Ameen Qudir

Published:
2017-03-21 17:38:00 BdST

নানী একদিন আমাকে বললেন : ছোটদের সবচেয়ে বড় ফরজ লেখাপড়া করা



 

ডা. রেজাউল করীম
______________________________


আমি একটা মেমোয়ার মত লিখেছিলাম। তার এক স্লাইস শেয়ার করছি। ভাবছি ছাপব কিনা।

"এখন মাথার উপর সূর্য। আর একটু পরে জোহরের আজান দিতে হবে। মৌলবি আস্তে আস্তে পুকুর ঘাটে গোসল করতে চললেন। একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে হক সাহেব বাড়ীর পথ ধরলেন। ওঁর দিকে তাকিয়ে মৌলবি বিড়বিড় করে বলে উঠল- বেনামাজি, বেতমিজ। ও জিনের গল্পটা শুনে ঐ রকম কেন কচ্ছিল বুঝলে? মনে মনে বোধয় ভাবছিল- খোদা তায়ালা কেন আমকে দিলে না!! আরে, নামাজ রোজা কর। খোদাতায়ালাকে ডাক। টা না, সব সময় শুধু শয়তানি!

 


বেশ বেলা হয়ে গেছিল। বাড়িতে সবার খাওয়া হয়ে গেছে। মা বলল- তুই ও কি মাহিন্দার হবি নাকি? অদের সাথে তোর কিসের এত ওঠাবসা।


মা, আজ জিনদের টাকা দেয়ার একটা গল্প শুনলাম। আমাদের ও কিছু টাকা দিলে খুব ভাল হত। মা খুব গম্ভীর হয়ে বলল- তোমাকে একটা কথা বলি শোন ! যত সব আজে বাজে গল্পে বিশ্বাস করবা না। আল্লাহর যারা নবি ওঁদেরকেও খেটে খেতে হয়েছে। জিন পরিরা কেন টাকা দেবে? পরিশ্রম করতে হবে, নাহলে, কিচ্ছু হবে না। এখন যা, গা ধুয়ে খেতে বস।


গ্রামের উত্তরের একটা পাড়াকে চাঁড়াল পাড়া বলা হত। সেই অংশ থেকেই মুসলমান বস্তি শুরু হয়েছে। চাঁড়াল পাড়ার এককোণে একটা পীরের দরগার ধ্বংসাবশেষ। ওখানে মাটির ঘোড়া ডাঁই হয়ে পড়ে থাকে। লোকে পীরের দরগায় ঘোড়া মানত করে। গরিব মানুষ ত সত্যিকারের ঘোড়া দিতে পারে না। তাই মাটির ঘোড়া বানিয়ে ওখানে দিয়ে আসে। আমার ছোটবেলায় খুব ঘোড়ার শখ ছিল। মাটির ঘোড়া কতদিন ওখান থেকে নিয়েছি, কেউ কখনো টের পায়নি। কখনো সখনো আগরবাতি ও জ্বালিয়েছি। ঐ জায়গাটা আমাকে খুব আকর্ষণ করত। পীরের দরগাটার কাছে একটা বাগান ছিল। হরেক রকম ওষধি গাছ আর আম জাম কাঁঠালের গাছে ভরতি। কেউ ভয়ে ওঁর ত্রিসীমানায় যেত না। কেউ বাগানের দরজার কাছে পৌঁছেছে কি পৌঁছায়নি শুনতে পেত- কে রে আবাগের বেটা। তোকে ধরে যদি ভেজে না খাই! তারপর দেখা যেত, লাঠি হাতে এক থুত্থুরে বুড়ি বেরিয়ে আসছে। অনেকেই ভাবত, ঐ বুড়ি ডাইনি। আমার ত বদ্ধমুল ধারনা ও ডাকিনী না হয়ে যায় না। একা একা দৌড়ে আল্লাহ রসুলের নাম করতে করতে ঐ জায়গাটা পাড় হতাম। পীরের দরগায় পৌঁছে ভয়টা কাটত। দরগায় কেউ কেউ ওখানে এক আধটা মোমবাতি আর ধুপও দিয়ে যায়। মা প্রায়ই বলেঃ ওখানে যে পীর সাহেব ছিলেন, তিনি খুবই শক্তিশালি মানুষ ছিলেন। ওঁর একটা পোষা বাঘ ছিল।


পীরের প্রতি আমাদের সবার বেশ আকর্ষণ ছিল। আমার বাবা খুলনার কোন পীরের মুরিদ ছিলেন। পীর সাহেব বাবাকে বলেছিলেন, খুব বেশী কিছু করতে হবে না। সামান্য একটু আমল করলেই যথেষ্ট। তুমি বুকের কাছে হাত দিয়ে ১০০ বার ‘ইয়া আল্লাহ’ বলবে তাহলেই হবে। ‘আমল’ নিয়ে আমরা খুব মাতামাতি করতাম। বাড়িতে একটা বই ছিল, ‘মহা সমাধির কঠোর শাস্তি’।


আমি বইটা পড়তাম। ইদ্গায় বইটা জোরে জোরে পড়া হচ্ছে আর ছোট বড় নানা লোক বসে বসে শুনছে। তার একটা জায়গা পড়ে আমার মনে হাজারো প্রশ্নঃ “পৃথিবী কিসের উপর দাঁড়িয়ে আছে? এক বৃহতাকার সাপের মাথার উপর পৃথিবীকে দাঁড় করিয়ে রাখা আছে। সাপটা মাঝে মাঝে ওর মাথা ঝাঁকিয়ে উঠে তখন ভূমিকম্প হয়”। এইসব ধর্মীয় বইপত্রের মধ্যে “আমল” করার কথা কিভাবে যেন এসে পড়েছিল। “আমল করা” খুব কঠিন কাজ। আমল করে দোয়াটাকে বশে আনা হবে। তখন যা খুশি তাই করা যায়। আমার যে খুব বেশী বিশ্বাস ছিল এমন নয়। কিন্তু পরীক্ষার আগে বিশ্বাস করতে খুব ইচ্ছা করত। আমার যদি আমলের খুব জোর থাকত, তাহলে পরীক্ষায় খুব ভাল ফল করতে পারতাম। ছাপার অক্ষরের প্রতি আমার বাবর খুব দৃঢ় বিশ্বাস ছিল। একবার কি একটা বই পড়ে বলেছিলেনঃ সুরা ইয়াসিন যদি ঠিকমত আয়ত্ত করা যায়, তাহলে বাড়িতে চুরি ডাকাতি কেউ করতে পারবে না।


এই আজগুবি স্বপ্নের রাজত্ব অবশ্য বেশিদিন স্থায়ী হল না। আমার নানী একদিন আমাকে বললেন- ছোটদের সবচেয়ে বড় ফরজ কাজ হল লেখাপড়া করা। ধর্মীয় কাজ করবার অনেক সময় পাবি আগে ভাল করে লেখা পড়া শেখ। পড়াশোনার নেশা তারপর এমন পেয়ে বসল এমনকি কোঠায় লুকিয়ে রাখা হরিদাসের গুপ্তকথা আর চরিত্রহীন ও পড়ে ফেললাম। সেদিন যেমন বুঝিনি আজ ও বুঝতে পারি না, ঐ বইগুলো পড়লে কি করে বখে যাওয়া যায় । "

____________________________

ডা. রেজাউল করীম । বাংলার প্রখ্যাত লেখক কবি। লোকসেবী। সুচিন্তক।

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়