Ameen Qudir

Published:
2017-03-19 17:20:10 BdST

ধন্বন্তরি যখন দেশান্তরি



ডা. অসিত বর্দ্ধন
_________________________

ধন্বন্তরি মহাশয়ের মাথা খারাপ হইয়া গিয়াছে।

এ কথাটা চারিদিকে ঠাহর হইতে বেশি দেরি লাগিল না। গ্রামের মাথা হইতে পায়ের আঙ্গুল পর্যন্ত সকলেই একমত যে বেশি নাম, বড় ধাম, অর্থ, যশ এসকল ই তাহার মাথা খারাপের মুল কারণ। মুখে মুখে রটিয়া গেল যে যেহেতু তাহার মাথা খারাপ, অতএব তিনি দিবানিশি যে কোন সময়ে প্রহারযোগ্য।

কেন মাথা খারাপ হইল ইহা নিয়াও গবেষণা চলিতে লাগিল। সকলে বলিল জনগণের ভালবাসা পাইয়া তাহার মাথা খারাপ। কেহ বলিল, “কলি কাল, এখন চিকিৎসক সেবা না দিয়া শুধু চিকিৎসা দিতে চায়!” কেহ কেহ বলিল, চাবুক মারিয়া ইহার পিঠের ছাল তুলিয়া ফেলা হোক! কেহ বলিল শুধু চটকানা দেওয়া হোক। মৃদু স্বরে কেহ একজন বলিতেছিলেন যে উনি মনে হয় ভুল কিছু করেন নাই, কিন্তু অন্য সকলের রোষ কষায়িত লোচন দেখিয়া বক্তা পলাইয়া বাঁচিলেন।

 

 

ওহ আপনাদিগের সঙ্গে এখনো ধন্বন্তরি মহাশয়ের সঙ্গে পরিচিত করাইয়া দেই নাই। নামহীন এক গ্রামের ইতিহাসের পাতায় ধন্বন্তরি বাবুর নাম জ্বলজ্বল করিতেছে। ইনি একজন কবিরাজ। না তিনি কবিতা লেখেন না, ইনি কবিরাজি পদ্ধতিতে চিকিৎসা করেন। ধন্বন্তরি মহাশয় বেশ নাম কামাইয়াছেন। তাহার হাতে কেহ দেখে জাদু, কেহ দেখে দেবতার ছায়া। রোগী আসিলে তিনি নিবিষ্ট মনে রোগের বর্ণনা শোনেন, খূটাইয়া খূটাইয়া প্রশ্ন করিয়া উপসর্গ জানিয়া লন। ইহার পরে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে একটি বা দুইটি জরি বুটি রোগীকে কিভাবে খাইতে হইবে বুঝাইয়া দেন। তাহার জরি বুটির কল্যাণে সারে নাই এমন রোগী এখনো তার কাছে আসে নাই।

ধন্বন্তরি বাবুর দিন নাই, রাত নাই। রোগী আসিলেই তিনি ঘর হইতে বাহির হইয়া আসেন। চিকিৎসা না দেওয়া পর্যন্ত ঘরে ফিরিয়া যান না। ইহা লইয়া তাহার পরিবার অনুযোগ করিয়াছে, স্বজন ও পাড়া পড়শির কাছে অভিযোগ করিয়াছে, অভিমানে কথা বলা বন্ধ করিয়াছে, অনশন ও করিয়াছে। কিন্তু তিনি শুধু বলিতেন, “সৃষ্টি কর্তা আমাকে এই বিদ্যা দিয়া মানুষকে সেবা করিতে পাঠাইয়াছেন, ইহা প্রদান করাই আমার কর্তব্য। সৃষ্টিকর্তার চাইতে তোমার কথা বড় বলিয়া লই কি প্রকার।”

দিন গিয়াছে, পরিবার মানিয়া নিয়াছেন যে তিনি পূজা পার্বণে থাকিবেন না, গৃহের অনুষ্ঠানে থাকিবেন না, পুত্রের অসুখে তাহাকে সবার শেষে দেখিবেন। পুত্রের তপ্ত কপালে হাত দিয়া বেশিক্ষণ বসিতে পারিবেন না। অন্য রোগীর ডাকে সাড়া দিয়া বাহির হইয়া যাইবেন। স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, পিতামাতা সহ সকলেই কাতর নয়নে অপেক্ষা করিবেন, দেখা পাইতে পারেন, নাও পাইতে পারেন।


যেদিনের ঘটনা সেইদিন প্রাতঃকালে তিনি রোগী দেখিতেছিলেন, সামনের রোগীটি জটিল। আসিতে বিলম্ব করিয়াছে। তাহার শরীরের তাপমাত্রা অনুভব করিয়া বিশেষ চিন্তিত হইলেন। রোগের নিদান লেখিয়া সেবিকাকে কহিলেন শিয়রে জল ঢালিতে। রোগীর পাশে দাঁড়াইয়া চিকিৎসা দেখিতেছিলেন এক স্বজন। তিনি বলিলেন, “ওহে তুমি নিজে বাতাস করনা কেন?” বিস্মিত মুখে ধন্বন্তরি চাহিয়া দেখেন একটি সদ্য কৈশোর অতিক্রান্ত যুবা। গোঁফের রেখা দেখা যায় কি যায় না। কোমরে দুই হাত দিয়া উদ্ধত ভঙ্গিতে তাহার দিকে চাহিয়া আছে। তিনি শান্ত স্বরে বলিলেন, “মহাশয় একটি হাত পাখা লইয়া বাতাস করুন, আমাকে অন্য রোগী দেখিতে হইবে। ওষুধ দিয়াছি। তাপমাত্রা কমিতে কিঞ্চিত সময় লাগিবে, তবে রোগী নিশ্চিত আরাম পাইবেন।”

উদ্ধত ভঙ্গির যুবা, আরেক পা আগাইয়া আসিল। কহিল, “জানিস আমি কে?” অবস্থা দেখিয়া সেবিকা দ্রুত আগাইয়া আসিল। তাহার আগমন দেখিয়া যুবাটি আমোদিত হইলেন। গলার স্বর পালটাইয়া গেল। কিঞ্চিত ভারি গলায় কহিলেন, “মাল টি খাসা! এই কারণে সকলেরই তাপমাত্রা বাড়িতেছে।”


ধন্বন্তরি বহু বছর বহু রোগীর সেবা করিয়াছেন, এমন কথা কখনো শোনেন নাই। রোগীরা সকলেই সেবা পাইয়া কৃতজ্ঞ হন। আশীর্বাদ করেন। কিন্তু সেবিকার প্রতি এমন কুদৃষ্টি দিয়া এমন কটু মন্তব্য কেহই কখনো করেন নাই। তাহার মাথার মধ্যে কি যেন হইয়া গেল। তারপর যাহা কস্মিনকালে কেহ দেখে নাই , তাহা হইল। সকল রোগীর সামনে সেই যুবাটিকে ঘাড় ধরিয়া এমন আছাড় মারিলেন যে তাহার দশা দেখিবার মত হইল। কিঞ্চিত সময় নিশ্চল থাকিয়া , ধীরে ধীরে নেত্র উন্মোচন করিয়া সে ক্ষীণ কণ্ঠে কহিল, “ধন্বন্তরি কাজটি ঠিক কর নাই। আমি পঞ্চায়েত প্রধানের কোতোয়ালের পুত্র। তোমাকে খাইব। তোমার চিকিৎসা খাইব। তুমি যেন আর কখনই তোমার কর্ম করিতে না পার আমার পিতা সেই ব্যবস্থা করিবেন।”

সারা জীবন চিকিৎসা দিয়াছেন, এমন নহে যে কোতোয়াল তাহার পরিচিত নহে। তিনি এমন হুমকি কানে না দিয়া হুঙ্কার দিলেন , তবে রে! জবাবে লেজ তুলিয়া শাখামৃগ পলায়ন করিল।

 

পরের দিন সকালে পাইক আসিয়া হাজির। একখান লেফাফা হাতে। তাহাতে লেখা রহিয়াছে যে ধন্বন্তরি আর চিকিৎসা করিতে পারিবে না। কোতোয়াল মহোদয় ক্রুদ্ধ হইয়াছেন। তাহার পুত্রকে সকলের সামনে স্পর্শ করার সাহস যে দেখায়, সে যেই হোক না কেন তাহার স্থান এই গ্রামে হইবে না। গ্রামের লোক শুদ্ধ সকলে কহিল, ঠিক হইয়াছে। পসার বাড়িয়াছে বলিয়া ইহার মাথা খারাপ হইয়াছে। না হইলে কেউ কোতোয়াল পুত্রকে আছাড় মারিতে পারে। একজন বলিতেছিল যে কোতোয়াল পুত্রের এমন মানহীন কর্কশ বানী ব্যবহার করা উচিত হয় নাই। অমনি যে দৃষ্টিবান তাহার দিকে আসিল সত্য যুগ হইলে ভস্ম হইয়া যাইতেন। বেচারা পড়ি মরি করিয়া পলাইয়া বাঁচিলেন। কি পরিস্থিতিতে আছাড় মারিয়াছিলেন তাহা বোঝাইতে গিয়াছিলেন ধন্বন্তরি। কিন্তু সকলে এমন কর্কশ স্বরে তাহাকে দুষিল যে তিনি অপমানিত হইয়া গৃহে প্রবেশ করিয়া দরজায় খিল আটকাইয়া দিলেন। স্ত্রীর অনুনয় বিনয়ে কাজ হইল না। দুই দিন তিনি নিরম্ব উপবাসে রহিলেন। চৌকাঠে তার স্ত্রী অনুরূপ বসিয়া থাকিলেন। পুত্রের অবস্থা তথৈবচ। গ্রামের সকলে মিলিয়া রোগী না দেখিবার জন্য ধন্বন্তরিকে শাপান্ত করিতে লাগিলেন।

 

রাত্রি পোহাইলে রামু গোয়ালা তাহার স্ত্রীর ঔষধ আনিতে গিয়া দেখে কবিরাজের দরজা বাহির হইতে তালা দেওয়া। ভিতরে কোনও সাড়া শব্দ নাই। তাহার মুখ হইতে গ্রাম ময় রটিয়া গেল যে ধন্বন্তরি দেশান্তরি হইয়াছেন।

রামুর স্ত্রীর শরীর ভাল না। রামু দৌড়াইয়া কোতওয়াল সাহেবের সেরেস্তায় গিয়া কহিল, "ধন্বন্তরি তো আর নাই!"


কেহ কহিল গিয়াছে ভালই হইয়াছে। কেহ কহিল বেশি বাড়িলে এমনি করিয়া পড়িতে হয়। কোতওয়াল মহাশয় হাসিমুখে কহিলেন , "দেখ না কেন কত ধন্বন্তরি তৈরি করিয়া দিই! সারা গ্রাম নতুন কবিরাজ দিয়া ভরিয়া দিব। লোকে তাহাকে ধন্য ধন্য করিতে লাগিল।"

পঞ্চায়েত প্রধানের কানে তখনো এত কথা পৌঁছায় নাই, কিন্তু হল্লার কথা কানে গিয়াছে। তাহাকে কোতওয়াল বুঝাইল যে এক সামান্য কবিরাজের বড় বার বাড়িয়াছিল, তিনি তাহাকে সোজা করিয়া দিয়াছেন। প্রধান কি বুঝিলেন কেহ বুঝিল না।

 

দুই সপ্তাহ পরের ঘটনা। রামুর স্ত্রী শয্যাগত। নতুন কবিরাজ একবার ঘর বাহির করিতেছেন, একবার বজ্র নিনাদে আপনার ঢোল বাজাইতেছেন, আবার কি করিব, কি করিব বিলাপে ঘর ভরিয়া তুলিতেছেন। চোখের সামনে সরিষার ফুল, পিছে কোতওয়ালের শুল, চিন্তা করিয়া তাহার নিজের দুর্বল হৃদপিণ্ড খানা থামিতে চাহিতেছে। গ্রামের আরও কিছু অসুস্থ রোগী কবিরাজের ঘরের সামনে মৃতপ্রায়। সকলে মিলিয়া হাহাকার করিয়া উঠিল হায় হায় আমাদের ধন্বন্তরির জায়গা তো কেউ লইতে পারিল না। কেমন হতভাগা আমরা, কদর না বুঝিয়া অসম্মানে তাহাকে তাড়াইয়া দিলাম।

কোতওয়াল খবর শুনিয়া পোষা বিজ্ঞানীকে ডাকিলেন। কহিলেন, “ভায়া পলাতক ধন্বন্তরির চাইতে বড় একখানা ধন্বন্তরি বানাইয়া আনো।” বিজ্ঞানী চুপ করিয়া রহিলেন। তাহার নত মস্তক দেখিয়া রাগে কোতওয়াল সাহেবের টাকমাথা ঘামে ভিজিয়া গেল। ক্রুদ্ধ স্বরে জিজ্ঞাসিলেন , “তোমার জিহভায় কি ঘা হইয়াছে?” বিজ্ঞানী চুপ করিয়া থাকিলেন।

 

এই খবর প্রধানের কাছে পৌঁছাইল। তিনি কোতওয়াল কে ডাকিয়া নিরালায় ভর্তসনা করিলেন। প্রকাশ্যে কেহ জানিল না। বিজ্ঞানীকে কহিলেন, বানাও না কেন আরেকটা ধন্বন্তরি। বিজ্ঞানী নতমুখে কহিলেন, “কবিরাজ বানাইয়া দিয়াছি। কিন্তু উহার অভিজ্ঞতা হইতে, ধন্বন্তরির জায়গা লইতে কুড়ি বৎসর লাগিবে।”

"কুড়ি বৎসর?" প্রধান ও কোতওয়াল একযোগে চিৎকার করিয়া উঠিলেন?

প্রধান হুকুম দিলেন, ফিরাইয়া আনো ধন্বন্তরিকে।

 

ততক্ষণে ধন্বন্তরি, এক ক্রোশ না কি একশ ক্রোশ, এক গ্রাম নাকি হাজার গ্রাম, এক দেশ না কি বহু দেশ পারাইয়া চলিতেছেন। অপমানের জ্বালায় তার পায়ে আগুন, মাথায় আগুন, বুকে আগুন। শুধু পথ চলিতেছেন, আর বলিতেছেন, “ধন্বন্তরির সম্মান কর না কোতওয়াল, এখন তোমার চিকিৎসা দিবে তোমার ছাওয়াল!”

___________________________


ডা. অসিত বর্দ্ধন
কন্সলাটেন্ট এনেস্থেটিস্ট , কানাডা।
bdemr.com এর প্রতিষ্ঠাতা।
রামেক ২৫ তম ব্যাচ, ৮৩-৮৪ শিক্ষাবর্ষ।

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়