, তিনি যেন এভাবে কাজ করে যেতে পারেন সেদিকে প্রশাসন সহায়তা দিবে। সাধারণ মানুষের অসুখ হলে খবর পেলেই ছুটে আসেন জহিরন। সংগ্রামী নারী জহিরন বেওয়ার স্বপ্ন গ্রামের মানুষের পাশে থেকে তাদের স্বাস্থ্য সেবা দিয়ে যাবেন আর শরীরে যতদিন বল থাকবে ততদিন। বাইসাইকেল চালিয়ে গ্রামের পর গ্রাম ঘুরবেন।

________________________

সংবাদটি দৈনিক মানবজমিন থেকে পাওয়া।

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়