Ameen Qudir

Published:
2017-05-07 00:57:23 BdST

যত টেস্ট তত টাকা



সাঈদুর রহমান রিমন

______________________________

‘যত টেস্ট তত টাকা’, এই কমিশন বাণিজ্যের মধ্য দিয়েই চলছে একশ্রেণির ডাক্তারের অর্থ উপার্জনের বেপরোয়া কর্মকাণ্ড। প্রেসক্রিপশনে যত বেশি ডায়াগনস্টিক পরীক্ষার বিষয় উল্লেখ থাকবে, ততই কমিশন পাবেন তিনি। ডায়াগনস্টিক পরীক্ষার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ডাক্তার পান শতকরা ৩০ থেকে ৬০ ভাগ পর্যন্ত কমিশন। একইভাবে প্রাইভেট হাসপাতালে রোগী ভর্তি, নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের ওষুধ প্রেসক্রাইব, অপারেশন নিশ্চিত করা, প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে লাইফ সাপোর্টে পাঠানো, কেবিনে রোগী ধরে রাখাসহ লাশ হিসেবে হস্তান্তর পর্যায়ের নানা ধাপেই কমিশন লেনদেন হয়।

সরকারি অনুমোদন ছাড়াই দেশজুড়ে ডায়াগনস্টিক সেন্টার, প্যাথলজি ব্যবসার ছড়াছড়ি। সাইনবোর্ডসর্বস্ব এসব প্রতিষ্ঠানে হাতুড়ে টেকনিশিয়ান দিয়েই চলে রোগ নির্ণয়ের সব পরীক্ষা। তারা মনগড়া রিপোর্ট তৈরি করে অহরহ ঠকাচ্ছে নিরীহ মানুষকে। একই রোগ পরীক্ষায় একেকটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে একেক রকম রিপোর্ট পাওয়ার অসংখ্য নজির রয়েছে। পুরুষের পরীক্ষা রিপোর্টে তুলে ধরা হয় মেয়েলি রোগের বিবরণ। আবার উল্টো চিত্রও আছে। এসব রিপোর্ট নিয়ে রোগী ও তাদের স্বজনরা চরম বিভ্রান্তিতে পড়েন। তা সত্ত্বেও সরকারি হাসপাতালের একশ্রেণির ডাক্তারের সহায়তায় ডায়াগনস্টিক সেন্টার মালিকদের যথেচ্ছ টেস্টবাণিজ্য চলছে বছরের পর বছর। অভিযোগ তুলেও এসবের প্রতিকার মিলছে না।

 

ডাক্তাররা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সরবরাহকৃত স্লিপে টিক মার্ক দিয়ে দেন কোন কোন টেস্ট করাতে হবে। রোগী নিজের পছন্দের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সেই টেস্ট করালে ডাক্তার সে রিপোর্ট গ্রহণ করেন না। ডাক্তার তার নির্ধারিত সেন্টার থেকে আবার একই টেস্ট করিয়ে আনতে চাপ দেন। ওই সেন্টার তাকে কমিশন দেয়। কমিশন নিশ্চিত হওয়ার পরই কেবল চিকিৎসা মেলে। পরীক্ষার ফি বাবদ ইচ্ছামাফিক টাকা-পয়সা আদায় করা হচ্ছে। একই ধরনের প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার জন্য একেক প্রতিষ্ঠানে ধার্য আছে একেক ধরনের ফি। নিয়ম আছে রেট চার্ট প্রতিষ্ঠানের দর্শনীয় স্থানে লাগিয়ে রাখার। কেউ সে নিয়ম মানছে না। বেশি টাকা দিয়ে টেস্ট করিয়েও সঠিক রোগ নির্ণয়ের নিশ্চয়তা পাচ্ছেন না ভুক্তভোগীরা। রোগী আকর্ষণের জন্য ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোয় বিশেষজ্ঞদের তালিকার সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রাখা হলেও তাদের অধিকাংশকেই পাওয়া যায় না। নাম ব্যবহার বাবদ মাসিক ফি দেওয়া হয় ওইসব ডাক্তারকে। ডাক্তাররা এখন সামান্য জ্বর, ঠাণ্ডা, কাশির জন্যও ডজন ডজন পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা লিখে দিচ্ছেন। প্রয়োজন না থাকলেও হাসপাতালে ভর্তি পর্যন্ত করিয়ে ছাড়েন তারা। সুযোগ থাকলে অপারেশনের মুখোমুখি করিয়ে লাইফ সাপোর্টের পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়া হয় রোগীকে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই ডাক্তারের জন্য রয়েছে লোভনীয় কমিশন। সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতাল থেকে রোগী বাগিয়ে নিয়ে অভিজাত হাসপাতালে ভর্তি করাতে পারলেই শতকরা ৪০ ভাগ ‘ভর্তি ফি’ সংশ্লিষ্ট ডাক্তারের পকেটে যায়। এ কমিশন বাণিজ্যের প্রভাবে চিকিৎসা ব্যয় বহুগুণ বেড়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে গরিব মানুষ চিকিৎসা নিতে গিয়ে আরও নিঃস্ব হয়ে পড়ছে। অপারেশন, ক্যান্সার রোগীদের কেমোথেরাপি, অর্থোপেডিক রোগীদের ফিজিওথেরাপি, কিডনি রোগীদের ডায়ালিসিসের ক্ষেত্রেও আলাদা কমিশন নির্ধারণ করা আছে। এমনকি ওষুধ লেখার জন্য আগে থেকেই ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে কমিশনের নামে নানা রকম সুযোগ-সুবিধা নেন অনেক চিকিৎসক।

সরকারি সেবা রোগীদের জোটে না : সরকারি হাসপাতালের রোগ পরীক্ষার যন্ত্রগুলো হয় অকেজো, নয় তো খোলাই হয় না বছরের পর বছর। অনেক হাসপাতালে যন্ত্রগুলো চালানোর মতো দক্ষ টেকনিশিয়ান নেই। এসব কারণে ঢাকার প্রায় সব সরকারি হাসপাতালসহ সারা দেশের মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জেলা ও উপজেলা হাসপাতালে চিকিৎসা সরঞ্জামাদির সুযোগ-সুবিধাও রোগীদের ভাগ্যে জুটছে না। ফলে ন্যূনতম রক্ত পরীক্ষা থেকে শুরু করে ক্যান্সার নির্ণয় পর্যন্ত যাবতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য রোগীরা বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ওপরই নির্ভরশীল।

অভিযোগ উঠেছে, কমিশনের লোভে বেশির ভাগ সরকারি হাসপাতালের প্যাথলজিক্যাল বিভাগটিকে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে দেওয়া হয় না। বাধ্য হয়ে রোগীদের বেশি টাকা খরচ করে যেতে হয় বেসরকারি ক্লিনিকে। আর এসব ক্লিনিকে রোগ পরীক্ষা করেন সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরাই। রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে প্রায় ১২ কোটি টাকা দামে কেনা ল্যাসিক মেশিনটি রোগীদের চিকিৎসার কাজে আসছে না। ক্যান্সার হাসপাতালের চারটি লাইনাক মেশিনের একটি পড়ে আছে বিকল হয়ে, অন্য তিনটি লাইনাক ও দুটি কোবল্ট মেশিন চালানো হচ্ছে জোড়াতালি দিয়ে। আর কোবল্ট মেশিনগুলো ১৫ থেকে ২০ বছরের পুরনো এবং অনেকটা নিম্নমানের হওয়ায় এগুলো দিয়ে রোগীর সেবা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।

ভুয়া প্রতিষ্ঠানের ছড়াছড়ি : দেশে বৈধ লাইসেন্সে মাত্র ৭ হাজার ৬০০ প্রাইভেট হাসপাতাল-ক্লিনিক এবং ৬ হাজার ৮৬৮টি ডায়াগনস্টিক সেন্টার থাকলেও অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে প্রায় দেড় লাখ চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসার নামে চলছে গলা কাটা বাণিজ্য। শুধু রাজধানীতে লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিকের সংখ্যা ৪০৫ এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টার ৬৬০টি। কিন্তু বাস্তবে রাজধানীতে রয়েছে ৫ হাজারেরও বেশি ডায়াগনস্টিক সেন্টার। কাঁচামাল ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে মাছ ব্যবসায়ীরা পর্যন্ত প্রাইভেট ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক বনে গেছেন। রাজধানীসহ দেশের সর্বত্র ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে হাসপাতাল, ক্লিনিক, নার্সিং হোম। সাইনবোর্ডসর্বস্ব এসব প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসাসেবার নামে চলছে গলা কাটা বাণিজ্য। সূত্র জানায়, শুধু রাজধানীসহ আশপাশের এলাকাতেই অবৈধভাবে ১০ সহস্রাধিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র সাড়ে ৩ হাজার প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স চেয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরে আবেদন পাঠালেও আর কোনো যোগাযোগ করেনি। বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টারসমূহে রোগীদের থেকে মাত্রাতিরিক্ত ফি আদায় কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না। খেয়ালখুশিমতোই বাড়ানো হচ্ছে সেবা ফি। চিকিৎসার নামে নানা কৌশলে রোগী ও তার স্বজনদের পকেট খালি করেও ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ ক্ষান্ত হয় না, উপরন্তু রোগীকে বন্দী রেখে বা রোগীর লাশ জিম্মি করেও লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়।
বাংলাদেশ প্রতিদিনের সৌজন্যে।

আপনার মতামত দিন:


কোথায় ডাক্তার এর জনপ্রিয়