Ameen Qudir

Published:
2017-04-11 14:18:53 BdST

চিকিৎসকের জীবনে বদলী : তিফারিদি,তোমাকে বিদায়



মেজর ডা. খোশরোজ সামাদ
___________________________________


১।সাধারণ চোখে এই ছবিটি দেখলে পুরনো ,লক্কর -ঝক্কর মার্কা হুড খোলা সামরিক যানের উপর রাখা একটা কামানই নজরে পরবে । একদা এই কামান গর্জে উঠে ছিল ।মরুর ধুলি অমৃতের সন্তানদের রক্তে ভিজে গিয়ে ছিল ।শান্তি প্রিয় সাহারাকে এক সময় স্পেন দখল করে নেয় ।দীর্ঘদিন উপনিবেশিক শাসন চালিয়ে চলে যাবার সময় কূটবুদ্ধি সম্পন্ন ইউরোপীয়রা দুই ভাইয়ের মত পাশাপাশি বসবাসরত সাহারার আদি বাসিন্দা সাহারাঊয়ি এবং মরক্কোর মধ্যে যুদ্ধ লাগিয়ে দিয়ে যায় ।সাহারাউয়িরা অস্ত্র ধারণ করে ।তাদের সশস্ত্র যোদ্ধাদের নাম হয় 'পোলিসারিও ' ।জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় পোলিসারিও এবং রয়েল মরক্কো আর্মির মাঝে শান্তি চুক্তি হয় ।সেই সাক্ষরিত শান্তি চুক্তি কেউ ভাঙছে কি না সেটি দেখভাল করাই আমাদের,জাতি সংঘের শান্তি রক্ষীদের কর্তব্য ।

২।এই কামানটি তিফারিদি নামের জাতি সংঘের এই টিম সাইটের কাছেই রাখা । পোলিসারিওরা পরম মমতায় তাদের কামান ঢেকে রেখেছে ।

৩। এক সপ্তাহ আগে তিফারিতিতে আসি ।আমার মিশন এক বছর ছুঁই ছুঁই করছে ।বাক্স-পেটরা বাঁধা -ছাদা ,বাংলাদেশ থেকে আসা উত্তরসূরিদের কাজ বুঝিয়ে দেয়ার জন্য সদর দপ্তর লেয়ুন নগরীতে কাল ফিরে যাব ।

৪। তিফারিতি সামরিক টিম সাইটে এই মুহূর্তে মিশরীয় চৌকস লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাফেই'র নেতৃত্বে রাশিয়া ,ব্রাজিল ,দক্ষিণ কোরিয়া ,অস্ট্রিয়া ,ঘানাসহ বিভিন্ন দেশের শান্তি রক্ষীরা কাজ করে যাচ্ছেন ।তিফারিদিতে বিভিন্ন সময়ে ,বিভিন্ন মেয়াদে মোট চারবার এসে প্রায় তিন মাস থাকা হল ।মাঝে মাঝে মনে হয়েছে এই জীবন বন্দীশালা। অথচ ,এখানে আমাদের যে রান্না করে খাওয়ায় সেই কুক নিরানন্দময় জীবনের এই চাকুরীতে প্রায় তিরিশটি বসন্ত পার করে দিল ।

৫। সবাই এক সাথেই খাওয়া দাওয়া করি ।প্রায়ই বিভিন্ন দেশের অফিসারেরা তাদের দেশের ঐতিহ্যবাহী খাবার সখ করে রান্না করেন ।সৌখিন রাঁধুনিদের হাতের ছোঁয়ায় চাঁদনী রাতে বার বি কিউ মাংশের ঝাঁঝাল গন্ধে মরুর বাতাস মৌ মৌ করে উঠে। আজ তাদের সাথে শেষ রাত কাটালাম ।অনেকেই স্যুভেনিয়র হিসেবে তাদের দেশের মুদ্রা,বিভিন্ন সামগ্রী উপহার দিল ।এই অফিসারদেরকে 'আমার বিষয়ে 'একাধিকবার ট্রেনিং দিয়েছি ।চিকিৎসা সেবা দিয়েছি ।গত রোজার ঈদে এরাই আমার প্রিয়জন হয়েছিল ।

৬। যে দিন প্রথম এখানে এসেছিলাম অলখে হয়ত বিষণ্ণতা পেয়ে বসেছিল ।ভিনদেশী খাবার খেতে পারি না ।বাংলায় কথা বলবার অফিসার নাই ।চারি দিকে ধু ধু মরুভূমি ।কাজের সময় ব্যস্ত থাকলেও অবসর সময়ে ভয়াবহ একাকীত্ব খুবলে খেয়েছে দিনের পর দিন ।

৭।কাল চলে যাব ।নিকটজনকে কাছে পাবার আনন্দ ধ্বনি শুনতে পাচ্ছি ।কিন্তু ,একটা বিষাদের সুরও কি বুকের ভিতর বাজলো ? এই মরুভুমিতে আমার আর আসা হবে না ।ধুলির ভিতরেও কি মায়া থাকে ? কাঁটাতারের বেড়াতেও কি ভালবাসার সৌরভ জড়ানো থাকে ? ছবির এই পুরনো কামানের গায়েও কি মমতা মাখানো আছে ?আমার রুমের সামনে ক্যাকটাসটার শরীর চিরে ফুল ফুটেছে। কি অপরুপ তার শোভা !আমার গায়ে সৈনিকের কড়া পোশাক । জানি ,ফুলের মায়ায় জড়িয়ে যাওয়া নয় ,নুতন কর্তব্যে নিজেকে সঁপে দেয়াই আমার কাজ ।

৭। দায়িত্বের শানানো অঙ্কের সাথে মানুষ হিসেবে এই তিফারিদি ছেড়ে যাবার বিদায় মুহূর্তে এক ফোঁটা অশ্রুজল যদি মরুর মাটিতে গড়িয়েই বা পড়ে তবে তা লুকানোর ছল নাই বা করলাম !
_________________________

মেজর ডা. খোশরোজ সামাদ , আর্মড ফোরসেস মেডিকেল কলেজ।
ওয়েস্টার্ন সাহারায় শান্তিরক্ষী হিসেবে সফলভাবে এক বছরের কাজ শেষে আর্মড ফোরসেস মেডিকেল কলেজে সহকারী অধ্যাপক, ফার্মাকোলজি বিভাগে যোগ দিয়েছেন।

 

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়