Ameen Qudir

Published:
2017-02-04 19:53:26 BdST

স্বপ্নের ডাক্তার বনাম লোভী ডাক্তার



ডা. রোকন জামান
____________________________

 

আমাদের বিভাগীয় প্রধানের ছেলে এবারের এডমিশন টেস্টে ঢাকা মেডিকেল, বুয়েট, ঢাবি, খুবি .সহ যেখানেই পরীক্ষা দিয়েছে সেখানেই মেরিট লিস্টের প্রথম দিকেই চান্স পেয়েছে।


আধুনিক যুগের ছেলে। বাপের পড়াশোনাও বোধহয় দেখতে হয়েছে। ভালো করেই জানে এই পথের দৈর্ঘ্য, এই পথের কস্ট, এই পথের হাহাকার .....। ও তাই চাকচিক্যময় ভবিষ্যতের শুরু হিসেবে বুয়েটকেই পছন্দ করেছিল।এদিকে ওর বাবার ইচ্ছা ছেলে চিকিৎসকই হোক। তবুও স্যার ওকে জোরাজুরি করেনি। যা ভালো বোঝে তাই করুক, ওর ভবিষ্যৎ ওই বুঝুক ........এধরনের কিছু কথায় নিজের ইচ্ছাকে আড়ালে ফেলতে চেয়েছিলেন।

কিন্তু মনের হাহাকার কি সহজে লুকানো যায়?
ছেলে ঠিকই বুঝে ফেলে।কয়েকদিন ভেবে চিন্তে ও শেষে বাবার পথই বেছে নেয়। ওর এই সিদ্ধান্ত নেয়ার সংবাদ স্যার যখন আমাদের জানাতে আসেন তাঁর কম্পিত কণ্ঠ আর চোখের জল কিন্তু আমাদের নজর এড়ায়নি! নিজের সম্পদের অভাব নেই। মেডিকেল জীবনের কন্টকময় পথও তার অজানা নয়। তবুও তিনি প্রানপ্রিয় সন্তানের জন্য এই পথ কেন বেছে নিয়েছেন।
কেন জানেন?
ওটা আপনার জানার কথা নয়।
-------------------------------------------------

আমার আব্বা ছিলেন স্কুল শিক্ষক। বার ভাইবোনের ছোট আমি। আমার মা এখনো একটা গল্প আমার কাছে বলেন।
আমি ছোট বেলায় যখন অসুখে পড়তাম, আমার রাশভারী মেজ ভাই আমাকে কাধে নিয়ে পাশের বিমল ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে যেতে বলতেন -একদিন আমার এই ভাইটা ও ডাক্তার হবে, এলাকার মানুষ যখন অসুস্থ হয়ে ওর কাছে আসবে তখন যদি তাকে কেউ জিজ্ঞেস করে -কোথায় যাও? ও তখন বলবে 'রোকন ডাক্তারের' কাছে যাই .........

এটার মানে বোঝেন?
------------------------------------------------
আমার বড়ভাই ঢাকায় থাকেন। কিছুদিন আগে খুলনায় এসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন। চাইলে ঢাকায় চলে যেতে পারতেন। কিন্তু আমার কাছেই চিকিৎসা নেন। তার একমাত্র ভায়রা বছর দেড়েক আগে অল্প বয়সে মারা যান। খালাম্মা তার বড় জামাইয়ের জন্য দুশ্চিন্তা করেন। এবার ভাবী এসে বললেন -আম্মু তোর ভাইকে বলেছেন - বাবা রোকন যেখানে থাকে তুমি তার কাছাকাছিই থাক।

কিছুদিন আগে চেম্বারে এক পরিচিত রোগী আসলেন একেবারে শেষ মুহুর্তে। আমি হাসপাতালে ভর্তি করার পর রোগী মারা যান। আগের দিন রোগীর স্ত্রী আমার চেম্বারে এসে বললেন -বাবা, তুমি কেন তোমার চাচাকে তোমার কাছে না রেখে হাসপাতালে পাঠালে? ....

এগুলোর মানে বোঝেন?
--------------------------------------------------

কিছুদিন আগে আমার বাড়িতে পাশের মুদি দোকানদার এক বক্স মিস্টি নিয়ে হাজির। মেয়ে মেডিকেলে চান্স পেয়েছে।

আগেরদিন চেম্বারে এক রোগী চিকিৎসা নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় শুনতে পেয়েছি, তার ছেলেকে বলছেন -বাবা বড় হয়ে তোমাকে কিন্তু ডাক্তার হতে হবে!
-------------------------------------------------

এদেশে রথী মহারথী অনেক আছে,
কোটিপতি অনেক আছে,
বিশাল বড় ক্ষমতাধর মন্ত্রী, এমপি,
আমলা ......অনে.......ক আছে।

কিন্তু বুকে হাত দিয়ে বলেন তো - আজ পর্যন্ত কতজন আপনার ছেলের মাথায় হাত দিয়ে বলেছেন -
-বাবা বড় হয়ে তোমাকে কোটিপতি হতে হবে।
-তোমাকে মন্ত্রী হতে হবে।
-তোমাকে এমপি হতে হবে।
-তোমাকে সাংবাদিক হতে হবে।
-তোমাকে আমলা হতে হবে। .......

বলেছেন? বলেননি।

কারন -ষোলো কোটি মানুষের দেশে আজ পর্যন্ত কেউই মানুষের এতো কাছে যেতে পারেননি।
কারন -কোনো পেশাই আপনার চোখে স্বপ্ন আনতে পারেনি।
কারন -আর কোনো মানুষই আপনার ছোট্ট ছেলেটির চোখে স্বপ্ন বুনতে পারেনি!
----------------------------------------------

আমি জানি কিছু ঘুন ধরেছে! কিছু মরিচা পড়েছে। দুই এক জায়গায় পচনও ধরেছে। টোটাল সমাজের বর্তমান পচনশীল বাস্তবতায় তা কি খুব বেশী?
এবং এজন্য কি টোটাল সিস্টেমের উপর হামলে পড়া যায়?
অনেক কথা, অনেক যুক্তি আছে।
সব বলছি না।

অনেক সুশীল এটাও বলবে -ভাই আপনি তো ভালো। আপনাকে বলিনি। আপনি বলছেন কেনো?

তাদেরকে আমি বলি -কোনটা ব্যাক্তির প্রতি আক্রমণ, আর কোনটি টোটাল পেশার প্রতি আক্রমণ তা আগে বুঝতে হবে।
আপনাকে কেউ যদি বলে -চোরের বংশের সুপুত্র। তাতে আপনি খুশী হবেন?
-------------------------------------------------
চাকচিক্যময় জীবন, সহজ প্রতিষ্ঠা পাওয়ার বিপরীতে কন্টকময় পথ,রাস্ট্রের অবহেলা, আর সীমাহীন সাধনার পথ হওয়ায় বর্তমানে অনেকেই অন্য পেশাতে যেতে চাইলেও তার কোনোটিই কি আপনার স্বপ্ন হতে পেরেছে?
আপনার অনুভূতি হতে পেরেছে?
-------------------------------------------------

আপনারা যারা জাহেদ সাহেবের আড়ালে অসংখ্য কচি কোমল মানসে তাদের 'স্বপ্নের 'ডাক্তারকে লোভী হিসেবে পরিচিত করাতে চাচ্ছেন, তারা কি বুঝেন স্বপ্ন আর অনুভূতিতে আঘাত করার পরিনতি কী হতে পারে?

আগে আপনার সন্তানের সামনে একজন আদর্শ মানুষ, আদর্শ পেশাকে স্বপ্ন হিসেবে দাঁড় করান।

পরে নাহয় আমাদের স্যারের আবেগ, আমার ভাইয়ের আশা, আমার রোগীর অনুভূতি, আর আমার আত্মীয়ের ভরসায় আঘাত হানবেন। আমি কিছুই বলবো না!

__________________________

আমার গত দিনগুলোর ডায়েরীর পাতা থেকে ।

১৯ জানুয়ারী ২০১৭

আজকের ডায়েরি :

(কাল থেকেই খুব মন খারাপ ছিলো। কারনটা পরে বলছি।)

দুপুর দুইটা : সাতদিন ধরে আমাদের ওয়ার্ডে এক রোগী ভর্তি ছিলেন । চল্লিশ বছরের মহিলা। বমি নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। পরীক্ষা নিরীক্ষার পর রোগ ধরা পড়লো, সাইকোজেনিক ভমিটিং ;মানসিক কারনেই এই বমি। রোগ ধরা পড়ার পর চিকিৎসা দিলে রোগী ভালো হয়ে গেলেন। আজকে রাউন্ডের পর ছুটি দিলাম।
...বেলা দুইটার দিকে রোগীর এক আত্মীয় হাজির।
এসেই আবদার জুড়ে দিল -আজকে রোগীকে ছুটি দিয়েন না।

কেন?
-আজকে খুলনায় আমাদের এক বিয়ের অনুষ্ঠান আছে। শেষ হতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে। আজ রাতটা একটু রেখে দেন। কাল ছুটি দিয়েন .............লোকটাকে দেখে বেশ হোমরাচোমরাই মনে হলো। হাতের মোবাইলটার দাম কমপক্ষে তিরিশ হাজার হবে।
বড়ই আজব জাতি আমরা।এতো এতো গোল্ডেন জিপিএ দিয়ে আমরা আসলে কী করছি ? আমরা তো এখনো হাসপাতাল আর হোটেলের মাঝে পার্থক্যই শিখতে পারলাম না!!

দুপুর একটা : কিছু স্টুডেন্ট এসেছে। কথা বলছি। এমন সময় হাজির আমার এক দুর সম্পর্কের নিকটাত্মীয়। .....
তার মেয়ের ব্রেস্ট এ্যাবসেস হয়েছে। গতকাল আউটডোরে সার্জারি বিশেষজ্ঞ দেখালে তিনি ভর্তি হতে পরামর্শ দেন। রোগীরা ভর্তি করাতে চাননি। কারন- চক্ষু লজ্জা। আঠারো বছরের মেয়ে। ভর্তি হওয়ার পর পুরুষ ডাক্তার দেখবে। ....ইতস্তত ঘোরাঘুরি করছিলেন। তাঁর সাহায্যে এগিয়ে আসে এক দালাল। বলে -সামনে চলেন। চুলপাকা, বাপের বয়সী এক ডাক্তার আছে। ...উনি বাইরে যেয়ে এক হাতুড়িকে দিয়ে অপারেশন (!)করিয়েছেন।

জিজ্ঞেস করলাম-যে লোককে দিয়ে মেয়েটার সর্বনাশ করেছেন তার বয়স কত?
বললেন -চল্লিশোর্ধ।
ভালো। তা অপারেশন তো করিয়েছেনই। আমার কাছে এসেছেন কেনো?
-কাটা জায়গা দিয়ে সারারাত পুঁজ আর রক্ত পড়েছে।
-আজকে কি ভর্তি হবো?

আমি আর কথা বলার শক্তি পেলাম না।
বললাম - আর দশ বছর পরে আসেন।আমাদের সবচেয়ে সিনিয়র সিএর বয়স এখনো মধ্য তিরিশেই আছে। .....

......
দুপুর বারোটা : চেম্বারে এক রোগী দেখেছিলাম সাতদিন আগে । থাইরয়েডের পরীক্ষা করাতে বলি মেডিকেল কলেজে।
অন্তত দশ মিনিট বুঝিয়েছিলাম। মেডিকেলেই করাবেন, দালালদের পাল্লায় পড়বেন না। ........আজ রিপোর্ট এনেছে। দেখলাম এক চরম নিম্নমানের ডায়াগনস্টিক থেকে রিপোর্ট করিয়েছে।কথা বলে বুঝলাম এক বাটপারদের পাল্লায় পড়ে ...... .......

সঙ্গে রোগীও আছেন। উনার স্ত্রী।
জিজ্ঞেস করেই বসলাম -ইনি কি প্রথমজন?
উনি কাচুমাচু করে বললেন -জ্বী ইনিই প্রথম। উনি কিছুই না বুঝে বললেন -এখন কী চিকিৎসা দিবেন স্যার?

বললাম -কিছুই লাগবে না।

কেন স্যার?
-বৌটা খুব ভালো। বাড়ি যেয়ে টানা সাতদিন বিশ্রাম দিবেন, আর খালি আদর যত্ন করবেন! তারপর চিকিৎসা।
ঝাড়া দশমিনিট বুঝিয়ে বলে , লিখে দেয়ার পরও যে লোক দালালের এক কথাতেই বাইরে চলে যায়, তার যে বৌটা এখনো টিকে আছে,স্বামী সেবা -সংসার সবই করছে, তাকে আর তিতা ওষুধ খাওয়ায়ে কস্ট দিবেন ক্যান?

সকাল দশটা : বড় ভাইয়ের বন্ধুর স্ত্রী আসলেন। দুইমাস আগে তার ছেলেকে দেখে কিছু ওষুধ দিয়েছিলাম। আজকে এসেছেন ওষুধ খাওয়াবে কিনা জানতে।
এতদিন কি করেছেন?
;দোকানে ওষুধ কিনতে গেলে দোকানি বলেছে :পাঁচশো পাওয়ারের ওষুধ বাচ্চাকে খাওয়াবেন? সেই ভয়ে আর খাওয়াইনি। ...তারপর তিনজন হোমিও দেখাইছি।
-এখন কি আপনার আগের ওষুধ খাওয়াবো?
........এসব শুনলে আগে রাগ করতাম। এখন করিনা। আর বড় ভাইয়ের ছেলেবেলার বন্ধুর স্ত্রী বলে কথা!

নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে জিজ্ঞাসা করে বসলাম -কবিরাজ দেখাননি? বললো- এলাকায় তেমন ভালো কবিরাজ নেই, তবে মনিরামপুরে নাকি একজন ভালো কবিরাজ আছে।
যাব নাকি? ...

আমি কথা বাড়ানোর যন্ত্রণা থেকে রেহাই পেলাম। বললাম তাহলে দেরী না করে কেশবপুরেই একটু পাত্তা লাগান .....
---------------------------------

ডাঃ সুমন শিকদার।।ওর ব্যাপারে গতকাল জেনেছি। খুলনা মেডিকেলের সাবেক একজন ছাত্র, বর্তমান সরকারের একজন বিসিএস কর্মকর্তা। সাতদিন নিখোঁজ থাকার পর তার ডেডবডি মিলেছে। মর্গে।এটা নিয়েই মনটা খুব খারাপ ছিলো।
এখন মনটা ভালো হয়েছে বিএমএর শোকবার্তা সম্পর্কিত মেসেজ পেয়ে! যাক এই গরীব দেশের মেধাবী একজন সরকারি কর্মকর্তা ও চিকিৎসক লাশ হওয়ায় সরকারের টনক না নড়লেও বিএমএর তো বেশ একটা টনক নড়েছে। নইলে কি আর মেসেজ পাঠায়?
ডাঃ সুমন, তোমার বড় কপাল!!

ডাঃ সুমন শিকদার।যেদিন তোমার ডেডবডি মিলেছে সেদিনই আদালত রুল জারি করেছে, চিকিৎসকদের পড়ার উপযোগী সুন্দর হাতের লেখায় স্পস্ট অক্ষরে প্রেসক্রিপশন লিখতে হবে।যে দেশে সব পিএইচডি ডিগ্রিধারী উচ্চশিক্ষিত ফার্মাসিস্টরা তোমার বাজে হাতের লেখা বুঝতে না পেরে সব রোগী মেরে ফেলছে সেই দেশে তোমার মতো কষাইরা কেন বেঁচে থাকবে? তোমাকে নিয়ে তো এখনো কেউ কিছু ভাবছেনা।
তবে আমি ভাবছি -কিভাবে মরলে তুমি?
সাপের কামড়ে, নাকি ভুতের ভয়ে?
-----------------------------------

এদেশ দালালের, প্রাইমারী পাশ ফার্মাসিস্টের, এদেশ এইট পাশ কোয়াকদের, এদেশ কাজে ফাকি দিয়ে ক্লিনিকের মালিক হওয়া ওয়ার্ড বয়দের।এদেশ কবিরাজদের, হোমিওদের।
এদেশ ফুলের মতো চরিত্রের রাজনীতিবিদের, সাংবাদিকদের।
এদেশ এভারেজ দ্বিতীয় শ্রেণীর মেধাবী ছাত্র -প্রশাসনিক কর্তাদের,আমলাদের ।
এদেশ পুলিশের।বালিশের ....।এদেশ কোটি টাকার রাস্তার সত্তর লাখ খেয়ে ফেলা কন্ট্রাকটরদের........

এরা সবাই একএকটা রত্ন! এদেশ রত্নগর্ভা!
এদের নিয়েই তো আমরা মহাসুখে আছি। এদের নিয়ে সরকারের কোনো অভিযোগ নেই। আদালতের মাথাব্যথা নেই। সাংবাদিকদের লেখালেখি নেই।
এদেশের যতো মাথাব্যথা সব তো ডাক্তারদের নিয়েই!

এতো এতো রত্ন, মনিমুক্তোর ভীড়ে কুলাঙ্গার তো ডাক্তাররাই। নয় কি?

____________________________

ডা. রোকন জামান ; লোকসেবী ডাক্তার।

আপনার মতামত দিন:


কোথায় ডাক্তার এর জনপ্রিয়